চট্টগ্রামে হঠাৎ বেড়েছে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ। এডিস মশাবাহিত এই রোগের এমন প্রকোপ অতীতে কখনো দেখা যায়নি। ডেঙ্গুর মতো চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে শরীরে জ্বর ও র্যাশ দেখা দেয়। তবে চিকুনগুনিয়ায় ব্যতিক্রম হচ্ছে শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথা এবং পা ফুলে যায়। এমনকি এই ব্যথা দীর্ঘ সময়ও থাকতে পারে।
চিকিৎসকরা বলছেন, সম্প্রতি চট্টগ্রামে জ্বরের রোগীদের মধ্যে পরীক্ষায় ৮০ শতাংশেরই চিকুনগুনিয়ায় ধরা পড়ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে–চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা ব্যয়বহুল হওয়ায় অধিকাংশ রোগী পরীক্ষা করান না। তাই চিকিৎসকরাও রোগীর উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, গতকাল চিকুনগুনিয়ায় নতুন করে আরো ৬০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪৪ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জ্বর থাকলেও সর্দি কাশি থাকে না। রোগীদের গায়ে ব্যথা থাকে। গায়ে ফুসকুড়ি (র্যাশ) থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। শরীরে তীব্র ব্যথা থাকে। ব্যথার মাত্রা এত বেশি থাকে যে রোগী হাঁটতে পারেন না। চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি কম, কষ্ট বেশি। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ শতাংশ এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যান। ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগী তিন মাস পর্যন্ত অসুস্থ থাকতে পারেন, গায়ে ব্যথা থাকতে পারে। ৫ থেকে ৭ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে সুস্থ হতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে।
গতকাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, জ্বরের রোগীদের দীর্ঘ সারি। এদের একজন নগরীর হালিশহর এলাকার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, গত চারদিন ধরে জ্বর। ঘরে সবাই আগে পরে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। বাকিদের জ্বর সেরে গেলেও আমার জ্বর সারছে না। জ্বরের সাথে হাত পা–সহ পুরো শরীরে অসহ্য ব্যথা। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। অনেকে বলছে চিকুনগুনিয়া হতে পারে। তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছি। অপরদিকে মুরাদপুর এলাকার আসা জান্নাতুল মাওয়া বলেন, জ্বর কমছে না তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছি। এর আগে ডেঙ্গু পরীক্ষা দিয়েছিলাম, সেখানে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। অনেকে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করাতে বলছে। এখন এই পরীক্ষা করানোর জন্য সাড়ে ৪ হাজার টাকা লাগে। সাথে অন্যান্য পরীক্ষাও আছে। এত টাকা দিয়ে পরীক্ষা করানোর সামর্থ্যও নাই।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আবদুর রব বলেন, চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। চিকুনগুনিয়ায় জ্বর সেরে যাওয়ার পরে শরীরে ব্যথা থাকছে। রোগী সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করতে হিমশিম খেতে হয়। সরকারি হিসেবে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি বাস্তবে আরো বেশি হতে পারে। কারণ অনেক রোগী পরীক্ষার বাইরে রয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগ নির্ণয়ের কিট থাকলেও চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ের কিট না থাকায় সরকারি পর্যায়ে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। চিকুগুনিয়া প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা এবং রোগ নির্ণয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যাক রেপিড টেস্ট কিট সরবরাহের জন্য ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গুর মতো চিকুনগুনিয়াও মশাবাহিত রোগ। সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটাতে হবে। বর্তমানে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমছে। এতে মশার বংশবিস্তার ঘটছে। তাই নগরবাসীকেও সচেতন থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সমপ্রতি এক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম নগরীর ছয়টি এলাকায় মশা চিহ্নিতকরণে চালানো জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। এই এলাকাগুলো হলো– চট্টেশ্বরী রোড (ওয়ার্ড ১৫), ও আর নিজাম রোড (ওয়ার্ড ১৫), আগ্রাবাদ (ওয়ার্ড ২৭), পাহাড়তলী (ওয়ার্ড ৯), হালিশহর (ওয়ার্ড ২৬), এবং ঝাউতলা (ওয়ার্ড ১৩)। জরিপকালে মোট ১২৮টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়, যার মধ্যে ৬২টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নগরীর এসব এলাকা ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর লক্ষণ বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করা। কীটতাত্ত্বিক জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহে অনতিবিলম্বে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং পর্যায়ক্রমে সিটি কর্পোরেশনের অন্যান্য ওয়ার্ডসমূহকে উক্ত কার্যক্রমের আওতায় আনা এবং মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা।