চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বা সংক্ষিপে সিআইইউ’র যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে, তৎকালীন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ বা আইইউবি’র শাখা ক্যাম্পাস হিসাবে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং শিক্ষানুরাগীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও নিরলস পরিশ্রমের ফসল আজকের এই সিআইইউ।
ইএসটিসিডিটি হচ্ছে প্রথম ও প্রধান গভর্নিং বডি যার অধীনে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ আইইউবি এবং বোর্ড অব ট্রাস্টিজ সিআইইউ পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সিআইইউকে একটি স্বাধীন ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে যাত্রা শুরু করার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়। ১৯৯৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর এই প্রতিষ্ঠান আইইউবি’র অধীনে পরিচালিত হতো। সিআইইউতে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল শিক্ষার যাত্রা শুরু সেই ১৯৯৯ সাল থেকে। তখন আইইউবি’র স্কুল অফ কমিউনিকেশন অনুষদের অধীন কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক প্রোগ্রাম দিয়ে যাত্রা শুরু হয়।
পরবর্তীতে ইলেকট্রনিক ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টি যুক্ত করা হয় স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কম্পিউটার সায়েন্স অনুষদের অধীনে। যুগের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনা করে ২০২৩–২০০৪ সাল হতে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিষয়ে ৪ বছর মেয়াদী স্নাতক প্রোগ্রাম চালু করা হয়। সিআইইউ পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে যাত্রা শুরু করার পর থেকে কম্পিউটার সায়েন্স, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রনিক ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিগ্রি প্রদান করে আসছে, যা চট্টগ্রামের প্রকৌশল শিক্ষায় গুণগত মান এবং প্রকৃত অর্থে প্রকৌশলী সমাজ গঠনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে সিআইইউ’র অনেক গ্র্যাজুয়েট প্রকৌশলী দেশ ও বিদেশে অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা প্রকৌশলীরা অনেক বহুজাতিক কোম্পানি, শিল্প–কারখানা, সরকারি, আধা–সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার সমন্বয়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে যাচ্ছে। সিআইইউ’র প্রকৌশল অনুষদ হতে পাস করা স্নাতক ডিগ্রিধারীরা উচ্চশিক্ষার জন্য উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে স্ব–স্ব পেশায় বর্তমানে নিয়োজিত রয়েছেন। কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী এখনও বিভিন্ন নামকরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল–ব্রাইট–স্কলারশিপসহ অধ্যয়নরত রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিষ্ঠান হতে পাস করা গ্রাজুয়েটদের মধ্যে অধিকাংশই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করে থাকেন, যার মধ্যে প্রকৌশলীর সংখ্যা চল্লিশ শতাংশেরও বেশি। এখনকার যুগে প্রকৌশল শিক্ষার ধরণ অনেকটা ভিন্ন। আউটকাম বেইজড এডুকেশন হচ্ছে এই শিক্ষার মূলনীতি। এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বাস্তব জ্ঞানের বিষয়ে মনোযোগী করা এবং তাদের মধ্যে সৃজনশীলতা, চিন্তা–শক্তির প্রসারতা প্রজ্ঞা ও দক্ষতার ব্যাপ্তি ঘটানো। সিআইইউতে আউটকাম বেইজড এডুকেশন কারিকুলামে কোর্স চালু হয়েছে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। শিক্ষার্থীদের এই কারিকুলাম অনুযায়ী ১৬০ ক্রেডিট সম্পন্ন করতে হবে চার বছরে। প্রকৌশল শিক্ষার সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়নের সময় দেশি–বিদেশি অধ্যাপক ও প্রকৌশলী–সমাজের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যাতে করে আগামী প্রজন্মের প্রকৌশলীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জসমূহকে মোকাবেলা করতে পারে।
আধুনিক সিলেবাসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সায়েন্স, মেশিন লার্নিং, সাইবার সিকিউরিটি, সফটওয়্যার প্রকৌশল এবং সর্বোপরি নবায়ানযোগ্য শক্তি ও বৈদ্যুতিক যানবাহন সম্পর্কিত কোর্সসমূহকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দেশি–বিদেশি নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যাতে করে একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করা যায়। বর্তমানে একদল পিএইচডি ডিগ্রীধারীসহ নবীন–প্রবীণের সমন্বয়ে একটি শিক্ষক প্যানেল নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বিশ্বমানের প্রকৌশলী তৈরি করার লক্ষ্যে। তাছাড়া বিভিন্ন উচ্চতর জটিল বিষয়গুলোতে পাঠদানের জন্য নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অধ্যাপকদের অতিথি শিক্ষক হিসাবে প্রতিনিয়ত নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞানকে মজবুত করার জন্য বিভিন্ন বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এঙপার্টদের আমন্ত্রণ করা হয়ে থাকে, যাতে করে তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং বাস্তব জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে পারে। প্রকৌশল শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ল্যাবরেটরি