গত ৮–১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে হয়ে গেল চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভালের প্রথম আসর, যেটি আয়োজন করে সদ্য জন্ম নেওয়া শিল্প সংগঠন বিষুব আর্ট অর্গানাইজেশন। উৎসবের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছিল চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, ঢাকা ডকল্যাব ও চিত্রভাষা আর্ট গ্যালারি।
একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে মনেপ্রাণে এটাই চাই আমাদের শিল্প–সংস্কৃতি যেন উৎকর্ষে পূর্ণ হওয়ার সাধনার পাশাপাশি যোগাযোগপন্থীও হয়ে ওঠে। এই দুরূহ কাজ সফল করতে এই ধরণের আন্তর্জাতিক উৎসব বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এই চলমান বিভাজনের রাজনীতিতে একজন ভীষণভাবে একা মানুষও যেন শক্তি পেতে পারে আমাদের সংস্কৃতি থেকে।
আমি নিজে আয়োজকদের একজন হওয়ায় সবকিছু ভেতর থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। প্রদর্শিত সাতটি সিনেমার উপস্থিত পাঁচজন পরিচালকের সাথে কথোপকথন ও তিন জনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়। এছাড়া “ডিরেক্টর’স মিট” অংশে উপস্থিত পাঁচজন পরিচালক ছবি প্রদর্শনীর পরপর উপস্থিত দর্শকদের সাথে সরাসরি আলোচনায় অংশ নেন। যেখানে দর্শক, আলোচক ও সঞ্চালক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন বোদ্ধা শিল্প ও চলচ্চিত্র সমালোচক। অনেকের মধ্যে আলম খোরশেদ, ঢালী আল মামুন, তারেক আহমেদ, রফিকুল আনোয়ার রাসেল, সৈকত দে প্রমুখের নাম করা যেতে পারে। তিনদিন ব্যাপী উৎসব পরিচালক ও উৎসাহী দর্শক–সমালোচকদের পদচারণায় জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমরা সাক্ষী হয়ে থাকি স্মরণীয় নানা তর্ক–বিতর্কের।
বিষয়–বৈচিত্র্যে কেমন ছিল উৎসবটি?
উৎসবে সাকুল্যে ৭টি ছবি দেখানো হয়। দুইটি ফরাসি, একটি ভারতীয়, একটি ফরাসি–বাংলাদেশি যৌথ এবং তিনটি বাংলাদেশি। এছাড়া দুইদিন ব্যাপী একটি কর্মশালারও আয়োজন করা হয়; যেটি পরিচালনা করেন ফরাসি সিনেমাটোগ্রাফার ও চিত্রপরিচালক জুলি ক্ল্যাভিয়ে।
“থিংস আই কুড নেভার টেল মাই মাদার” বা “মাকে যা কখনোই বলতে পারতাম না” পরিচালক হুমায়রা বিলকিসের নিজের ভাষায় এটি একটি সম্পর্কের গল্প। ছবিতে আমরা দেখি ধর্ম ও ব্যক্তি স্বাধীনতার টানাপোড়েন। এক সময় তীব্র আবেগের প্রেমের কবিতা লেখা মা যখন অকস্মাৎ ধর্মসর্বস্ব হয়ে ওঠেন, তার প্রভাব পড়ে কন্যার জীবনে। এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? বর্তমানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই গল্পে পরিচালক নিজেকে দিয়েই এর উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন। পরিচালক নিজের ও নিজের নিকট জনের অতি ব্যক্তিগত যাপন ক্যামেরায় ধারণ করে দর্শকের সামনে নিয়ে আসেন। আমরা পর্দায় পরিচালকের পাশাপাশি এই ডকুমেন্টারির প্রধান চরিত্র তাঁর মাকে দেখি; দেখি তাঁর বাবা, প্রেমিক, ভাই ও অন্যান্যদের। পারিপার্শ্বিক সমস্ত চরিত্রদের নানান ঘটনাপ্রবাহে স্থাপন করে নানামুখী অভিঘাতগুলো দেখানোর চেষ্টা করে গেছেন অবিরত। এটা নিঃসন্দেহে সাহসের কাজ। কিন্তু স্রেফ সাহসের কাজ বা চাঞ্চল্যকর কিছু হয়েই এই ছবি থেমে থাকেনি। ছবিটি একটি প্রতীক হয়ে থেকেছে একই ধরণের সমস্ত পরিস্থিতির জন্য।
