চট্টগ্রামে পুত্রবধূ খুঁজতে এসে যেভাবে প্রতারিত হলেন চীনা নাগরিক

হাবীবুর রহমান | রবিবার , ১০ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

চীন থেকে চট্টগ্রামে ভ্রমণে এসেছিলেন লিও লি। একইসঙ্গে মনে মনে ছিল, এখানকার কোনো মেয়েকে পুত্রবধূ করে নিয়ে যাবেন নিজ দেশে। এ নিয়ে পূর্ব পরিচিতি নেহেমিয়াহ শুয়ের মাধ্যমে চীনা বংশোদ্ভূত ও নগরীর খুলশীর বাসিন্দা ডেভিডের সঙ্গে কথা হয় তার। পাত্রী খুঁজে দেওয়া, বিবাহ সম্পাদন, পুত্রবধূকে চীনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভিসা, পাসপোর্টসহ পেপার ওয়ার্ক তৈরি করে দিবেন এমন আশ্বাস তাকে ডেভিডের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। এ জন্য ডেভিড ২০ লাখ টাকা দাবি করলে তাতে রাজি হন লিও লি। এরই ধারাবাহিকতায় দাবি করা টাকা পরিশোধ করলে লিও লি’র ছেলে চাও ইউজিয়ের জন্য একজন খ্রিস্টান পাত্রী খুঁজে বের করেন ডেভিড। পাত্রী নগরীর সাগরিকা এলাকার ম্যালিসা (ছদ্মনাম)। তাকে দেখেই পছন্দ করেন চাও ইউজিয়ে ও তার মা লিও লি। আয়োজন করা হয় বিবাহের। কিন্তু দেখা গেল, শুধু এনগেজমেন্ট হয়েছে। বিষয়টি বুঝতে পেরে লিও লি ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ বিবাহ সম্পন্নের কথা বলেন। ডেভিড তখন এনগেজমেন্টকে পূর্ণাঙ্গ বিবাহ হিসেবে তাকে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু লিও লি তা মানতে নারাজ। তিনি বারবার তাকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিবাহ সম্পন্নের অনুরোধ করেন। একপর্যায়ে ডেভিড ও তার সহযোগীরা মিলে প্রতারণার উদ্দেশ্যে বিবাহের নকল সনদপত্র প্রস্তুত করে তাকে সরবরাহ করেন। মৌখিক চুক্তি অনুযায়ী ভিসা, পাসপোর্টসহ পেপার ওয়ার্ক তৈরি করে দেওয়ার কথা থাকলেও তাও পাননি লিও লি। টাকা ফেরত চাইলে প্রথমে নানা বাহানা শুরু করেন ডেভিড। এরপর বলা হয়, চীনে ফিরতে দিবেন না। দেওয়া হয় লাশ গুম করে ফেলা হবেসহ প্রাণনাশের হুমকি। ডেভিডদের কাছ থেকে এভাবে প্রতারিত হয়ে কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে চীনা নাগরিক লিও লি চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত৫ এ গত ৩ মার্চ একটি নালিশি মামলা দায়ের করেছেন। আদালত তখন তার বক্তব্য শুনে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেন।

পিবিআই সেই মামলাটি তদন্ত করে সম্প্রতি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। দাখিলকৃত উক্ত তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চীন থেকে সখের বশে ভ্রমণ করতে এসে একজন বাংলাদেশী কন্যাকে ছেলের বধূ করে চীনে নিয়ে যেতে চাওয়া লিও লি’র প্রতারিত হওয়ার গল্প।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০ লাখ টাকায় পাত্রী খোঁজা, বিয়ে সম্পন্ন করা, পুত্রবধূকে চীনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভিসা, পাসপোর্টসহ পেপার ওয়ার্ক তৈরি করে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও পাত্রী খুঁজে বের করার কাজটি ছাড়া বাকি কাজ সম্পন্ন করেননি ডেভিড। বরং নকল কাগজপত্র তৈরি করে লিও লি’র সাথে প্রতারণা করেছেন। যেহেতু পুরো কাজ সম্পন্ন করেননি, সেহেতু টাকা ফেরত চাইলে তা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করা হয়। বাড়াবাড়ি করলে খুন করে লাশ গুম করে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা এবং পিবিআইয়ের এসআই আল আমিনের দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে মোট তিনজনকে আসামি করা হয়। তারা হলেন, ডেভিড ওয়াং, তার স্ত্রী নাজমা আক্তার চৌধুরী ও বোন লোইস ওয়াং। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ডেভিড ও তার বোন লোইস চীনা বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি নাগরিক। ১৯৪৯ সালে চাইনিজ সিভিল ওয়ারে ডেভিড, লোইস’র বাবা ওয়াং জং ছিও’র ন্যাশনালিস্ট পার্টি হেরে যায়। জয়লাভ করে কমিউনিস্ট পার্টি। এরপর ওয়াং জং ছিও’কে বহিষ্কার করা হলে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। বাংলাদেশেই ডেভিড ও লোইস জন্মগ্রহণ করেন।

লিও লি’র আইনজীবী মেজবাহ উল আলম দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন, লিও লি একজন নারী। তিনি চায়না নাগরিক। সখের বশেই তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ঢাকার বিমানবন্দর হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। চট্টগ্রামে এসে তিনি একজন বাংলাদেশী খ্রিস্টান কন্যাকে পুত্রবধূ করে চীনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সেটি আর সম্ভব হয়নি। খালি হাতেই তাকে চীনে ফেরত যেতে হয়েছে। আইনজীবী বলেন, লিও লি’র ছেলের সাথে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে তিনি অর্থাৎ ম্যালিসা এখন নগরীর সাগরিকাতেই রয়েছেন। শুধু এনগেইজমেন্ট হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ বিয়ে এখনো হয়নি। পূর্ণাঙ্গ বিয়ে হওয়ার পর এবং তার ভিসা, পাসপোর্টসহ পেপার ওয়ার্ক তৈরি সম্পন্ন হলে তারপর তাকে চীনে নিয়ে যাবেন লিও লি। মামলার ধার্য তারিখ থাকায় লিও লি গত পরশু (শুক্রবার) ফের চট্টগ্রাম এসেছেন বলেও জানান আইনজীবী মেজবাহ উল।

সূত্র জানিয়েছে, ডেভিডরা নগরীর খুলশীতে থাকেন। লিও লি’র মতো আরো অনেকে ডেভিডের কাছে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। চীনে পাঠানোর নাম করে তিনি এসব প্রতারণা করেছেন। বেশ কিছুদিন আগে প্রতারণার অভিযোগে খুলশী থানা পুলিশের হাতে তিনি আটকও হয়েছিলেন।

চট্টগ্রামের মেট্রাপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত৫ এর বেঞ্চ সহকারী নূরে খোদা দৈনিক আজাদীকে বলেন, পিবিআইয়ের দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ডেভিড, তার স্ত্রী নাজমা ও বোন লোইস এর বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন বিচারক।

আদালতসূত্র জানায়, পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, লিও লি গত বছরের ২৫ এপ্রিল চীন থেকে বাংলাদেশে তথা চট্টগ্রাম আসেন। তখন পূর্ব পরিচিত নেহেমিয়াহ শুয়ে তাকে রিসিভ করেন। নেহেমিয়াহ শুয়ে’কে তিনি জানান, লিও লি তার ছেলে চাও ইউজিয়ের সাথে একজন বাংলাদেশী কন্যাকে বিয়ে দিতে চান। এ কথা শুনে নেহেমিয়াহ শুয়ে তার সাথে ডেভিডের পরিচয় করিয়ে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় লিও লি তার ছেলের বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে ডেভিডের সাথে কথা বলেন। ডেভিড আশ্বাস দেন যে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে চাও ইউজিয়ে’র জন্য বাংলাদেশী একজন খ্রিস্টান পাত্রী খুঁজে বের করবেন। এ জন্য তাকে দিতে হবে ১৫ লাখ ১১ হাজার ৪৩৩ টাকা। এই প্রস্তাবে রাজি হন লিও লি। এর মধ্যে ডেভিড তার স্ত্রী ও বোনের সাথে লিও লি’র পরিচয় করিয়ে দেন। তখন ডেভিডের স্ত্রী ও বোন উক্ত কাজের জন্য আরো ৪ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ১৯ লাখ ১৭ হাজার ৫৬৬ টাকা দাবি করে বসেন। লিও লি এ প্রস্তাবেও রাজি হন। তার ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার যাবতীয় খরচাদিসহ পুত্রবধূর ভিসা, পাসপোর্ট ইত্যাদি কার্য সম্পাদনের জন্য ডেভিড এবং তার স্ত্রী ও বোন গত বছরের ১৮ মে ৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা গ্রহণ করেন। একই তারিখে চাও ইউজিয়ের বিয়ের জন্য একজন খ্রিস্টান পাত্রী দেখানো হয়। লিও লি ও ছেলে চাও ইউজিয়ে উক্ত পাত্রীকে পছন্দ করলেও ডেভিডের কারণে ওই পাত্রীর সাথে চাও ইউজিয়ে’র বিবাহ হয়নি। যার প্রেক্ষিতে লিও লি তার দেওয়া ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৩৪০ টাকা ফেরত চান। তখন ডেভিডরা টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করেন এবং এর চেয়ে আরো ভাল পাত্রীর সাথে চাও ইউজিয়ে’র সাথে বিবাহ দিবেন মর্মে লিও লি’কে আশ্বস্থ করেন। পরবর্তীতে ডেভিডরা ম্যালিসা নামের অপর একজন খ্রিস্টান পাত্রীকে খুঁজে বের করেন এবং লিও লি ও তার ছেলেকে দেখানোর ব্যবস্থা করেন। লিও লি ম্যালিসাকে দেখে পছন্দ করলে ডেভিডরা লিও লি’র কাছ থেকে গত বছরের ২১ জুলাই ৪৬ হাজার ৬৬৮ টাকা এবং একই বছরের ২৫ জুলাই ৫ লাখ ২৩২ টাকা গ্রহণ করেন। এর তিনদিন পর অর্থাৎ ২৯ জুলাই ম্যালিসার সাথে চাও ইউজিয়ে’র সাথে এনগেইজমেন্ট সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে লিও লি ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিবাহ সম্পন্ন করতে ডেভিডদের অনুরাধ করেন। চীনা নাগরিক হওয়ায় ডেভিডরা এনগেইজমেন্টকে পূর্ণাঙ্গ বিবাহ হিসেবে লিও লি’কে মিথ্যা তথ্য প্রদান করেন। কিন্তু লিও লি বারবার তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিবাহ সম্পন্নের জন্য অনুরোধ করলে ডেভিডরা প্রতারণার উদ্দেশ্যে নোটারীকৃত আনরেজিস্ট্রার্ড হলফনামা এবং বিবাহ সংক্রান্তে নকল সনদপত্র তৈরি করে লিও লিকে (মামলার বাদীনি) সরবরাহ করেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, লিও লি তার পুত্রবধূ ও পুত্রবধূর বাবা এবং চাচার ভিসা পাসপোর্ট ও নতুন পুত্রবধূকে চীনের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবেন বলে ডেভিডরা লিও লি’র কাছ থেকে গত বছরের ৫ আগস্ট পুনরায় নগদে ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৯১৩ টাকা গ্রহণ করেন। সবমিলে ডেভিডরা লিও লি’র কাছ থেকে দফায় দফায় ১৯ লাখ ৬৬ হাজার ১৭৩ টাকা গ্রহণ করেন। এরমধ্যে পেপার ওয়ার্ক বাবদ নেওয়া হয় ১৪ লাখ ১৯ হাজার ২৫৩ টাকা এবং বিবাহের খরচের জন্য নেওয়া হয় ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯২০ টাকা।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ডেভিডরা বিয়ের খরচের জন্য ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯২০ টাকা গ্রহণ করলেও তারা ওই টাকা খরচ করেননি। যা তারা স্বীকারও করেছেন। এমন প্রেক্ষিতে লিও লি খরচের অবশিষ্ট টাকা ফেরত চেয়েও পাননি। এছাড়া লিও লি’র পুত্রবধূর চীন চাওয়ার জন্য পাসপোর্ট ফি, ভিসা ফি ও স্টুডেন্ট ফিসহ সকল কাগজপত্র সম্পন্নের জন্য সর্বমোট ১৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫৩ টাকা গ্রহণ করলেও ডেভিডরা উক্ত কাজ করেননি। লিও লি বারবার কাজ সম্পন্নের জন্য তাগাদা দিলেও ডেভিডরা তাকে ঘুরাতে থাকেন। একপর্যায়ে লিও লি চীনে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি পুত্রবধূকে চীনে নিয়ে যেতে পুনরায় বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশে আসার পর তিনি ডেভিডদের সাথে সাক্ষাৎ করে পুত্রবধূকে চীনে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট ফি, ভিসা ফি ও স্টুডেন্ট ফিসহ সকল কাগজপত্র প্রস্তুতের বিষয়ে জানতে চাইলে ডেভিডরা কোনো সদুত্তর প্রদান করেননি। তখন লিও লি টাকা ফেরত চাইলে ডেভিডরা টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন এবং উক্ত টাকা পুনরায় দাবি করলে লিও লিকে বাংলাদেশ থেকে যেতে দেবেন না এবং খুন করে লাশ গুম করে ফেলবেন বলে হুমকি দেওয়া হয়। পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রতারণার মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করে তা ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করা এবং খুন করে লাশ গুম করে ফেলার হুমকি দিয়ে ডেভিড, তার স্ত্রী নাজমা ও বোন লোইস ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০/৫০৬()/৩৪ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাউজানে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় খন্দকার গ্রুপের মামলা, আসামি ১২৯
পরবর্তী নিবন্ধএনসিপি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সমন্বয় কমিটি ঘোষণা