চট্টগ্রামে নারী প্রগতির চার অনন্যা

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | বুধবার , ২৬ জুন, ২০২৪ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক বিচার নয়, বাঙালি বিবেচনায় চট্টগ্রামে নারী প্রগতির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করলে আমরা দেখব শতাধিক বছরের শেষে চারজন নারী জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে তিনজন সংরক্ষিত আসনের এমপি এবং একজন সাধারণ আসন থেকে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত এমপি। সংরক্ষিত আসনের ৩ এমপি হচ্ছেনওয়াসিকা আয়শা খান এমপি, শামীমা হারুন লুবনা এমপি ও দিলোয়ারা ইউসুফ এমপি। সাধারণ আসনে নির্বাচিত এমপি হচ্ছেনখাদিজাতুল আনোয়ার সনি এমপি। ওয়াসিকা ও শামীমার বাবারাও সাংসদ ছিলেন। ওয়াসিকার বাবা আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৭০ সালে এমএনএ নির্বাচিত হন এবং শামীমার বাবা আবদুল্লাহ আল হারুন একই বছর এমপিএ নির্বাচিত হন। খাদিজাও এমপিকন্যা, তবে তাঁর বাবা রফিকুল আনোয়ার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন স্বাধীনতার পর, ১৯৯৬ সালে, যেবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম সরকার গঠন করেন।

ওয়াসিকা শামীমা আনোয়ারা ও রাউজানের দু’টি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের গর্বিত সন্তান। ওয়াসিকার দাদা, বাবা, নানা ও মামা সংসদ ছিলেন। দাদা এয়ার আলী খান (পেচু মিয়া) ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাবা আতাউর রহমান কায়সার স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা এবং ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচিত এম এন এ ছিলেন। নানা খান বাহাদুর আবদুচ ছত্তার ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। এ ছাড়া তিনি চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান, মামা জামালুচ ছত্তার ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে এম এন এ নির্বাচিত হন। তবে ঐ নির্বাচনে তাঁর পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাডভোকেট বদরুল হক খান নির্বাচনী ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেন এবং ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি রায় পান। সে বছর উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বদরুল হক খান নির্বাচিত হন।

ওয়াসিকার মা নীলুফার কায়সারও একজন উচ্চ শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এই নারী নিজেকে রাজনীতি, নারী সংগঠন ও আন্দোলন এবং সমাজমঙ্গলকর্মে উৎসর্গ করেছিলেন। আতাউর রহমান কায়সারের সঙ্গে তাঁর বিবাহিত জীবন সোনায় সোহাগা হয়েছিলেন। স্বামীস্ত্রী উভয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজ জীবনকে অনেক কিছু দিয়েছিলেন। ওয়াসিকা নিজেও ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে আসছেন। কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ছাত্রলীগের সদস্য হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

পিতামাতা সার্বক্ষণিক রাজনীতি করতেন এ কারণে ওয়াসিকা অধ্যয়ন শেষে আর সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পিতার অকাল মৃত্যুতে তাঁর সুপ্ত রাজনৈতিক চেতনা জেগে ওঠে, তিনি আবার সক্রিয় রাজনীতি আরম্ভ করেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁকে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিকল্পনা সম্পাদক পদের জন্য যোগ্য বিবেচনা করে উক্ত পদ প্রদান করে সম্মানিত করেন। তাঁর পিতাও এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

শামীমা হারুন লুবনা চট্টগ্রামের একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবারের উজ্জ্বল রত্ন। তাঁর বংশে তিনজন এমপি ছিলেন। তাঁর পিতা আবদুল্লাহ আল হারুন, খালু জহুর আহমদ চৌধুরী এবং চাচা আবদুল্লাহ আল নোমান। তাঁর পিতা ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এমপিএ নির্বাচিত হন। তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এমএ আজিজের পরেই ছিল তাঁর স্থান। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাকশালের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেছিলেন।

শামীমার চাচা আবদুল্লাহ আল নোমানও একজন সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হন। জহুর আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী ডা. নুরুন্নাহার জহুর শামীমার খালা। জহুর আহমদ চৌধুরী ১৯৫৪, ১৯৭০ ও ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে সংসদ সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ও একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী তাঁর ফুফা। আবার মাহবুব উল আলম চৌধুরী ওয়াসিকার স্বামীর ফুফা, জওশন আরা রহমানের স্বামী। এদিক থেকে ওয়াসিকা ও শামীমা, দু’জনের মধ্যে একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করা যায়। শামীমা বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে দীর্ঘ এক যুগ ধরে দায়িত্ব পালন করছেন দলের তৃণমূল থেকে উঠা আসা নেত্রী দিলোয়ারা ইউসুফ। ২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এই পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দলের ‘কঠিনদুঃসময়ে’ একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এই সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে উত্তর জেলায় দলের প্রার্থীদের বিজয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন মহিলা আওয়ামী লীগের এই নেত্রী।

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডে বারবার নির্বাচিত সদস্য দিলোয়ারা ইউসুফ বর্তমান মেয়াদেও রাউজান, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও চসিক (আংশিক) ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন। এই ওয়ার্ডে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

খাদিজাতুল আনোয়ার সনির পিতা রফিকুল আনোয়ার ফটিকছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ক্রমশ ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একজন বিশিষ্ট নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

তিনি একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন৬ থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রাম২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

চট্টগ্রামের এই চারজন নারীর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, নারী সমাজের অগ্রগতির পথে এক ধাপ উত্তরণ। সংসদ সদস্য পদে নারী আগেও নির্বাচিত হয়েছেন। যেমন হাসিনা মান্নান, সাবিহা মুসা, চেমন আরা তৈয়ব, কামরুন্নাহার জাফর, জিনাত হোসেন। কিন্তু এবারের মতো আর কাছাকাছি বয়সের তারুণ্যের দীপ্তিতে ভরপুর এক গণ্ডা নারী কখনও এমপি হননি। এটি শেখ হাসিনারই কৃতিত্ব। তিনি নারী হয়ে যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখন থেকে তিনি সামাজিক অগ্রগতির ধারায় নারীকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে চেষ্টা চালিয়েগ যাচ্ছেন। তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সম্পাদক আরেক নারী সাজেদা চৌধুরীকে কখন মন্ত্রী, কখনো সংসদের উপনেতা, নারী ড. শিরিন শারমিন চৌধুরীকে সংসদের স্পিকার, বেগম মতিয়া চৌধুরী (বর্তমানে সংসদের উপনেতা), ডা. দীপু মণি, মেহের আফরোজ চুমকি, সিমিন হোসেন রিমিকে পূর্ণমন্ত্রী এবং অভিনেত্রী তারানা হালিমকে প্রতিমন্ত্রী করে তাঁর সরকারকে নারী প্রাধান্যের সরকার হিসেবে পরিচিত করেছেন। ওয়াসিকাকে যা করেছেন, একজন পুরুষকেও সে পদে নিযুক্ত করতে গেলে দু’বার ভাবতে হত। ওয়াসিকা ব্যাংকার ছিলেন, অর্থনীতি ভালো বোঝেন, ছাত্রজীবনে মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তাঁকে যে অর্থপ্রতিমন্ত্রী করেছেন, সেটা যোগ্য পাত্রেই অর্পণ করেছেন শেখ হাসিনা।

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার যখন ভারত শাসন আইন পাস করে, তখন নারীর ভোটাধিকারও ছিলো না। শামসুন্নাহার মাহমুদ ‘নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলন’এর পক্ষ থেকে নারীর ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু করলে নারীর ভোটাধিকার আইন পাস হলো। এর ফলে নারীপুরুষের ভোটে নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদে বসে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে যুক্তবঙ্গের শেষ বিধান সভা নির্বাচনে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম নেলী সেনগুপ্তা এবং বিপ্লবী কল্পনা দত্ত (যোশী) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সেটা ছিলো পৃথক নির্বাচন, নেলী সেনগুপ্তা বিজয়ী হন। একই বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন বিপ্লব বীণা দাস (ভৌমিক)। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আজিম ব্যারিস্টারের পত্নী তোহফাতুন্নেছা আজিম এম এল এ নির্বাচিত হন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে শামসুন্ন্নাহার মাহমুদ এবং মিনিস্টার সুলতান মিয়ার কন্যা নূরজাহান এম এন এ নির্বাচিত হন।

নারীও যে মানুষ, মানবজাতির অর্ধাংশ, এক সময় সেটা মনে করা হতো না। নারী তখন পর্দার অন্তরালে ছিলো, পিতা অথবা স্বামীর গৃহকোণই ছিল তাঁদের একমাত্র ঠিকানা। বেগম রোকেয়া প্রথম অবরোধবাসিনী নারীকে উন্মুক্ত প্রান্তরে বেরিয়ে আসার আহবান জানানোর পর থেকে জনসমাজে নারীর দেখা মিললো। জন্মের পর নারী পিতৃগৃহে বেড়ে উঠতে উঠতে সাবালিকা হওয়ার পূর্বেই এক হাত ঘোমটা দিয়ে পালকি চড়ে সেই যে স্বামীগৃহে প্রবেশ করতে, মৃত্যুর পূর্বে সফেদ কাফনে আবৃত হয়ে তার মৃত্যুদেহটাই শুধু বের হতো এবং মাটির নিচে কবরে চলে যেত।

শ্বশুরবাড়ির অন্তঃপুরে নারীর কাজ ছিলো কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে স্নান করে ঘরদোর ঝাড়ু দিয়ে সাফসুতরো করে শ্বশুরশাশুড়ি, দেবরননদ, বাচ্চাদের জন্য জলখাবার তৈরি করে পরিবেশনের পর বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে স্বামীর কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা; স্বামী তৈরি হলে তাকে ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে নারীর দিন শুরু হত। তারপর আবার দুপুরের রান্নাবান্না, কাপড় কাঁচা এবং সকলকে খাইয়ে নিজে সবার শেষে খেয়ে এঁটো বাসনকোসন, পেয়ালা, হাড়িপাতিল, ডেকচি ধুয়ে মুছে নারীর ফুরসৎ মিলতো। তখন ঘরের দাওয়ায় অথবা উঠানে কখনও শাশুড়ি অথবা ননদের চিরুনী দিয়ে চুল আঁচড়ে উকুন বেছে, দুপুরে বিছানায় একটু গড়াগড়ি। সে সময় বুকে বালিশ চাপা দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আগে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস বর্তমানে হুমায়ুন আহমদের উপন্যাস নিয়ে নারীর অলস মধ্যাহ্ন অতিবাহিত হতো অথবা একুট, ভাত হত রাতে আবার রান্নাবান্না করে সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে সবার শেষে নিজে দু’মুঠো মুখে দিয়ে ঘুমানোর জন্য শয্যাপাতা। তখন নারী হালকা প্রসাধন সেরে স্বামী দেবতার কাছে নিজেকে নিবেদন করার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকতো। নারী তখন পুরুষের ভোগের সামগ্রী হয়ে উঠতো।

নারীর দিবসরজনী অষ্টপ্রহর ক্লান্তিকর জীবনযাত্রার একঘেঁয়েমি থেকে মুক্ত করে প্রথম বাইরে বের করে আনার কৃতিত্ব বেগম রোকেয়ার। তিনিই প্রথম মুসলিম নারী সমাজের অচলায়তন ভেঙে বহির্জগতে বের করে এনে বৃহত্তর মানব সমাজের খোলা হাওয়ায় মুক্তির আস্বাদ নেবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেই যে নারী প্রগতি সূচিত হলো, তারপর কেটে গেছে বহু সময়, অনেক বছর এবং একটি শতাব্দীও; এর মধ্যে বহুজনের সাধনায় নারী পুরুষের সমকক্ষতা দাবি করার অবস্থায় উপনীত হলো। নজরুল লিখলেন– “এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”

অবশ্য বেগম রোকেয়ার আগে লাকসামে হোমনাবাদ পরগণার জমিদার ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী, যাঁকে মহারাণী ভিক্টোরিয়া নওয়াব উপাধি দিয়েছিলেন, তিনি গৃহ শিক্ষকের কাছে আরবি, ফার্সি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা শিখে আলোকিত জগতের সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনি বেগম রোকেয়ার জন্মের সাত বছর পূর্বে ১৮৭৩ কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে একটি অবৈতনিক আবাসিক মাদ্রাসাও স্থাপন করেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যা করেছিলেন, বেগম রোকেয়া সেটা গোটা বাঙালি সমাজের জন্য করেছিলেন। বেগম রোকেয়ারটা ছিলো সামাজিক আন্দোলন।

বেগম রোকেয়ার আন্দোলনের ফল হয়েছিলো এই, আমরা একজন শামসুন্নাহার মাহমুদকে পেলাম। নাহারের একজন ভাই ছিলো, বাহারহবীবুল্লাহ বাহার, রেয়াজুদ্দিন বাজার তামাকুমণ্ডির পাশে নানার বাসভবন আজিজ মঞ্জিলের বিপরীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের ছাত্র বিপ্লবী অনন্ত সিং ও গণেশ ঘোষের বন্ধু, বিখ্যাত ফুটবলার এবং তিনবার বা পাঁচবার আইএফএ শীল জয়ী কলকাতা মোহামেডামের ক্যাপ্টেন এবং ৪৭উত্তর পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বাহার ও নাহারের নানা ছিলেন চট্টগ্রামে শিক্ষাবিস্তারের পথ প্রদর্শক খান বাহাদুর আবদুল আজিজ বি..। তিনি নোয়াখালীর মানুষ হলেও চট্টগ্রামে স্কুল পরিদর্শক হিসেবে সারা জীবনই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। রেয়াজুদ্দিন বাজারের অধুনালুপ্ত আমতলায় তিনি একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন থাকার জন্য। তাঁর বাড়ির নাম ছিল ‘আজিজ মঞ্জিল’। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম দু’বার ‘আজিজ মঞ্জিল’এ পদধূলি দিয়েছিলেন। হাবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন্নাহার মাহমুদ তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। দু’ভাইবোন ‘বুলবুল’ নামে উচ্চমানের একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করেছিলেন।

শামসুন্নাহার মাহমুদ খাস্তগীর স্কুলে পড়তেন। তিনি যখন খাস্তগীরের ছাত্রী, তখন ফিরিঙ্গীবাজারের খান বাহাদুর আবদুর রহমান দোভাষের দু’মেয়ে আমেনা ও জামেনাও তখন খাস্তগীরে পড়তেন। তাঁদেরকে স্কুলে আনা নেওয়ার জন্য দোভাষ সাহেব একটি গাড়ি কিনেছিলেন। মেয়ে হওয়ার কারণে শামসুন্নাহার মাহমুদের ভাগ্যে যেটা ঘটেছিলো, সেটা খুব মর্মান্তিক। তাঁকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠার পরে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। যেদিন তিনি স্কুল থেকে বিদায় নিচ্ছেন, সেদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষয়ত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্কুল ছাড়ছো কেন? তুমি তো পড়াশোনায় খুব ভালো।” তখন শামসুন্নাহার মাহমুদ উদগত অশ্রু চেপে যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটি শুনে এখনো আমরা অশ্রু চেপে রাখতে পারি না। তিনি বলেছিলেন, ‘বড় হয়ে গেছি যে’। শামসুন্নাহার মাহমুদের জীবন থেকে আমরা বুঝতে পারি তখন বাংলার নারীর জীবন কেমন ছিলো। তিনি বাড়িতে যে গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়তেন, তাঁকেও তার দেখা দেওয়া বারণ ছিলো। পড়ার টেবিলের মাঝখানে পর্দা টাঙিয়ে এক পাশে ছাত্রী এবং আরেক পাশে শিক্ষক বসতেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯২১২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ছাত্রীরা ভর্তি হতে পারতো না। পরে প্রথম ছাত্রী হিসেবে যিনি ভর্তি হলেন, তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার কে সি দে’র কন্যা। কে সি দে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন। চট্টগ্রাম পৌরসভা তাঁর নামে চট্টগ্রাম মহানগরের কে সি দে রোড নামকরণ করেছে।

এই হলো মুসলিম সমাজের কথা। হিন্দু সমাজের অন্তঃপুরে উনবিংশ শতাব্দিতেই আলো ঢুকে পড়ে। কলকাতায় ঠাকুর পরিবারই ছিলো প্রথম আলোর যাত্রী। তবে হিন্দু সমাজের অবস্থা ছিলো আরো করুণ।

চট্টগ্রামে উনবিংশ শতাব্দিতে চারজন আলোকিত নারীকে পাচ্ছি। দু’জন হচ্ছেনউনবিংশ শতাব্দিতে চট্টগ্রামী রেনেসাঁর প্রবর্তক সুচক্রদণ্ডী নিবাসী ডা. অন্নদা চরণ খাস্তগীরের দু’কন্যা মোহিনী খাস্তগীর ও কুমুদিনী খাস্তগীর; অপর দু’জন হচ্ছেনডা. রামকিনু দত্তের পৌত্রী হেমন্তবালা দত্ত, আরেকজন চট্টগ্রামের সর্ববিধ উন্নতিকর কর্মের পুরোহিত কমলাকান্ত সেনের কন্যা চপলবালা গুহ। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো চট্টগ্রামের কিংবদন্তী আইনজীবী চক্রশালা নিবাসী মহিমচন্দ্র গুহের পুত্রের সঙ্গে।

চট্টগ্রামে নারীর কলকাকলিতে উনবিংশ শতাব্দির তমশা ভেদ করে বিংশ শতাব্দির আলোকিত প্রহর সূচিত হয়। ইতিমধ্যে আমরা বলেছি শামসুন্নাহার মাহমুদ বিংশ শতাব্দীর ভোরের সানাই। তারপর নারী বিপ্লবীরা গুলি, বোমা ফাটিয়ে বিশ শতকের প্রথম চার দশকের চট্টগ্রামে বিপ্লবের অগ্নিমশাল জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। চট্টলভূমিপুত্রদের অতি পরিচিত এই বীরকন্যারা রূপকথার নায়িকা হয়েই চিরজীবী হয়ে আছেন। সারোয়াতলী নিবাসী আচার্য বেনীমাধব দাশের জ্যেষ্ঠ কন্যা কল্যাণী ভট্টাচার্য্যের কথা প্রথমেই বলতে হয়। ছাত্রী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তারপর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত ও কল্যাণীর ছোটবোন বীণা দাস (ভৌমিক) এর বিপ্লব। এর মধ্যে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে ইংরেজ দুহিতা নেলী (গ্রে) সেনগুপ্তা কর্ণফুলীর পাড়ের নারী প্রগতিতে টেমস নদীর তরঙ্গ উৎপন্ন করেন। প্রাতঃস্মরণীয় নূর আহমদ চেয়ারম্যান ১৯২৯ সালে অবৈতনিক প্রাথমিক বালিকা শিক্ষা প্রবর্তন করেন। সে বছরই বাঁশখালীর প্রফেসর খলিলুর রহমানের স্ত্রী সৈয়দা আম্বিয়া খাতুন চন্দনপুরায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কিন্তু পরে সেটা চালাতে গিয়ে মুস্কিলে পড়ে এমদাদ দারোগার পুত্র খান বাহাদুর ফজলুল কাদেরের শরণাপন্ন হন। তিনি তাঁর বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে বালিকা বিদ্যালয প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর স্ত্রী গুলজারের নামে স্কুলের নামকরণ করেন গুলজার বেগম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। ১৯৩০ সালে পেস্তারপাড়ের বিদূষী নারী আছমা খাতুন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে নিজেই তাঁর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে একজন নারীকে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে পাওয়া যায়। তিনি হচ্ছেন চকরিয়ার কাকারা নিবাসী সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ভাষাতত্ত্ববিদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর স্ত্রী সুফিয়া খাতুন, পত্রিকার নাম ‘আন্নেষা’। একজন বৌদ্ধ নারীও বিলেত যান। তিনি হচ্ছেন বৌদ্ধ রেনেসাঁর অগ্রদূত নাজির কৃষ্ণ চন্দ্র চৌধুরীর প্রপৌত্রী, সাহিত্যিক জ্যোতির্মালা দেবী। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিলেত যান এবং লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে পিএইচডি করেন। তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলো-‘বিলাত দেশটা মাটির’।

