দফায় দফায় সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে নগরীর নিউ মার্কেট মোড়সহ আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা। গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমাবেশে অংশ নেওয়া ছাত্র–জনতার সাথে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও পুলিশের এ সংঘর্ষ হয়েছে। আন্দোলনকারীদের দমাতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এদিকে সন্ধ্যার পর বহদ্দারহাট মোড়ে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। পুরো দিন সংঘর্ষ চলাকালে ৪ সাংবাদিকসহ দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। আহত ১৮১ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে আইসিইউতে ভর্তি ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। চমেক হাসপাতালের বাইরে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালেও আহতদের ভর্তি করার খবর পাওয়া গেছে।
নিউ মার্কেট মোড়ে ঘটনার সূত্রপাত হলেও তিন পোলের মাথা, কদমতলী, টাইগারপাস, এনায়েত বাজার, নূর আহমেদ সড়ক, কাজীর দেউড়ি, লালদীঘি, ওয়াসা মোড়, বরিশাল কলোনিসহ আশেপাশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। আগ্রাবাদেও বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা। এছাড়া মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় ওয়াসা, ষোলশহর, দুই নম্বর গেট ও মুরাদপুরে ভাঙচুর করেন আন্দোলনকারী। এদিকে নিউ মার্কেট, কাজীর দেউড়িসহ কয়েকটি স্পটে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগ–যুবলীগের কয়েকজন কর্মীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল লাঠিসোটা। অনেকের হাতে লোহার রডও ছিল।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপ–পরিদর্শক আলাউদ্দিন তালুকদার আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে সংঘাত–সংঘর্ষের ঘটনায় আজ (গতকাল) রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত হাসপাতালে ১৮১ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে আইসিইউতে ভর্তি ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এছাড়া বাকিদের ক্যাজুয়ালটি, নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিকস ও জেনারেল সার্জারি ওয়ার্ডে করা হয়েছে।
সংঘর্ষ চলাকালে নগর স্বেচ্ছাসবক লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজসহ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। এছাড়া দৃর্বৃত্তের হামলায় আহত হয়েছেন ডেইলি স্টারের সাংবাদিক এ এম মিজানসহ চারজন।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে : সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন ছিল গতকাল। এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকাল থেকে নিউ মার্কেট মোড়ে নগরের বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল নিয়ে জড়ো হন আন্দোলনকারীরা। ছাত্রদের পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষও দেখা গেছে সেখানে। হাজারের অধিক মানুষের সমাবেশ ঘটে। জড়ো হওয়া আন্দোলনকারীরা তাদের দাবির পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় আমতল, সদরঘাট, স্টেশন রোড, জিপিও ও সদরঘাট এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভ চলাকালে সোয়া ১১টার পর সরকারি সিটি কলেজের দিক থেকে মিছিল নিয়ে এসে ছাত্রলীগ–যুবলীগ কর্মীরা হামলা করেন আন্দোলনকারীদের ওপর। এ সময় আন্দোলকারীদের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ হামলার জের ধরে দারুল ফজল মার্কেটে নগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় সদরঘাটে একটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যায়। ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলাকালে সদরঘাটের দিক থেকে এগিয়ে আসে পুলিশ। তারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। তখন আন্দোলনকারীদের একটি অংশ জুবিলি রোডের দিকে চলে যায়।
এদিকে সংঘর্ষ চলাকালে বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা এসে নিউ মার্কেট মোড়ে জড়ো হন। তাদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের একটি অংশের সঙ্গেও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে ছত্রভঙ্গ হয়ে সরে যায় আন্দোলনকারীরা। এরপর নিউ মার্কেট মোড় দখলে নিয়ে অবস্থান করে আওয়ামী লীগ।