ক্যামিল পঁসা পরিচালিত “লা কমবাতন্ত” বা “যোদ্ধা” জীবনের এক মর্মস্পর্শী গল্প। প্যারিসে বসবাসকারী মারি জোসে তুবিয়ানা একজন নব্বই বছরের বৃদ্ধা নৃতত্ত্ববিদ। ইনি পশ্চিম সুদানের দারফুর অঞ্চল সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর বসার ঘরে রোজই লোক আসে, তবে খোশগল্পে মেতে থাকার জন্য নয়, বরং তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ ও সাহায্য নিতে। এঁরা সকলেই ২০০৩ সাল হতে দারফুরে চলমান বীভৎস গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন। তাঁরা যখন ফ্রান্স সরকার থেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে প্রত্যাখাত হয়, শেষ আশ্রয় হিসেবে মারির কাছে আসেন। মারি তাঁদের উপর ঘটে যাওয়া সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শোনেন; তাঁদের প্রশ্ন করেন, এবং নোট নেন। এভাবে তিনি তাঁদের গল্পটি তৈরি করে দেন, এবং এর সমর্থনে সম্ভাব্য সমস্ত দলিলপত্রাদি যোগাড় করে সংযুক্ত করে দেন, যাতে করে ফ্রান্স সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয় দানকারী বিভাগ সংশ্লিষ্ট হতাভাগ্য লোকদের আশ্রয় দেয়।
“ড্রিম ইয়োর মিউজিয়াম” বা “নিজের জাদুঘর কল্পনা করো” ভারতের খন্দকার ওহিদা পরিচালিত চরম পরম দৃষ্টিসুখকর এক না–গল্প। যেন একটি কবিতা বা চিত্রকর্ম। যেন ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ছড়িয়ে গেছে; গড়িয়ে গেছে; নেচে বেড়িয়েছে বিনা কারণে; নিছক আনন্দে। আসলেই কি তাই? সরাসরি বলে না দিলেও এক তীব্র বিষাদ আমাদের হৃদয়ে ঘা না মেরেই পারে না। ছবিটির আত্মা ধারণ করে আছে “মানুষের মূল লড়াই তো বিস্মরণের বিরুদ্ধে”–এই বোধটি। পরিচালকের সাথে তাঁর চাচার বাল্যকালের কথোপকথনে একটি শিশুকন্যাকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করা হয়। এতে আমরা সহজেই বুঝে উঠি কিভাবে স্মৃতি নিয়ে পরিচালকের ভাবনার বীজ শৈশবেই রোপিত হয়। পুরানো সকল কিছুই যেন হারানো না হয়ে পড়ে এই আকুলতা এই ছবির ফ্রেমে ফ্রেমে। জাদুঘরগুলোর কাজ হচ্ছে এইসব স্মৃতি সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা। কিন্তু একজন মানুষের কাছে যেসব স্মৃতি মূল্যবান, সমষ্টির কাছে বা রাষ্ট্রের কাছে তা মূল্যবান না–ও হতে পারে। যে কোনো এলাকার সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র সংখ্যক (ক্ষুদ্র নয়) নৃগোষ্ঠীর স্মৃতিরক্ষা কোনো না কোনোভাবে তাঁদের নিজেদের টিকে থাকার সাথে জড়িত। তাই সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর যে স্মৃতি সংরক্ষণ করে, তা সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল নয় মোটেই। তাই শেষে চাচার কণ্ঠে শোনা যায়: আমার জাদুঘর তো চাঁদে। অর্থাৎ এই মাটির পৃথিবীতে আমার জাদুঘর নেই; সেটি কোনো এক কল্পরাজ্যে! কাহিনীটা ভারতের হলেও সারা দুনিয়াতেই কি আমরা একই জিনিস দেখছি না? আমাদের নিজেদের দেশে কী দেখি আমরা? এই ছবিটি আমাদের অনুভব করালো: সব তরল