দৈনিক আজাদীর ৫ নভেম্বর সংখ্যায় ‘চট্টগ্রামে বন্ধ হচ্ছে বিনিয়োগ বোর্ডের কার্যালয়’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে বিনিয়োগ বোর্ডের কার্যালয় গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে। একইসাথে দেশের সব বিভাগীয় কার্যালয়ও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম শুধুমাত্র ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে পরিচালিত হবে বলে জানানো হয়েছে। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল চট্টগ্রামে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার্যালয় বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এতে ব্যবসা–বাণিজ্যসহ বিনিয়োগের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে বলে তারা মন্তব্য করেছেন। অবশ্য বিনিয়োগ বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, অনলাইন সেবার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা সব ধরনের সেবা পাবেন।
সংবাদটি শুধু চট্টগ্রামের জন্য নয়, সারাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়। যেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবকটি কার্যালয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন, সেখানে বিনিয়োগ বোর্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয়করণে নেতিবাচক কিছু বিষয় রয়েছে। প্রথমত, কেন্দ্রীভূত পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব ও রূপের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কার্যক্রম বেশি দেখা যায়। এই ব্যবস্থাপনায় নিম্ন শ্রেণির কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ কম পায় এবং তারা কেবল উচ্চমহলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, এমনকি যখন নিম্নস্তরের কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অসুবিধার সম্মুখীন হয়, সেই ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সহজেই সমস্যা সমাধান করতে বা বুঝতে পারেন না, কারণ তারা কেবল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নকারী নয়। এতে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, কারণ নিম্ন–স্তরের কর্মচারীদের মতামত ব্যতিত শীর্ষ স্তরের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রেরণার অভাব লক্ষ্য করা যায়। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের তদারকি করার জন্য নির্বাহীদের হাতে তেমন সময় থাকে না, কারণ তারা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে। এতে কর্মীদের কাজের প্রতি অনীহা ও অবহেলা বৃদ্ধি পায়।
বর্তমান সময়টা অর্থনৈতিক খাতের জন্য খুবই সংকটকাল। বলা যায়, ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে অর্থনীতি। এ অবস্থায় দেশি–বিদেশি বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যখন বিরাজ করে, তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও দ্বিধা তৈরি হয়। তারা নিশ্চিত হতে পারে না, তাদের বিনিয়োগ কতটা নিরাপদ থাকবে কিংবা ভবিষ্যতে সরকারের নীতিমালায় কোনো হঠাৎ পরিবর্তন আসবে কি না। রাজনৈতিক সহিংসতা কিংবা সরকার পরিবর্তনের শঙ্কা একটি দেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশকে হুমকিতে ফেলে।
বিনিয়োগকারীরা সাধারণত স্থিতিশীলতা ও নীতির ধারাবাহিকতা চায়, যাতে তারা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে। তাই যেকোনো সরকারের দায়িত্ব হলো একটি বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রশাসনিক এবং আইনি কাঠামো গড়ে তোলা, যাতে ব্যবসায়ীরা নিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে পারেন।
চব্বিশের অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতিতে এখনো একধরনের অস্থিরতা ও আস্থার অভাব বিরাজ করছে। দাবি আদায়ে নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ মাঠপর্যায়ে আন্দোলন করছেন। পোশাকশিল্পের কারখানায় বেড়েছে শ্রমিকপক্ষের অসন্তোষ। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মব সন্ত্রাসে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। এ পরিস্থিতিতে আস্থাহীনতায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। দেশি বিনিয়োগের অবস্থাও নাজুক। এতে কমেছে শিল্পের উৎপাদন। ব্যবসায় চলছে মন্থরগতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিপরীতে বাড়ছে বেকারত্বের হার।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বাড়ানোর বিকল্প নেই। অনেকেই প্রত্যাশা করছেন, দেশে নির্বাচিত ও একটি সংবেদনশীল সরকার ক্ষমতায় এলে দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। তখন বিনিয়োগে মনোযোগী হবেন উদ্যোক্তারা।
আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে চট্টগ্রামে ২ হাজার ৪১২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। বিপুল এই বিনিয়োগে চট্টগ্রামস্থ কার্যালয় থেকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হয়েছে। এর আগের বছর চট্টগ্রামে বিনিয়োগ ছিল ৩ হাজার ৪৫০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগকারীদের জন্য এখানে বিনিয়োগ বোর্ডের কার্যালয় থাকা জরুরি বলে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা মন্তব্য করেছেন।
চট্টগ্রামে বিনিয়োগ বোর্ডের কার্যালয় বন্ধ হলে দেশের বিনিয়োগে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে বিনিয়োগকারীদের ফিজিক্যাল সহায়তা কমে যাবে। তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা সামগ্রিক স্বার্থ বিবেচনা করে চট্টগ্রামে বিনিয়োগ বোর্ডের কার্যালয় চালু রাখা প্রয়োজন।







