বৃহস্পতিবার রাত দশটা চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর ফিনলে স্কয়ার। চত্বরে হঠাৎ ছুটে আসে কয়েকটি বাইক। হেডলাইট অফ, মুখ ঢাকা, কাঁধে ব্যাগ। রাস্তায় নেমেই শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। কেউ লাঠি হাতে, কারও কোমরে রিভলভার। চারপাশে ভয়, আতঙ্ক। এটি কোন সিনেমার শ্যুটিং নয়—ঘটনাটি এখন চট্টগ্রামের বাস্তবতা।
এটি নতুন কোনো ‘স্টাইলিশ গ্যাং’ সিরিজ নয়—এটা ডেভিল গ্যাং। শহরের অজস্র স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের টার্গেট করে গড়ে উঠছে একের পর এক ভয়ানক কিশোর অপরাধ চক্র। তাদের হাতে অস্ত্র, পকেটে মাদক, আর মগজে বসানো হয়েছে ‘ভাই কালচার’। আর পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা—যারা এসব কিশোরদের ময়দানে নামিয়ে নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে থাকছেন।
এই গ্যাংয়ের শিকড় গিয়েছে অভিভাবকহীনতা, অর্থের লোভ আর মাদকের অন্ধকার জগতে। স্কুলের পড়ুয়া এক ছাত্র বলে, “ভাইয়েরা বলছিল, ভিডিও বানিয়ে ভাইরাল হলে মাসে টাকা আসবে। একদিন বলল, একটা পার্টিতে যেতে হবে। তারপরই সব পাল্টে গেল।”
একটা সময় যারা বইয়ের ব্যাগে রাখত খাতা-কলম, এখন তাদেরই ব্যাগে চাপাতি, গাঁজা, ইয়াবা, এমনকি দেশি পিস্তল। অনলাইনে শুরু, বাস্তবে ভয়ঙ্কর পরিণতি।
এই কিশোর গ্যাং চক্র নিজেদের ‘ব্র্যান্ড’ বানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ‘ডেভিল সেনা’, ‘ব্ল্যাক হক’, ‘গ্যাংস্টার স্টার’—নামে নামে পেজ চালু করে ছাড়া হতো তাদের গ্যাং এর প্রচারণা। একেকটা পোস্টে লাখ লাখ ভিউ। সেখানে দেখা যায়, ছুরি হাতে কিশোর হুমকি দিচ্ছে, আবার কেউ রিল বানাচ্ছে পিস্তল হাতে গানের তালে।
পুলিশ বলছে, এই ভিডিওগুলো শুধু প্রচারের জন্য নয়—গ্যাংয়ে নতুন সদস্য রিক্রুট করারও হাতিয়ার।
সবচেয়ে ভয়ানক তথ্য উঠে এসেছে পাঁচলাইশ থানার তদন্তে। গ্যাং সদস্যরা রাতের বেলায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। স্কুল বা কোচিং শেষে ফেরার পথে একাকী ছেলেদের টার্গেট করে। গাড়িতে তুলে নেয়, চালু হয় লাউড মিউজিক। তারপর সেই গানের তালে চলে মারধর, অশ্লীল ভিডিও ধারণ করা হয় ব্ল্যাকমেইল পরিবার থেকে চাওয়া হয় বড় অংকের টাকা। অথবা লুটে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো নির্জন স্থানে।
গ্যাং চক্রের ভেতরে একবার ‘শিবিরে’ ঢুকলেই আর ফেরা নেই। কেউ হেরে যায় মানসিক যুদ্ধে, কেউ রয়ে যায় আজীবনের অপরাধী পরিচয়ে।
একজন তদন্ত কর্মকর্তা জানালেন, “গ্যাং লিডাররা নিজেরা সামনে আসে না। এরা শহরের পরিচিত অপরাধী। তাদের ছায়াতেই বড় হয় এসব কিশোর বাহিনী। কোনো বড় ভাইয়ের নামেই ভয় পায় সবাই। আর বড় ভাইয়ের নির্দেশেই চলে অস্ত্র সরবরাহ থেকে অপারেশন।”
এদের মধ্যে কেউ আবার নির্দিষ্ট এলাকায় চাঁদাবাজি করে, কেউ মাদক পরিবহন, আবার কেউ মোবাইল ছিনতাই কিংবা প্রাইভেটকারে উঠিয়ে নির্যাতনের কাজে ব্যবহৃত হয়। কিশোর মুখোশের আড়ালে গড়ে উঠছে ভয়ংকর অপরাধ কারখানা।
এদিকে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার (৯ মে) রাতে পাঁচলাইশ থানার নেতৃত্বে চালানো হয় বিশেষ অভিযান। ষোলশহর এলাকায় অস্ত্রসহ মহড়াকালে গ্রেফতার করা হয় ১২ কিশোর গ্যাং সদস্যকে। এদের বয়স ১৮ থেকে ২১ বছরের মধ্যে।
সেই গ্যাংয়ের ১২ সদস্যকে এবার একযোগে ঘেরাও করে আটক করল পুলিশ। তারা হলো- জয় দাস (১৯), গ্যাংয়ের অন্যতম মুখ্য সংগঠক মো. জাহিদ হাসান (২০), আফতাহি রহমান ফারহান (২১), নাদিমুল হক (২০), তামিম মাহমুদ (১৯), মহড়ার সময় অস্ত্র বহনকারীর মাইজ উদ্দিন সিদ্দিকী আকিল (১৯), সোশ্যাল মিডিয়ায় অস্ত্রহাতে লাইভে দেখা যাওয়া মো. আরমান (১৯), গ্যাংয়ের টিকটক প্রপাগান্ডার অন্যতম কারিগর ইফসান (১৯), গ্যাংয়ের ‘ক্যাশ হোল্ডার’ ফজলে রাব্বি মৃদুল (১৯), ইমরান হোসেন ইমন (১৯), মো. নয়ন (২০) ও সৈকত দাস (২০)।
তবে অভিযানে থাকা পুলিশ জানায়, অন্তত ৩০-৩৫ জন কিশোর পালিয়ে গেছে সেসময়। পুলিশের তালিকায় এখন আরও অন্তত চারটি সক্রিয় গ্যাং চিহ্নিত হয়েছে।
আরও অন্তত ছয়টি গ্যাংয়ের আংশিক খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। এরা যেন কোনো ভিডিও গেম কিংবা সিনেমার চরিত্র—‘কেবি’, ‘এনএস’, ‘ট্রিপল নাইন’, ‘এমবিএস, এক্সমার্ক, ‘ব্ল্যাক হোল। তবে এরা আন্ডারগ্রাউন্ডের কিশোর গ্যাং বলে দাবি পুলিশের।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, “অনেকেই ভাবেন এটা হয়তো টিনএজ দুষ্টুমি। কিন্তু বাস্তবে, এই গ্যাং চক্র গড়ে তুলে বিভিন্ন অপরাধে করছে তারা। কিশোরদের দিয়ে অপারেশন করিয়ে বড়রা নিজেরা নিরাপদে থাকছে। এদের থামানো এখন জরুরি।”
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘ডেভিল হান্ট’ এখন নিয়মিত হবে। গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে চলবে অভিযান, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের রক্ষা করাই এখন প্রধান লক্ষ্য।
প্রত্যেক অভিযানে কিছু কিশোর ধরা পড়ছে, কিন্তু তাদের পেছনে যারা রয়েছে, সেই মূল সন্ত্রাসী চক্র এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।