করে বলে না দিয়েও অনেক কথা বলে ফেলা যায়। বরং স্রেফ গল্পের শরীরেই যে সমস্ত কিছু আমরা নগদে বুঝে নিতে চাই, সারা দুনিয়া যে গল্পে চলছে, এতে কত কিছুই না আমরা হারিয়ে ফেলি। এই চলচ্চিত্রটি দেখে ডকুমেন্টারি ছবির সীমানা নিয়েও চিন্তিত না হয়ে পড়ে উপায় থাকে না। কী হয়েছে বা কী ঘটেছে বা কারা দায়ী– এসব কিছুই বললাম না, কিন্তু অনুভূতিটার অনুবাদ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম।
সামছুল ইসলাম স্বপনের “লতিকা” সিনেমাটির পটভূমি নড়াইল জেলার চিত্রা নদীর পাড়ের অসহ্য সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ; সেটা উপভোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে যখন পর্দায় দেখা যায় মালো সমপ্রদায়ের সংগ্রামী এক পরিবারের দুর্দশার করুণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হয়। লতিকার স্বামী ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করা জেলে। তাঁদের দুই সন্তান, বয়স্ক মা ও ছয়টি ভোঁদড়। নদীতে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। কিভাবে কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবীরা পেশা বদলে ফেলছে, তার একটা শৈল্পিক দলিল এই ছবিটি।
আসমা বীথির “দপ্রুঝিরি” প্রকৃতি–পরিবেশ নিয়ে এক জরুরি ডকুমেন্টারি। ছবিটির দুটো অংশ। প্রথম অংশ পাহাড়ি ম্রো জনগোষ্ঠী ও নিসর্গের এক অপূর্ব ঐকতান যেন, যেনবা কবিতা! দ্বিতীয় অংশটি ক্ষুদ্র; কিভাবে সেই অপূর্ব ঐকতানের সুরে ছন্দপতন ঘটছে, এবং তার কারণ অনুসন্ধানে অনেকটা অপরাধ প্রতিবেদকের মতো দক্ষতা দেখান পরিচালক। আমরা সাক্ষী হয়ে থাকি কীভাবে ধীরে ধীরে হাতের কাজের সবল জায়গাটি যন্ত্রের অধীন হয়, সেই অধীনতার সাথে সমস্ত প্রেক্ষাপট পালটে যেতে থাকে। পাল্টে যাওয়া দৃশপটের বিপক্ষে পরিচালক কিছু প্রতীকী ইমেজ ব্যবহার করে দর্শকের অনুভূতিকেই সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন যেন।
“জাফরুল্লাহ, আ পিপলস ডক্টর” ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবন ভিত্তিক প্রমাণ্য চলচ্চিত্র। ফরাসি–বাংলাদেশি পরিচালক আমিরুল আরহাম এই মহৎ জীবনকে ধরার চেষ্টা করেছেন। ছবিটির এটিই সর্বপ্রথম প্রকাশ। তবে পরিচালক জানান: এটি খসড়া, মূল কাজের পোস্ট প্রোডাকশন চলছে।
“ল্য লিয়েম্বা” এখনো সচল শতাধিক বছরের জাহাজ নিয়ে চলচ্চিত্র। এই ছবির নায়কও এই জাহাজ। বিচিত্র ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের আনাগোনা আলাদা একটা প্রাণ দিয়েছে এই জাহাজকে। এটিই কি এই দুনিয়ার সবচেয়ে সচল পুরনো জাহাজ? কী করে এই জাহাজটি এতদিন টিকে থাকল? এই জাহাজ যারা চালায়, তাদের যাপন কেমন? জুলি ক্ল্যাভিয়ের এই ছবির মাধ্যমেই উৎসবের এই আসরের যবনিকাপাত হয়।
সীমিতভাবে আরম্ভ হলেও চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রচুর সম্ভাবনা জাগিয়ে গেল এই উৎসব। নানান অপূর্ণতা ও ত্রুটির কথা মাথায় রেখেও পরিশেষে ইতিবাচক কণ্ঠে বলতে চাই, এই উৎসব যেন প্রকৃত আন্তর্জাতিকতার সুরে ও স্বরে চট্টগ্রামকে ঋদ্ধ করে ও চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতকে যুক্ত করে।