ওভারহেড ক্যাবল বা ঝুলন্তভাবে থাকা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্কের (ডিশ সংযোগ) তার অপসারণ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। অথচ সরাসরি এর মাশুল গুণতে হবে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় দুই লাখ ব্রডব্যান্ড গ্রাহক এবং কমপক্ষে আরো ১৫ লাখ ক্যাবল টিভি গ্রাহককে। আর পরোক্ষভাবে পুরো নগরেই এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ব্যাংক-বীমা খাত থেকে শুরু করে ইন্টারনেট নির্ভর প্রতিটি বাণিজ্যিক সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কারণ, ডিএসসিসির ওভারহেড ক্যাবল অপসারণের প্রতিবাদে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন ‘ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (আইএসপিএবি) ও ক্যাবল নেটওয়ার্ক অপারেটরগুলোর সংগঠন ‘ক্যাবল অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (কোয়াব) এর ঘোষিত প্রতীকী ধর্মঘট পালিত হবে চট্টগ্রামেও। কর্মসূচির আওতায় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে আগামীকাল (রোববার) সকাল ১০টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও ডিশ সংযোগ সেবা বন্ধ থাকবে।
আইএসপিএবি এর একজন পরিচালক জানিয়েছেন, ৯২টি আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স) চট্টগ্রাম শহরে ব্রডব্যান্ড সেবা দিয়ে থাকে। এরমধ্যে জাতীয় পর্যায়ের ২৪টি, জোনাল ১৭টি এবং ক্যাটাগরি ভিত্তিক আইএসপি আছে ৫১টি। এসব আইএসপি’র বাসা-বাড়ি পর্যায়ে গ্রাহক আছে ১ লাখ ৭৭ হাজার। এক্ষেত্রে প্রতিটি সংযোগের (গ্রাহক) বিপরীতে গড়ে পাঁচজন হলেও ৮ লাখ ৮৫ হাজার লোক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এছাড়া কর্পোরেট পর্যায়ে আরো চার থেকে থেকে পাঁচ হাজার গ্রাহক আছে। কর্পোটের প্রতিষ্ঠানগুলোর পরোক্ষ সেবাগ্রহীতাও কয়েক লাখ হবে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, পুরো দেশে ব্রডব্যান্ডের গ্রাহক সংখ্যা ৮৫ লাখ ৭১ হাজার। অবশ্য আইএসপিএবি’র দাবি এ সংখ্যা কোটির বেশি। বর্তমানে দেশে ১৭০০ থেকে ১৭৫০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হয়। এরমধ্যে ৯৫০ থেকে এক হাজার জিবিপিএস ব্যবহার হয় ব্রডব্যান্ডে। অবশিষ্ট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করেন মোবাইল অপারেটররা।
এদিকে বেসরকারি পর্যায়ে নগরে ১ লাখ ৯২ হাজার ৮৮৯টি হোল্ডিং আছে। প্রতি হোল্ডিংয়ে গড়ে ছয়টি ফ্ল্যাট হিসাব করলে ১১ লাখ ৫৭ হাজার ডিশ সংযোগ আছে। এছাড়া সরকারি হোল্ডিং, বিভিন্ন দোকানপাট এবং বস্তি এলাকা মিলিয়ে আনুমানিক ১৫ লাখ ডিশ সংযোগ থাকতে পারে।
বিরূপ প্রভাব পড়বে চট্টগ্রামে : সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নগরে কর্পোরেট পর্যায়ের যেসব ব্রডব্যান্ড গ্রাহক রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হচ্ছে- ব্যাংক, বীমা, সিএন্ডএফ এজেন্ট, শিপিং এজেন্ট, বাণিজ্যিক অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শেয়ার বাজারের ব্রোকারেজ হাউজ, স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যম অফিস। ১০টা থেকে ১ টা পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড সেবা বন্ধ থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রতিষ্ঠানগুলো। পাশাপাশি এর মূল্য দিতে এসব প্রতিষ্ঠানের সেবাগ্রহীতাদেরও।
বিশেষ করে ব্যাংক ও শেয়ারবাজারের ব্রোকার হাউজে দৈনিক সেবা নিতে আসা লক্ষাধিক গ্রাহককে ভুগতে হবে বেশি। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকলে অকার্যকর হতে পারে ব্যাংকের এটিএম বুথ সেবা। পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট নির্ভর চট্টগ্রামের প্রতিটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই সমস্যায় পড়বে। বিশেষ করে ই-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া করোনাপরিস্থিতির কারণে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসও থমকে যাবে। বলা যায়, তিন ঘণ্টা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা না থাকলে পুরো নগরজুড়েই বিরূপ প্রভাব পড়বে। উপজেলাজুেেড়ও একই সমস্যা সৃষ্টি হবে।
যে কারণে কর্মসূচি : গত ১২ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আইএসপিএবি ও কোয়াব ১৮ অক্টোবর থেকে সারা দেশে বাসাবাড়ি, অফিস ও ব্যাংকসহ সব পর্যায়ে ইন্টারনেট ডাটা কানেক্টিভিটি এবং ক্যাবল টিভি বন্ধ রাখার প্রতীকী কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। সংগঠন দুটির দাবি, বিনা নোটিশে এবং বিকল্প ব্যবস্থা না করে ডিএসসিসি গত দুই মাস ধরে ওভারহেড ক্যাবল কেটে ফেলেছে। সংবাদ সম্মেলন থেকে ডিএসসিসি’র ‘হটকারী’ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসারও দাবি জানানো হয়েছিল। গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। ফলে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেনি সংগঠন দু’টি। দুই সংগঠনের সদস্য হওয়ায় চট্টগ্রামের সার্ভিস প্রোভাইডাররাও কর্মসূচি পালন করবে বলে জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন : ‘ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ এর পরিচালক এবং চট্টগ্রাম টেলিকম সার্ভিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ারুল আজিম দৈনিক আজাদীকে বলেন, আসলে এটা চট্টগ্রাম-ঢাকার ইস্যু না। সরকার আমাদের দাবিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। চট্টগ্রামেও কিন্তু এ ধরনের সমস্যা হয়েছিল। যেমন জামালখানে আমাদের ক্যাবল কেটে এক জায়গা থেকে থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে হয়েছে। মূল সমস্যা হচ্ছে, এনটিটিএন (ভূ-গর্ভস্থ ক্যাবল সেবা), সরকার যাদেরকে আন্ডারগ্রাউন্ড করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছে তারা আমাদের ফ্যাসিলিটি দিচ্ছে না। সরকারকে আমরা বার বার বুঝিয়েছি, আমরাও ওভারহেড ক্যাবল চাই না। এক্ষেত্রে আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল নেয়ার কোনো ব্যবস্থাই তো নাই। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বললেও এখানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা যে কত অবদান রাখছে তা কেউ বুঝতে চাচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিডিবি বা সিটি কর্পোরেশন ক্যাবল কাটলে সেটা ঠিক করতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। ওই হিসেবে ১০টা থেকে ১ টা পর্যন্ত সংযোগ বন্ধ রাখার কর্মসূচি প্রতীকী। এক্ষেত্রে গ্রাহকরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা পুষিয়ে দেয়া হবে কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এমনিতেই তো বিভিন্ন ফ্যাসিলিটি দিচ্ছি। করোনাকালীন দুই মাসের মত কর্পোরেট গ্রাহকদের ডিসকাউন্ট দিয়েছি। অনেক গ্রাহক ফিফটি পার্সেন্ট বিল দিয়েছে। সেটা আমরা মেনে নিয়েছি। এখন কর্মসূচি যদি এক-দুই দিনের বেশি হয় তাহলে অবশ্যই গ্রাহককে ডিসকাউন্ট দেয়ার চেষ্টা করবো।
কর্পোরেট পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকলে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের যে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে সেটার কি হবে। অথচ আমাদের লাইসেন্স সরকারই দিয়েছে। উন্নত বিশ্বে অবকাঠামোগত সুবিধাটা সরকারই দিয়ে থাকে। আর এখানে আমরা বাধ্য হচ্ছি নিজেরাই করতে। এরপরও বিনা কারণে কেটে ফেলা হচ্ছে। এতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। বড় কোম্পানিগুলোর হয়তো বেকআপ আছে, কিন্তু যারা ক্যাটাগরি পর্যায়ের তারা তো একেবারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেমন একটি ছেলে ৮/১০ লাখ টাকা ইনভেস্ট করে থানা পর্যায়ে ব্যবসা শুরু করল। এখন ক্যাবল কেটে দিলে তাদের তো পুরো পুঁজিই শেষ।
নগরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান চিটাগং অনলাইন লিমিটেড (সিওএল) এর চিফ অপারেটিং অফিসার গোলাম নবী চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, কর্মসূচির ফলে গ্রাহকদের যে ক্ষতি হবে সেটা গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা (সিওএল) ভবিষ্যতে পুষিয়ে দিবো। ‘ঢাকায় ক্যাবল কাটা হচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রামের গ্রাহকরা কেন এর মাশুল দিবেন?’ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নগর পুড়িলে দেবালয় কি রক্ষা পায়? যেহেতু আমরা আইএসপিএবি’র সদস্য তাই সংগঠনের সিদ্ধান্ত মেনে কর্মসূচি পালন করবো। চট্টগ্রামেও প্রতীকী ধর্মঘট পালন করবো।
ক্যাবল অপারেটর সিসিএলের পরিচালক শ্যামল পালিত দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদেরও পালন করার সম্ভাবনা আছে। চট্টগ্রামের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সরকারি যেসব জায়গায় আমাদের সংযোগ আছে সেগুলো চালু থাকবে। যেমন বিমানবন্দর, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, সরকারি হাসপাতাল ইত্যাদি।