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের আরও একজন নারী বাঁশখালীর প্রফেসর খলিলুর রহমানের কন্যা ড. ফাতেমা সাদেক লন্ডন গিয়ে পিএইচডি করেন। ৫০এর দশকে আর একজন নারী আর্ট পড়ার জন্য লন্ডনে যান, তিনিও বাঁশখালীর অধিবাসী, ভাস্কর নভেরা আহমদ। তিনি শেষ পর্যন্ত বিদেশেই থেকে যান, লন্ডন থেকে পরে তিনি শিল্পসংস্কৃতির ‘মক্কা’ প্যারিসে চলে যান। গত শতকের চল্লিশপঞ্চাশের দশকে আরো চারজন নারী সাহিত্য চর্চার জন্য চট্টগ্রামে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনজন কাজেম আলী মাস্টারের পৌত্রী শামসুন্নাহার, আইনুন্নাহার ও নুরুন্নাহার এবং লোকমান খান শেরওয়ানীর পত্নী শবনম খানম শেরওয়ানী (শিশির কণা গুহ)। শবনম খানম শেরওয়ানী সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি শিক্ষকতাও করতেন।

পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতকে আলোকিত করে বেশ ক’জন নারীকে সদর্পে বিচরণ করতে দেখা যায় তাঁরা হচ্ছেনআরতি দত্ত, কল্যাণী সেন, ভাষা সংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দী ও জওশন আরা রহমান, সাজেদা চৌধুরী (আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সংসদের সাবেক উপনেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক এমপিপঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্রথম দিকেও চট্টগ্রামে ছিলেন; সে সুবাদে চট্টগ্রামের মাদার্শার সন্তান ভাষা সংগ্রামী গোলাম আকবর চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। নাট্যাভিনেত্রী মণি ইমাম ও রেহানা পারভীন, ফওজিয়া সামাদ, সাহিত্যিক উমরতুল ফজল, কামেলা শরাফী, মালেকা আজিম, বেগম মুশতারী শফী, ফাহমিদা আমিন, পুতুল রানী দাশ, সিতারা সাত্তার, চমন আফরোজ, শেফালী ঘোষ, শিখা রাণী দাশ, নীলুফার কায়সার, অধ্যক্ষ নীলুফার জহুর, অধ্যক্ষ রীতা দত্ত, মমতাজ সবুর, চেমন আরা বেগম, অধ্যাপিকা সালমা চৌধুরী, অধ্যক্ষ রওশন আখতার হানিফ, অধ্যক্ষ হাসিনা জাকারিয়া, বেগম রুনু সিদ্দিকী, বেগম ফজিলতুল কদর, কামরুন্নাহার জাফর, ফ্যানসি হক, জয়শ্রী বড়ুয়া, শীলা দাশ (মোমেন), শর্মিলা দাশ, কিশোর কামাল, জয়তী দাশ, বেলা হক, বাণী দাশ, মীরা সেন, জাহানারা, হোসনে আরা মাক্কী, দীপ্তি খাস্তগীর, সুপ্তি খাস্তগীর, অধ্যাপক খালেদা হানুম, অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলীম, অধ্যক্ষ আনোয়ারা আলম, খালেদা রহমান, রাশেদা খানম, জাহানারা আঙ্গুর, ঝর্ণা বড়ুয়া, নুরজাহান খান, জয়ন্তী লালা, কল্যাণী ঘোষ, আয়শা আমান, দীপা দত্ত, অধ্যক্ষ তহুরীন সবুর ডালিয়া, এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা, জেসমিন সুলতানা পারু, সুতপা বড়ুয়া, মধুমিতা দাশগুপ্ত, মালবিকা দাশ, আইরিন সাহা, হাসি তালুকদার, সাংবাদিক শাহীন আরা, নাজনীন বেগম, সানজিদা মালেক, শামীম আরা লুসি, ইয়াসমিন ইউসুফ, রওশন সোমা, সুমি খান, শরীফা বুলবুল, লতিফা আনসারী রুনা, মর্জিনা আখতার, আসমা বীথি, সেলিনা শেলী, কবি লুলুল বাহার, তুতুল বাহার, রাইহান নাসরিন, বাচিকশিল্পী মিলি চৌধুরী, ইন্দিরা চৌধুরী, আয়েশা হক শিমু, কংকন দাশ, দিলরুবা খানম ছুটি প্রমুখ।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসর্পদংশনের চিকিৎসা : আমাদের করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধপ্রেমের কবি