বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রয়েছে দুই হাজার বছরের একটি ঐতিহ্যসমৃদ্ধ শহরের ইতিহাস। যার নামের পেছনে গ্রাম শব্দটি থাকলেও আসলে এটি কোনো গ্রাম নয়। এর সংস্কৃতিও গ্রাম্য নয়। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে চট্টগ্রাম নগরীকে বলা হয় কসমোপলিটন নগর।
বৈশ্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেরও বেশ উন্নয়ন হয়েছে। তবে কায়েমি স্বার্থবাদীরা চট্টগ্রামকে একটি পরিকল্পিত ও টেকসই নগর হিসেবে গড়ে উঠতে দেয়নি। কারণ শুরু থেকে চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের সঠিক পরিকল্পনা করা হয়নি, যতটুকোও হয়েছে সেটা কাগজ-কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কারণ তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নগরবাসীর কাছে অনেকাংশেই দিবাস্বপ্নের ন্যায়। তাই বিশৃঙ্খলভাবে চট্টগ্রাম শহর আকারে বড় হয়েছে। অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদ হারিয়ে হয়েছে রুগ্ণ।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ও প্রাচ্যের রাণীখ্যাত চট্টগ্রামের নাগরিকদের জীবনযাত্রা কেমন-এ প্রশ্নের একটাই উত্তর আর তা হলো-ভালো নয়। কারণ, নানাবিধ নাগরিক দুর্ভোগ ও সমস্যার শিকার চট্টগ্রামবাসী এক ধরনের মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা, যানজট, গণপরিবহনের গণভোগান্তি, বিশুদ্ধ পানিসংকট ইত্যাদি সমস্যা এতোদিন ধরে নগরবাসীকে যন্ত্রণা দিয়েছে। এবার দিনকে দিন মৃত্যুর মিছিল বেড়ে যাওয়ায় অরক্ষিত নালা-ড্রেন মৃত্যুকুপে পরিনত হয়েছে। এ যেনো নগরবাসীর উপর ‘মরার উপর খরার ঘা’ এ পরিনত হয়েছে।
বন্দরনগরীর গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান সড়কটি মুরাদপুর থেকে ২ নম্বর গেট হয়ে জিইসি মোড় দিয়ে অন্য সড়কের সাথে যুক্ত হয়েছে। সড়কের এই অংশে উত্তর পাশে ৬-৮ ফুট প্রস্থের নালা রয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো নালাগুলো সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। কোথাও স্লাব বা নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। একইভাবে বহদ্দারহাট থেকে মুহাম্মদপুর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে আছে বড় আকারের নালা। এতে নেই কোনো স্লাব। বহদ্দারহাট থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত চাক্তাই খাল। খালের অধিকাংশ অংশই অরক্ষিত। ষোলশহরের চশমা খালের পাড়েই আছে ২০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭ ফুট প্রস্থের উন্মুক্ত সড়ক। এভাবে নগরের খাল, নালা, ড্রেনগুলো অরক্ষিত হয়ে আছে। অরক্ষিত খাল-নালায় পড়ে ঘটছে মৃত্যু ও নিখোঁজ। সঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনা।
নগরীতে ২৮৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ১৪৪টি ফুটপাথ থাকলেও তার অধিকাংশই রয়েছে অবৈধ দখলদারদের বেদখলে। ফুটপাথ দিয়ে পথচারীদের হাঁটার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। তা ছাড়া নগরে প্রায় ২০০ ম্যানহোল আছে, যার অধিকাংশই উন্মুক্ত। নগরের অধিকাংশ সড়কই ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় রয়েছে
সবচেয়ে দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যের হলো যে, দেশ এখন ‘উন্নয়নের জোয়ারে’ ভাসলেও চট্টগ্রাম আটকে আছে জলাবদ্ধতায় ও অরক্ষিত নালায় পরে নগরবাসীর মৃত্যুতে। যার বদৌলতে এলাকায় এলাকায় ‘মৃত্যুকূপ’ দেখতে পাচ্ছি। যেগুলো একের পর এক টেনে নিচ্ছে তরতাজা মানুষকে। ছালেহ আহমেদ গেলেন, সাদিয়া গেলেন, সবশেষ শিশু কামালকে প্রাণ দিতে হলো। এখন নগরবাসীর মনে প্রশ্ন হলো এই মৃত্যুকুপ ও মৃত্যুমিছিলের শেষ কোথায়?
