চট্টগ্রামে ক্যান্সার হাসপাতাল চালু হচ্ছে অক্টোবরে

চমাশিহা ক্যান্সার হাসপাতালের বেইসফ্রেম স্থাপনের কাজ পরিদর্শনে এম এ মালেক

হাসান আকবর | বুধবার , ২১ জুন, ২০২৩ at ৪:৪৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের বহুল প্রত্যাশার পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল চালু হচ্ছে আগামী অক্টোবরে। প্রায় ১৩০ কোটি টাকা ব্যয় করে ক্যান্সারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসায় বিশেষায়িত এই হাসপাতাল চালু করা হচ্ছে। রেডিওথেরাপিসহ ক্যান্সারের সব ধরনের চিকিৎসা এই হাসপাতালে প্রদান করা হবে। নগরীর আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের পাশেই বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতালটির জন্য ইতোমধ্যে ৮০ হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসার সর্বাধুনিক বেশ কিছু যন্ত্রপাতি বন্দরে পৌঁছে গেছে। বাকি মেশিনগুলো আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসার মেশিন বসানোর জন্য বেইসফ্রেম স্থাপন করা হয়েছে।

মানুষের টাকায় মানুষের এই হাসপাতালটির কার্যক্রম দ্রুত শুরু করতে আরো টাকার প্রয়োজন উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, আসন্ন কোরবানির ঈদে বাহুল্য বর্জনের মাধ্যমে কিছু টাকা সাশ্রয় করে এই হাসপাতালে প্রদান করা হলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের দুই কোটি মানুষের উপকার হবে।

সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে ৫ লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বছরে গড়ে পঞ্চাশ হাজারের বেশি নতুন ক্যান্সার রোগী যুক্ত হচ্ছে এই তালিকায়। প্রতিদিন গড়ে ১শ ছত্রিশ জন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন সরকারিবেসরকারি হাসপাতালে কিছু মানুষ চিকিৎসা নিতে এলেও অসংখ্য মানুষ রয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসার বাইরে। এই অবস্থার মাঝে প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক রোগী প্রতিবেশী দেশ ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরসহ নানা দেশে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চট্টগ্রামের মানুষ টাকা দিয়েও চট্টগ্রামে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চট্টগ্রামের সরকারিবেসরকারি কোনো পর্যায়ে ক্যান্সারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নেই বললেই চলে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেমোথেরাপি দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও তা অপ্রতুল। মাসের পর মাস সিরিয়াল দিয়েও অপারেশন বা কেমোথেরাপি দেয়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। কেমোথেরাপিসহ বিভিন্ন চিকিৎসার জন্য মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রাইভেট চিকিৎসা নিতে গিয়েও কেমোথেরাপি দেয়ার ব্যবস্থা এতই অপ্রতুল যে, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের নিত্য সমস্যায় পড়তে হয়।

রেডিওথেরাপির সুযোগও কম। চমেক হাসপাতালে সীমিত সুযোগসুবিধা থাকলেও বেসরকারি কোনো হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেয়া যায় না। ঢাকায়ও সিরিয়াল দিয়ে সাতআট মাস অপেক্ষা করার পর রেডিওথেরাপি দেয়া যায়। অবস্থাপন্নরা দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিলেও সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা।

চিকিৎসার অপ্রতুলতায় চট্টগ্রামে প্রতি বছর ক্যান্সারে অন্তত ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহার সাড়ে ৭ শতাংশ। চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতি না ঘটলে ২০৩০ সালে এই হার ১৩ শতাংশে পৌঁছাবে। ক্যান্সার চিকিৎসার এই অবস্থার মাঝে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল বিশ্বমানের একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেককে চেয়ারম্যান করে ১০১ সদস্যের ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি দেশেবিদেশে মানুষের কাছ থেকে হাসপাতালের জন্য আর্থিক অনুদান সংগ্রহসহ নানাভাবে কাজ করে। মানুষের টাকায় এই হাসপাতাল গড়ার কার্যক্রমে শরিক হন চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। হাসপাতালটির জন্য ইতোমধ্যে ৫০ কোটির বেশি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। তা দিয়ে সরকারের দেয়া ১০ কাঠা জায়গায় ৮০ হাজার বর্গফুটের ১০ তলা একটি ভবন নির্মাণ এবং গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে। হাসপাতালের প্রয়োজনীয় বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। ভবন নির্মাণের সিভিল কার্যক্রমও ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যে রেডিওথেরাপিসহ পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে কর্তৃপক্ষ অগ্রসর হচ্ছে।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল (চমাশিহা) ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান এম এ মালেক গতকাল দুপুরে নির্মাণাধীন ক্যান্সার হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে অনির্ধারিত মতবিনিময়কালে বলেন, আমাদের হাসপাতাল অক্টোবরে চালু হবে ইনশাআল্লাহ। চট্টগ্রামের দুই কোটি মানুষের ভরসার স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হবে এই হাসপাতালকে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, চাকরিজীবী, গৃহবধূসহ সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন তার জন্য তিনি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

তিনি বলেন, মানুষের টাকায় মানুষের জন্য এই হাসপাতাল গড়ে তোলা হচ্ছে। আমাদের আরো অনেক টাকা প্রয়োজন। আসন্ন কোরবানির ঈদে বাহুল্য বর্জন করে টাকা সাশ্রয় করে এই হাসপাতালে অনুদান দেয়ার জন্য চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আপনি কিছুটা ছোট পশু দিয়ে কোরবানি দিন, কিছু টাকা সাশ্রয় করে হাসপাতালের জন্য দিন। আল্লাহ তাতে খুশি হবেন। মানুষের জন্য দেয়া দান সদকায়ে জারিয়া হয়ে পরকালে আপনাদের নাজাতের উসিলা হবে।

চট্টগ্রামের ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশ্বমানের সেবা এবং গবেষণা যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে জানিয়ে কমিটির সদস্য সচিব রেজাউল করিম আজাদ আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামে ক্যান্সার চিকিৎসার অবস্থা ভয়াবহ। এই অবস্থা থেকে মানুষকে নিস্তার দিতেই সর্বাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা নিয়ে ক্যান্সার হাসপাতালটির কার্যক্রম অক্টোবরে শুরু হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমরা ত্রিশ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি খরহবধৎ অপপবষবৎধঃড়ৎ মেশিন আমদানি করছি। আমাদের দুটি মেশিন দরকার। একটি দিয়ে কাজ শুরু করব। পরে আরো একটি মেশিন আনব। তিনি বলেন, আমাদের টাকাপয়সার অভাব রয়েছে। তবে চট্টগ্রামের মানুষ যেভাবে অকাতরে দান করে তাতে অচিরেই এই সংকট কাটিয়ে উঠব বলে আমরা আশাবাদী।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মানুষের জন্য সুখবর হচ্ছে, দেশের খ্যাতনামা ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান আমাদের হাসপাতালে যোগ দিচ্ছেন। ঈদের পর তিনি এখানে নিয়মিত বসবেন এবং রোগী দেখবেন।

চমাশিহা ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান এম এ মালেক গতকাল দুপুরে ক্যান্সার হাসপাতালের মেশিন বসানোর জন্য বেইসফ্রেম স্থাপনের কাজ পরিদর্শন করেন। এ সময় কার্যনির্বাহী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (ডোনার) সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন, জেনারেল সেক্রেটারি এবং চমাশিহা ক্যান্সার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটির মেম্বার সেক্রেটারি মোহাম্মদ রেজাউল করিম আজাদ, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হারুন ইউসুফ, ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন, উপপরিচালক (মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স) ডা. এ কে এম আশরাফুল করিম, ক্যান্সার ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান ডা. শেফাতুজ্জাহান, চিফ ইঞ্জিনিয়ার অনুরুপ চৌধুরী, চিফ মেডিকেল ফিজিসিস্ট মো. নজরুল ইসলাম, অনকোলজি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. নুজহাত শারমিন রুহি, আজীবন সদস্য রোটারিয়ান মো. শাহাদাত হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার নুরুল মোস্তফা, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মাবুদ, ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদুল করিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধট্রাকে ট্রাকে আসছে গরু
পরবর্তী নিবন্ধশাহ আমানতে দুই ঘণ্টা বন্ধ ছিল বিমান ওঠানামা