চট্টগ্রামে ঈদগাহ ময়দান প্রতিষ্ঠা ও সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর অবদান

আ ব ম খোরশিদ আলম খান | শুক্রবার , ২১ এপ্রিল, ২০২৩ at ১১:৩০ পূর্বাহ্ণ

দেশে বিভিন্ন শহরে ঈদগাহ ময়দান আছে। রাজধানী ঢাকায়ও কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে লাখো মুসল্লি দুই ঈদে ঈদের নামাজ আদায় করেন। ঢাকার পর দেশের অন্যতম বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামেও বড় পরিসরে ঈদগাহ ছিল না আজ হতে পঁয়ত্রিশ বছর আগেও।

১৯৮৬ সনে চট্টগ্রামে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রতিষ্ঠা হলে এই মসজিদকে ঘিরে একটি ঈদগাহ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। মসজিদটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এর পূর্ব পাশে ছিল বিশাল ডোবা বা অপরিচ্ছন্ন জলাধার। যেখানে ধোপার দোকানের কাপড় চোপড় ধুইতেন ধোপীরা।

আর সেখানে তারা কাপড় শুকাতো। মসজিদ সংলগ্ন এই মজা ডোবায় ১৫/২০টি গাছের ঘাট ছিল। ধোপীরাই এই জলাশয় ব্যবহার করতো। একদিকে বড় মসজিদ, অন্যদিকে এর সংলগ্ন বিশাল এলাকায় ডোবা। তা মসজিদ আঙ্গিনায় হওয়ায় একদম বেমানান ঠেকে।

১৯৮৮ সনে চট্টগ্রাম পৌর কর্পোরেশনের সরকার নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন রাজনীতিবিদ আলহাজ্ব মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি একই সময়ে বাঁশখালী সংসদীয় আসনের তৃতীয়বার নির্বাচিত সংসদ সদস্যও ছিলেন। দেশে কোনো সিটি মেয়র আবার এমপি পদেও আসীন থাকা সত্যিই বিরল ঘটনা। এই কৃতিত্ব পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির রাজনীতিক আলহাজ্ব মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর।

তিনি দেখলেন যে, চট্টগ্রামে বড় পরিসরে কোনো ঈদগাহ ভেন্যু নেই। তা তাঁকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে। তিনি চট্টগ্রামে একটি নতুন ঈদগাহ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবলেন। স্থান হিসেবে বেছে নিলেন জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের সম্মুখস্থ বিশাল ডোবা বা জলাধারকে। এটি মাটি দিয়ে ভরানোর কথা ভাবলেন।

কর্পোরেশনকে এজন্য সক্রিয় করে প্রথমে টেন্ডার আহ্বান করলেন, টাকাও বরাদ্দ করলেন জমি ভরানোর জন্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যে ডোবাজলাশয়টির জায়গাটিকে নতুন ঈদগাহ ময়দান হিসেবে গড়ে তুললেন তিনি। অন্যদিকে, জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের পুরো জায়গাটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর।

তাই কোন এখতিয়ারে সিটি কর্পোরেশন ডোবাকে ঈদগাহের রূপ দিল, মাটি ভরাটসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে ঈদগাহ তৈরি করলোদুর্নীতি দমন কমিশন থেকে ১৯৯১ সনে নোটিশ দেওয়া হলো মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীকে। যে জমির মালিকানা সিটি কর্পোরেশনের নয় চসিকের তত্ত্বাবধানে কেন সেই জমিতে ঈদগাহ তৈরি করা হলো এটাই ছিল মূলত দুদকের আপত্তি।

মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী দুদকের নোটিশের প্রত্যুত্তরে বললেন, সিটি কর্পোরেশন জনগণের সম্পদ। তাই সিটি কর্পোরেশন জনস্বার্থে ও জনকল্যাণে এই ডোবা জলাশয়কে ঈদগাহ ময়দান হিসেবে গড়ে তুলেছে। ১৯৮৯ সনে প্রথম জমিয়তুল ফালাহ ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব আল্লামা আবদুল আহাদ আল মাদানী (রহ.) ওই বছর ঈদ জামাতে ইমামতি করেন।

আর খুতবা পড়েছিলেন মসজিদের প্রথম খতিব অধ্যক্ষ আল্লামা জালাল উদ্দীন আলকাদেরী (রহ.)। মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীই সেদিন ঈদ জামাত পরিচালনার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের খতিবগণই এখানে ঈদ জামাতে ইমামতি করে আসছেন।

এই দেশ মুসলিম প্রধান দেশ। এই চট্টগ্রামকে বলা হয় পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম। বারো আউলিয়া (রহ.), শাহ আমানত (রহ.), গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী (.) সহ অসংখ্য ওলী বুজুর্গের সাধনার ক্ষেত্র ও অবস্থান এই চট্টগ্রামে। অথচ এত বড় মহানগরে বৃহৎ পরিসরে ঈদগাহ না থাকা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক ও দুঃখজনক।

দ্বীনদার মুসলমানদের জন্য সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্নে ঈদ জামাত আয়োজনের স্বার্থে চট্টগ্রামে ঈদগাহ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী ভূমিকা নেন সাবেক পৌর প্রশাসক ও মেয়র এবং দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। আজকের জমিয়তুল ফালাহ লাগোয়া বিশাল মাঠটি ঈদের প্রধান ভেনু হয়ে উঠার পেছনে বড় অবদান মূলত তাঁরই। এতে দুই ঈদে লাখো মুসল্লির একসঙ্গে ঈদের বড় জামাত পড়ার সুব্যবস্থা হলোএর নেপথ্যে বড় অবদান রাখা রাজনীতিক মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর কথা আজকের প্রজন্মের তেমন কেউ হয়তো জানে না। ইতিহাস কিন্তু এটাই। যা কখনো অস্বীকারের জো নেই। তিনি যদি আজ হতে ৩৫ বছর আগে ১৯৮৯ সনে সাহস করে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করতেন তবে চট্টগ্রাম নগরবাসী বড় ঈদ জামাতের সুযোগ থেকে বঞ্চিতই থেকে যেতো চিরকাল।

আলহাজ্ব মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের ময়দানকে ঈদগাহ ময়দান হিসেবে গড়ে তুলেছেন বলেই আজ নানা ধর্মীয় সংস্থা সংগঠনের সভা সম্মেলন কনফারেন্সও এখানে আয়োজিত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের মুসল্লিরা বড় ঈদ জামাতের সুযোগ থেকে যাতে বঞ্চিত না হয় তাই ছিল এই জনদরদী রাজনীতিক ধর্মানুরাগী ব্যক্তিত্বের মূল মহতী উদ্দেশ্য।

আমি আগেই বলেছি, বড় বড় নগর শহরে সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের তত্ত্বাবধানে বৃহত্তর পরিসরে দুই ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। কোনো বড় খ্যাতিমান ব্যক্তির জানাজা নামাজও কখনো কখনো ঈদগাহ মাঠগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়। আজ হতে ৩৫ বছর আগে ১৯৮৯ সনে এই সুযোগ না থাকায় জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠকে ঈদগাহে রূপ দিয়ে আলহাজ্ব মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী অবিস্মরণীয় প্রত্যাশিত কাজটিই করলেন। তিনি এজন্য চাটগাঁবাসীর কাছে নন্দিত ও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

এ প্রসঙ্গে আলহাজ্ব মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বললেন, দেশে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ঈদগাহ ময়দান থাকলেও চট্টগ্রামে বড় কোনো ঈদগাহ ছিল না। আমি ১৯৮৯ সনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র থাকাকালে উদ্যোগ নিলাম চট্টগ্রামে বড় পরিসরে একটি ঈদগাহ প্রতিষ্ঠার।

আজকের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ সংলগ্ন মাঠটিকেই ঈদগাহ হিসেবে গড়ে তুলতে আমি যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করি। এজন্য আমি ১৯৯১ সনে দুদকের রোষানলেও পড়েছি। সেনাবাহিনীর জায়গায় কেন ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করলাম এজন্য আমাকে বেশ ঝক্কি ঝামেলা সইতে হয়েছে। তবুও আমি থেমে যাইনি।

আমার উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। এখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ বা অভিলাষ ছিল না। চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটি বড় ঈদগাহ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন ছিল আমার, তা বাস্তবে রূপ দিতে পেরে আমি মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া প্রকাশ করছি। আমি পৌর প্রশাসক ও পরবর্তীতে মেয়র হিসেবে পদাধিকার বলে সরকার অনুমোদিত চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলাম। সে সময় চট্টগ্রামের অনেক মান্যগণ্য পদস্থ ব্যক্তি এ কমিটির সঙ্গে যুক্ত থেকে ঈদগাহ প্রতিষ্ঠায় আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এ কমিটিতে সহ সভাপতি হিসেবে ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার।

জেলা প্রশাসক, বন্দর চেয়ারম্যান, সিডিএ চেয়ারম্যান, ওয়াসা চেয়ারম্যান, সিএমপি কমিশনার, জমিয়তুল ফালাহর খতিব, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার তাঁরা ছিলেন কমিটির সদস্য। সাবেক মন্ত্রী জহির উদ্দিন খান, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন মাহমুদ এরাও কমিটির সদস্য ছিলেন। আর তৎকালীন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ছিলেন এই কমিটির সদস্য সচিব। আজ হতে ৩৫ বছর পূর্বে চট্টগ্রামে জমিয়তুল ফালাহ ময়দানকে স্বতন্ত্র ঈদগাহ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন এটাই তাঁর জীবনের বড় সফলতা বলে জানালেন ত্যাগী রাজনীতিক ও সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী।

লেখক : সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধক্রেতার সাথে দুর্ব্যবহার লোহাগাড়ায় দোকানিকে৩০ হাজার টাকা জরিমানা