পরবর্তীতে নিউ মার্কেট মোড়ে বন্দর–পতেঙ্গা আসনের এমপি এম এ লতিফ, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ ও শফিক আদনান, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক চন্দন ধর, আইন সম্পাদক শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, কাউন্সিলর চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, হাসান মুরাদ বিপ্লবসহ নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে সমাবেশ করেন।
অতঃপর ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ : নিউ মার্কেট থেকে ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর আন্দোলনকারীরা এনায়েত বাজারের দিকে চলে আসেন। বৌদ্ধ মন্দির রোড দিয়ে আসার সময় সেখানে অবস্থানরত ছাত্রলীগ কর্মীদের ধাওয়া দেন তারা। নূর আহমেদ সড়কে বিএনপি অফিসের সামনেও ছাত্রলীগ কর্মীদের ধাওয়া দেওয়া হয়। পরে কাজীর দেউড়ি মোড়ে আসলে সেখানে অবস্থানরত ছাত্রলীগ–যুবলীগের আরেকটি গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের। এদিকে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ লালদীঘি পাড়ে এসে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। সেখানেও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে ছাত্রলীগ–যুবলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে।
এছাড়া ছত্রভঙ্গ হওয়া আন্দোলনকারীরা লাভলেইন, আন্দরকিল্লা, স্টেশন রোড, ওয়াসা মোড়, লালখান বাজার, স্টেশন রোডসহ জায়গা ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে রিয়াজউদ্দিন বাজারসহ বিভিন্ন অলিগলিতে আটকা পড়ে। বেলা ২টার দিকে ওয়াসার পাশে পল্টন রোডেও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়।
জানা গেছে, আন্দোলনকারীদের একজন পল্টন রোডের একটি চায়ের দোকানে গেলে ওই এলাকায় অবস্থানরত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে আন্দোলনকারীরা ধাওয়া দেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। এ সময় ওয়াসা মোড়ের অল্প দূরত্বের ইস্পাহানি মোড় ও কাজীর দেউড়ি মোড়ে অবস্থানে ছিলেন ছাত্রলীগ–যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় দুই পক্ষের মাঝখানে অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী। ফলে সেখানে সংঘর্ষ হয়নি।
ওয়াসা মোড়ে অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে জিইসি, ২ নং গেট হয়ে মুরাদপুরে অবস্থান নেন। যাওয়ার পথে কয়েকটি জায়গায় ভাঙচুর করেন তারা। সন্ধ্যায় তারা বহাদ্দরহাটের দিকে যান।
বহদ্দারহাটেও সংঘর্ষ : বহদ্দারহাট মোড়ে পৌঁছে আন্দোলনকারীরা ভাঙচুর চালান। এ সময় তাদের সরিয়ে দিতে আসা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এ সময় আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। বহদ্দারহাট পুকুরপাড় ও ওয়াপদা কলোনির মুখে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। তাদের সঙ্গেও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে।
নিউ মার্কেট মোড়ে আবারও আন্দোলনকারীরা : দুপুরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়া আন্দোলনকারীদের একটি অংশ বিকালে আবারও নিউ মার্কেট মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকাল ৫টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া যান আমতল হয়ে নিউ মার্কেটের দিকে যাচ্ছিল। তখন তিনপুলের মাথায় আওয়ামী লীগের একদল নেতাকর্মী অবস্থান করেন এবং নিউ মার্কেট মোড়ে গোলচত্বরে আওয়ামী লীগের সমাবেশ চলছিল। তখন অলিগলি থেকে কিছু আন্দোলনকারী স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে আসেন। তারা সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে স্লোগান দিতে দিতে নিউ মার্কেট এলাকায় পৌঁছেন। এ সময় তিনপুলের মাথা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের লক্ষ্য করে ইট–পাটকেল ছুড়তে চাইলে তাদের নিবৃত করেন সেনা সদস্যরা। এরপর পিছু হটেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
সন্ধ্যায় নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, নিউ মার্কেট মোড়ে এখন আন্দোলনকারী ও আওয়ামী লীগের কেউ নেই। বহদ্দারহাট ও আগ্রাবাদে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়েছে। বহদ্দারহাটে আন্দোলনকারীরা পুলিশের ওপর হামলা করেছে। সেখানে সংঘর্ষ চলছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।