এবং সাথে সাথে আধুনিক সুবিধা সম্পন্ন যন্ত্রপাতি ও উচ্চগতি সম্পন্ন কম্পিউটার সিস্টেম। বর্তমানে সিআইইউ’তে উন্নতমানের এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ ল্যাবরেটরি সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রোগ্রামিং ল্যাব, নেটওয়ার্কিং ল্যাব, মাল্টিমিডিয়া ল্যাব, ইলেকট্রনিঙ ল্যাব, কমিউনিকেশন ল্যাব, এনার্জি কনভার্সন ল্যাব, পাওয়ার সিস্টেম ল্যাব, রোবটিঙ ল্যাব এবং রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাব ইত্যাদি। এছাড়া সকল শিক্ষার্থীর সার্বক্ষণিক প্রিন্টিং সুবিধাসহ জেনারেল কম্পিউটার ল্যাব রয়েছে, যেখানে ছাত্র–ছাত্রীরা ক্লাস চলাকালীন অ্যাসাইনমেন্ট, ল্যাব রিপোর্ট, প্রজেক্ট তৈরি করা, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি কাজ তাদের সময়–সুযোগ মত করতে পারে। বর্তমানে সিআইইউ’র বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের অধীনে ছাত্র–ছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত চারটি ক্লাব আছে যারা বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা ও পাঠক্রম বহির্ভূত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এই ক্লাবগুলো হচ্ছে সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাব, প্রোগ্রামিং ক্লাব, রোবটিঙ ক্লাব এবং আইইইই স্টুডেন্ট ব্রাঞ্চ। শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নের জন্য সিআইইউ কর্তৃপক্ষ সবসময় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। বিভিন্ন যুগোপযোগী ও আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণার জন্য সিআইইউ শিক্ষক ও ছাত্র–ছাত্রীদের গবেষণা প্রণোদনা দিয়ে থাকে। বর্তমানে সিআইইউ’র সিএসই ও ইইই বিভাগের ছাত্র–শিক্ষক সমন্বয়ে বিভিন্ন গবেষণা দল আছে যারা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, রোবটিঙ এবং নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির উপর নিয়মিত গবেষণা করে যাচ্ছে এবং গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন দেশি–বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে।
শুধুমাত্র শিক্ষকরা নয়, ছাত্র–ছাত্রীরাও বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার, কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপের যোগদানসহ অনেক ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকে। এখানকার ছাত্র–ছাত্রীরা নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, প্রোজেক্ট শোকেজিং, রোবোরেইসসহ বিভিন্ন ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তাদের মেধা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। সমপ্রতি ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীন একটি ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছে যার নাম আইআইটিআইআর। এই ইনস্টিটিউটের অধীনে সিআইইউ’র ছাত্র–ছাত্রীরা এবং বাইরের থেকে আগত পেশাজীবীরা বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। এই ইন্সিটিউট প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বাস্তব ও প্রায়োগিক শিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া যাতে করে তারা চাকুরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। বর্তমানে এই ইনস্টিটিউটের অধীনে পিএলসি, অ্যাডভান্সড পিএলসি, পাইথন প্রোগ্রামিং, এআই ও মেশিন লার্নিং ইত্যাদি বিষয়ের উপর শর্ট কোর্স চালু রয়েছে। তাছাড়াও এই ইনস্টিটিউট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কয়েকটি কোর্স পরিচালনা করে থাকে যাতে করে শিক্ষার্থীরা প্রায়োগিক জ্ঞানকে আরো সমপ্রসারিত করতে পারে। যেমন আইআইটিআইআর’র সাথে চুয়েট আইআইসিটি এবং স্কিলস জোনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ইন্ডাস্ট্রি উপযোগী কোর্স চালু রয়েছে। শেষে বলতে চাই বিশ্বমানের প্রকৌশলী তৈরির আঁতুড়ঘর হিসেবে চট্টগ্রামে সিআইইউ দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে অবদান রেখে চলেছে যা সত্যি প্রশংসনীয়। বাণিজ্য–নগরী চট্টগ্রামে সিআইইউ একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে সূচনা লগ্ন হতে অর্থাৎ ১৯৯৯ সাল হতে নর্থ আমেরিকান কারিকুলামের চর্চা রয়েছে, সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানটি বিগত ২৫ বছর ধরে আধুনিক, যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের শিক্ষায় বন্দর নগরীতে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম ও অর্জনের চাইতে এর ব্যাপ্তি ব্যাপক। সিআইইউ শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে একটি অগ্রগামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠান প্রকৌশল শিক্ষাসহ সকল শিক্ষায় একটি বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে এবং বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিবে। এই প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর সাফল্য ও সমৃদ্ধি হোক এই কামনা করি এবং বর্তমান উপাচার্যের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দূরদর্শী পরিকল্পনায় অতি শীঘ্রই এই প্রতিষ্ঠান তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে আশা করি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ, চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি