চট্টগ্রামে ছিল ২২টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে ২১টি

এ খাতে ত্রিশ বছরে হয়নি কোনো বিনিয়োগ, চামড়া শিল্পে সংকট

হাসান আকবর | শুক্রবার , ১০ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

গ্রিন কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক চাপ, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের বিধিবিধান বাস্তবায়ন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা সংকটে চট্টগ্রামের ২২টি ট্যানারির ২১টিই বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে কোরবানিসহ বছর জুড়ে চামড়ার যে যোগান তাতে অন্তত চল্লিশটি ট্যানারি চলতে পারে। অথচ বর্তমানে কেবলমাত্র একটি ট্যানারি চালু রয়েছে। গত ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ে চট্টগ্রামে নতুন কোনো ট্যানারি গড়ে উঠেনি, হয়নি বিনিয়োগও। বিপুল সম্ভাবনার ট্যানারি খাতে চট্টগ্রামের দুরবস্থা চামড়া শিল্পে সংকট সৃষ্টি করছে।

সূত্র জানিয়েছে, একসময়কার রপ্তানি বাণিজ্যে শীর্ষে থাকা চামড়া শিল্পে চট্টগ্রামের অবস্থান ছিল বেশ তুঙ্গে। তৎকালীন পাকিস্তানের বহু ব্যবসায়ী শিল্পপতি চট্টগ্রামে ট্যানারি শিল্প গড়ে তুলেছিলেন। সস্তা শ্রম এবং বন্দর সুবিধাসহ নানা সুবিধা কাজে লাগিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করতেন। ট্যানারি শিল্পের প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণই ছিল পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের হাতে। ট্যানারি শিল্পের স্বর্ণযুগে চট্টগ্রামে বাংলাদেশী মালিকানাধীন মন্টি ট্যানারি নামের একটি মাত্র ট্যানারি ছিল। বাকি সব ট্যানারি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। মন্টি ট্যানারি পরবর্তীতে এইচআরসি ট্যানারি নামেও কিছুদিন ব্যবসা করেছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা পালিয়ে গেলে এখানকার কারখানাগুলো সরকারের হাতে চলে যায়। সরকারি খাতে কিছুদিন চালানোর পর দেশের ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে নেন। পুরানো ট্যানারিগুলোর পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন ট্যানারিও ওই সময় গড়ে ওঠে। আধুনিক মেশিনারিজসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কিছু ট্যানারিও ওই সময় চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে। হিলটন লেদার নামের একটি ট্যানারি ছিল ওইসময়কার দেশের প্রথম অত্যাধুনিক ট্যানারি। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে ওরিয়েন্ট ট্যানারি, মেঘনা ট্যানারি, জামান রহমান ট্যানারি, জুবিলি ট্যানারি, সিকো লেদার, চিটাগাং লেদার, কর্ণফুলী লেদার, মদিনা ট্যানারি, মেট্রোপলিটন লেদার, রিফ লেদারসহ ২২টি ট্যানারি গড়ে ওঠে। বেশ জমজমাট ব্যবসা চলে ট্যানারি শিল্পের। চট্টগ্রাম থেকে কোটি কোটি টাকার চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। একে একে বন্ধ হতে থাকে ট্যানারি। শুরুতে মেট্রোপলিটন লেদার চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায় চলে যায়। বাকিগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র রিফ লেদার চট্টগ্রামে থাকলেও বাকি কোনোটিই আর চলে না। এরমধ্যে অনেকগুলোর অস্থিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। মদিনা ট্যানারি কিছুদিন আগ পর্যন্ত চলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, ১৯৯১ সালের পর এই শিল্পে চট্টগ্রামে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে উঠা রিফ লেদারই এই শিল্পের চট্টগ্রামে শেষ বিনিয়োগ। রিফ লেদার এখনো ব্যবসা করছে বলে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, তারা চট্টগ্রামে চামড়া শিল্পের কাঁচামালের যে যোগান তার খুব সামান্য অংশই ব্যবহার করতে পারে।

শুধুমাত্র কোরবানিতে চট্টগ্রামে প্রায় আট লাখের মতো গরু মহিষ ও ছাগলের চামড়া পাওয়া যায়। এর বাইরে বছর জুড়ে চট্টগ্রামে পাওয়া চামড়ার সংখ্যা বিশ লাখেরও বেশি। কঙবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই সংখ্যা বছরে প্রায় অর্ধ কোটি। এসব চামড়া দিয়ে চট্টগ্রামে অনায়াসে চল্লিশটি কারখানা চলতে পারে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, অথচ চট্টগ্রামে একটি কারখানা চলছে। যা পুরো বছরে লাখ খানেক চামড়া ব্যবহার করতে পারে।

ঢাকার ট্যানারি মালিকেরা চট্টগ্রামের চামড়া শিল্পের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রামের একাধিক আড়তদার বলেছেন যে, এক দুই বছরের বাকিতেও ঢাকার ট্যানারিতে চামড়া দিতে হয়। তাদের মর্জি হলে টাকা দেয়, নাহয় বাকি থাকে। কোটি কোটি টাকা ঢাকার ব্যবসায়ীদের নিকট আটকে থাকে। নানাভাবে দেনদরবার করেও চট্টগ্রামের চামড়ার মূল্য ঠিকঠাকভাবে আদায় করা সম্ভব হয়না।

চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিমউদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের ১১২জন আড়তদার রয়েছেন। যারা পদে পদে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, চামড়ার দাম কমে গেছে। তাই আমাদের ব্যবসাও কমে গেছে। ঢাকার ব্যবসায়ীদের বাকিতে চামড়া দিতে হয়। তারা ধীরে ধীরে পরিশোধ করে। এখনো চট্টগ্রামের আড়তদারদের বেশ কিছু টাকা ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে আটকে আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেন, নানা প্রতিকুলতায় চট্টগ্রামে ২১টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা কমপ্ল্যায়েন্সের জন্য বহুদিন ধরে চাপ দিয়ে আসছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধিবিধান অনুসরণ করাও কঠিন। ব্যাংক ঋনের সুদের হারও চড়া। সবকিছু মিলে ট্যানারি শিল্পে বিনিয়োগ বন্ধ রয়েছে বহুদিন। নতুন বিনিয়োগ না আসায় এই সেক্টরে দুর্দিন লেগে রয়েছে বলেও তারা উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন
পরবর্তী নিবন্ধপানি-বিদ্যুতের দর এলাকাভিত্তিক করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর