ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে। গতকাল চট্টগ্রামে চলতি বছরের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ ২২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর বাইরে আরো অনেকে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। চলতি জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। মাসের শুরু থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া রয়েছে ভ্যাপসা গরমের অনূভূতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের আবহাওয়া ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য সহায়ক। এডিস মশা তিনদিনের বেশি জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন বাসা বাড়ির ছাদে বাগান করা হচ্ছে। বাগানের টবে জমছে পানি। এর বাইরে ডাবের খোসা এবং পরিত্যক্ত গাড়ির টায়ারে জমে থাকা পানিতেও মশার বংশবিস্তার হয়।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় একদিনে ২২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ১৩ জন পুরুষ, ৫ জন মহিলা এবং ৪ জন শিশু। বর্র্তমানে বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬ জন, ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে ১ জন, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ২ জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫ জন এবং বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৮ জন। এছাড়া চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৫২৮ জন। এরমধ্যে নগরীতে ২৩৪ জন এবং উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৯৪ জন। অন্যদিকে মারা গেছেন ২ জন।
গতকাল সোমবার পর্যন্ত ডেঙ্গুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৭০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৮ জন, মার্চে ২২ জন, এপ্রিলে ৩৩ জন, মে–তে ১১৬ জন, জুনে ১৭৬ জন এবং চলতি জুলাইয়ে প্রথম সপ্তাহে ৮৩ জন। অপরদিকে গত বছরের জুনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ৪১ জন এবং জুলাইয়ে আক্রান্ত হয়েছিল ১৯৮ জন। কিন্তু চলতি বছরের জুন–জুলাইয়ের আক্রান্ত রোগী গত বছরের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ বেশি। এক সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ নগরীতে সীমাবদ্ধ ছিল, তবে এখন সেটি নগরী পেরিয়ে গ্রামাঞ্চলেও চোখ রাঙাচ্ছে। চলতি বছর ৫২৮ জনের মধ্যে ২৯৪ জনই উপজেলার রোগী। এরমধ্যে ১৫৫ জনই লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী এবং আনোয়ারার বাসিন্দা। এরবাইরে সীতাকুণ্ডে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এডিস মশার বংশ বিস্তার থামানো গেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এমনিতেই কমে যাবে। বিশেষ করে আমাদের চারপাশে যেসব জায়গায় এডিস মশা জন্মায় সেসব জায়গায় যাতে এডিস মশা জন্মাতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরিষ্কার ও বদ্ধ পানি এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র। তাই বসতবাড়ির আশপাশে ডাবের খোসা, ফুলের টব, ছাদবাগান ও ফ্রিজের নিচের ট্রেতে তিন দিনের বেশি পানি যাতে জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাসাবাড়ি, ছাদের আঙিনা নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার রাখতে হবে। এটি সবার দায়িত্ব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না। অনেক রোগী ডেঙ্গু পরীক্ষার (এনএসওয়ান) রিপোর্ট পজিটিভ হওয়ার সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছেন। এটির আসলে কোনো দরকার নেই। ডেঙ্গুর প্ল্যাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নেমে গেলে তখন কেবল রোগীর শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়। তখন জরুরি চিকিৎসা কিংবা নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। অন্যদিকে রক্তের প্ল্যাটিলেট কমা শুরু হয় জ্বর কমে যাওয়ার পর পর। তখন শারীরিক কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। ওই সময় হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্ল্যাটিলেট নিয়ে আতঙ্ক লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আসলে প্ল্যাটিলেট যখন বাড়া শুরু হয় তখন দ্রুতই বাড়ে। কাজেই ডেঙ্গু জ্বর হলেই আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। গত বছর বিশেষ করে ডেঙ্গুর ভ্যারিয়েন্ট ডেন–২ এর সাব ভ্যারিয়েন্ট কসমোপলিটনে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার বেশি ছিল।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাড়ছে এটি ঠিক। তবে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। মশক নিধনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ডেঙ্গু হলে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ারও দরকার নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে বাসায় চিকিৎসা নেয়া যাবে। তবে কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দিলে হাসপাতালে যেতে হবে। বিশেষ করে যাদের দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগ রয়েছে, যেমন–কিডনি, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ রয়েছে তাদের সতর্ক থাকতে হবে।
জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের হাসপাতালের তিনটি মেডিসন ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্নার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৬ জন রোগী ভর্তি আছে। আমাদের প্রস্তুতির ঘাটতি নেই। ডেঙ্গুর ব্যবস্থাপনায় আমাদের প্রত্যেক চিকিৎসককে অভিজ্ঞ বলা যায়।
উল্লেখ্য, গত বছর ২০২৪ সালে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৩২৩ জন এবং মারা যান ৪৫ জন। এর আগে ২০২৩ সালে আক্রান্ত হয়েছিল ১৪ হাজার ৮৭ জন। এরমধ্যে মারা যায় ১০৭ জন। এছাড়া ২০২২ সালে মোট আক্রান্ত ৫ হাজার ৪৪৫ জনের মধ্যে মারা যান ৪১ জন এবং ২০২১ সালে আক্রান্ত হয় ২২১ জন এবং মারা যায় ৫ জন।