চট্টগ্রামে সম-সাময়িক সময়ে অরক্ষিত ড্রেন-নালায় পরে বেশ কয়েকজন মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় সরকারি দুটি সংস্থাই একে অন্যকে দোষ দিচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বলছে, দুইদিকে ফুটপাত করলেও খালের মুখটি অরক্ষিত করে রেখেছে সিডিএ। তাই এর দায় নিতে হবে সিডিএ কে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ বলছে, খালের মালিকানা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের। তাই খালের মুখে সুরক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্বও তাদের। কিন্তু নালা-খালে একের পর এক মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ নগরবাসী। তারা বলছেন, দায় এড়ানোর এই প্রবণতা প্রমাণ করে সেবা সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবর্তে নগরবাসীর ‘মৃত্যুফাঁদে’ পরিণত হয়েছে। নগরে জলাবদ্ধতার সময় গত ছয় বছরে নালা-নর্দমা ও খালে পড়ে অন্তত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে দশ বছরের শিশু কামালসহ গত তিন মাসেই প্রাণ গেল পাঁচজনের। চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নালায় পড়ে মো. কামাল (১০) নামের এক শিশু নিখোঁজ হয়েছে। মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টার দিকে আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ওই শিশুকে উদ্ধারে অভিযান শুরু করে। এর আগে সোমবার (৬ ডিসেম্বর) বিকেল ৪টায় এ ঘটনা ঘটে। কিন্তু বারবার কেন এ ঘটনা ঘটছে? চট্টগ্রামের নালাগুলো কেন এমন মৃত্যুকূপ হয়ে উঠল? একটি প্রকল্প শেষে কিছুদিন যেতে না যেতেই সেটিকে খুঁড়ে ফেলা হচ্ছে আরেকটি প্রকল্পে। প্রকল্পের চক্করে পড়ে শহরের কোনো সড়কই বেশি দিন ঠিকঠাক থাকে না, হাঁটার রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না, নালা-নর্দমাগুলো বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে থাকে বছরের পর বছর। প্রিয় মানুষের হাত ধরে হাঁটতে গিয়েও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একটা কথা ভুলে গেলে চলবে নাহ, চট্টগ্রামের খাল ও নালার ডিজাইন দেশের অন্য শহরের থেকে ব্যতিক্রম হবে। কারণ এখানে পাহাড় আছে। এখানে খাল-ড্রেনগুলো উন্মুক্ত রাখতে হয় রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কারের জন্য। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। এ ধরনের চওড়া ও গভীরতা সম্পন্ন খালগুলোর পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা জরুরি। দেয়াল বা গ্রিল দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে। পাশাপাশি যেসব সংস্থা উন্নয়নমূলক কাজ করছে তাদের কাজ করার সময় জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে। কনস্ট্রাকশনের কাজ চলার সময় যে ঠিকাদার কাজ করবে, তাদেরই কাজ চলা অবস্থায় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার সেই ঠিকাদার বা যারা কাজ করছে তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে কি না তা খোঁজ নেওয়া তদারকি সংস্থার দায়িত্ব। তাই অতিদ্রুত যেসব সংস্থা উন্নয়ন কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে।
মোদ্দাকথা হলো, বর্তমানে শীতকালীন যে সময়টা চলছে সেটা বন্দরনগরীতে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো অতিদ্রুত শেষ করা এবং অরক্ষিত নালা-ড্রেনে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মান করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। পাশাপাশি চট্টগ্রামের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক নগর পরিকল্পনাবিদ অতিদ্রুত নিয়োগের মাধ্যমে পরিপূর্ণ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা বেশ জরুরী হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ যেকোনোমূল্যে অরক্ষিত নালা-ড্রেনে যে মৃত্যুকুপ তৈরি হয়েছে তা সমাধান করতে হবে। নতুবা নগরবাসীর মনে এই প্রশ্ন সর্বদাই থাকবে যে, আর কতো প্রানহানি ঘটলে উন্নয়ন ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর টনক নড়বে!
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চুয়েট।