চট্টগ্রামে চুরি ও অপচয় ঠেকাতে পারলে প্রতিদিন ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব। ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা গেলে চট্টগ্রামে আর কোনো লোডশেডিং করতে হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় বড় ব্যাপার বলে পিডিবি সূত্র জানিয়েছে।
সীতাকুণ্ড থানা সদর থেকে গুলিয়াখালি সৈকতের দিকের রাস্তাটি সোজা সাগরপাড়ে গেছে। এই রাস্তার দুই পাশে প্রচুর বসতি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটি শতভাগ বিদ্যুতায়িত। কিন্তু প্রতিটি বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে ঝুলছে অসংখ্য বাঁশ। এসব বাঁশ প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। বাঁশের মাথায় তারের আংটা লাগিয়ে বিদ্যুৎ লাইনের সাথে সংযোগ দিয়ে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। এই তালিকায় শুধু গরিব মানুষ নয়, অনেক পাকা বাড়িতেও এভাবে অবৈধ বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, বিদ্যুৎ বিভাগের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে বিদ্যুৎ চুরি করছে মানুষ। শুধু সীতাকুণ্ড সদরের উক্ত এলাকায় নয়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার মানুষ এভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।
নগরীর বাকলিয়া এলাকায় পাঁচতলা একটি ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে চলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। রাতে-দিনে এসি চলে। তীব্র গরমে এসি চালানোর পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু বিলে কোনো হেরফের নেই। লাইনম্যানকে মিটার প্রতি এক হাজার টাকা পরিশোধ করা হলে বিল আসে ১ হাজার টাকার কম।
শুধু বাসাবাড়ির এসি নয়, নগরীতে চলাচলকারী হাজার হাজার বিদ্যুৎ নির্ভর গাড়িও চার্জ দেয়া হয় বিভিন্ন গ্যারেজে। এদের অধিকাংশেরই চোরা লাইন রয়েছে। মিটার বাইপাস করে নেয়া লাইনের পাশাপাশি লাইনম্যানকে ম্যানেজ করে মিটার ঘুরিয়েও বিদ্যুৎ চুরি করা হচ্ছে। দুয়েক মাস পরপর উক্ত মিটার রিডার রিডিং ঘুরিয়ে কমিয়ে দিয়ে যান, যাতে তল্লাশিতেও মিটারে কোনো রিডিং জমা না থাকে। এভাবে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার বিদ্যুৎ চুরি হয়; যেটি সিস্টেম লসের নামে জায়েজ করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ চুরির পাশাপাশি কোটি কোটি টাকার বিদ্যুতের অপচয় বর্তমানে সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অফিস এবং কর্মকর্তাদের বাসাবাড়িতে কোটি কোটি টাকার বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। কোন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অফিস বা বাসায় এসি ব্যবহৃত হবে তার একটি নীতিমালা থাকলেও তা লংঘিত হচ্ছে।
সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে সরকারি অফিস ও বাসাবাড়িতে বাছবিচার ছাড়াই এসি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিল সরকারি খাত থেকে দেয়া হয়। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ ব্যবহারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা স্যুট পরে অফিস করেন। তীব্র গরমের মাঝে তারা ১৬ থেকে ২০ ডিগ্রি টেম্পারেচারে এসি চালান, যা ২৬ ডিগ্রিতে চালালে অনেক বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতো। এসব প্রতিষ্ঠানের বিল সরকার প্রদান করে বিধায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাথাব্যথা দেখা যায় না।
এদিকে নগরীতে প্রি-পেইড করা হয়েছে এমন এলাকার গ্রাহকেরা বিদ্যুৎ ব্যবহারে হিসেবি হলেও যেখানে প্রি-পেইড মিটার নেই সেখানে অনেক গ্রাহক লাগামহীন বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। লাইনম্যানকে ম্যানেজ করার সুযোগ নিয়ে তারা বিদ্যুতের অপচয় ঘটান। শুধুমাত্র চুরি ও অপচয় ঠেকানো গেলে চট্টগ্রামে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে তার অন্তত ১০ শতাংশ সাশ্রয় করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
পিডিবির শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামে বর্তমানে দেড় হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে এই বিদ্যুতের যোগান দেয়া হচ্ছে। চড়া দামের বিদ্যুৎ কিনে সরকার ভর্তুকি দিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের প্রদান করলেও চুরি ও অপচয়ের কারণে অনেক উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে।
পিডিবি চট্টগ্রামের প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম গতকাল আজাদীকে বলেন, আমাদের ১৩৫০ থেকে ১৪০০ মেগাওয়াটের চাহিদা রয়েছে। আমরা ১০০ মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর লোডশেডিং পরিস্থিতি নির্ভর করবে। বিষয়টি এখনো কিছুটা আনস্টেবল রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝে লোডশেডিংয়ের সিডিউল ঠিক করতে হবে।
উল্লেখ্য, গ্যাস সংকটে চট্টগ্রামের গ্যাসচালিত চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি বন্ধ রয়েছে। একই সাথে সরকার ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।