দেশের বাজারে শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম চলছে। শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম শুরু হয় মূলত আগস্ট মাস থেকে। সেটি শেষ হয় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এসে। শুষ্ক মৌসুম হচ্ছে শুটঁকি উৎপাদনের মোক্ষম সময়। তাই এখন শুঁটকি পল্লীগুলোতে শ্রমিকদের দম ফেলার ফুসরত নেই। তবে শুঁটকি উৎপাদকারীরা বলছেন, সরকারের নজরদারির অভাবে শুঁটকি উৎপাদনকারীরা ভালো নেই। বিশেষ করে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য তাদের নির্দিষ্ট কোনো জমি নেই। বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে বাৎসরিক চুক্তি করে জমিতে অস্থায়ী ঘর ও মাচান তেরি করে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ করছেন তারা। প্রায় পুরো বছর শুঁটকি উৎপাদন করে আবার বিপণন পর্যায়ে আড়তদারদের ওপর অতি নির্ভরশীলতার কারণে তাদের কাছে এক প্রকার জিম্মি হয়ে যাওয়ার অভিযোগও করছেন তারা। আড়তদাররা সিংহভাগ টাকা বকেয়া রেখে তাদের কাছ থেকে শুঁটকি নিয়ে যাচ্ছেন, ফলে অত্যন্ত কম মুনাফা করে কোনোমতে টিকে আছেন বলে জানান শুঁটকি উৎপাদনকারীরা। অন্যদিকে শুঁটকি আড়তদাররা বলছেন, শুঁটকি উৎপাদনকারীদের অভিযোগ আসলে সঠিক নয়। প্রতি মৌসুমে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে কোটি কোটি টাকায় বাকিতে শুঁটকি বিক্রি করতে হয়। এখন আমাদের তো অনেক টাকা বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে আটকে আছে। এটিই ব্যবসার নিয়ম।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের তিনটি বৃহৎ শুঁটকিপল্লী হলো ইছানগর, চরপাথরঘাটা ও উত্তর বাকলিয়ার ক্ষেতচর। কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী হওয়ায় এসব জায়গায় মাছ পরিবহন ও শুঁটকি বাজারজাত করা অনেক সহজ। প্রতিদিন কয়েকশ মাচান ও বাঁধা বাঁশে ঝুলিয়ে শুঁটকি শুকানো হয়। সাগর থেকে আসা মাছ প্রক্রিয়া শেষে সরাসরি শুকানোর কারণে শুঁটকির মানও থাকে অটুট। এদিকে গতকাল নগরীর বাকলিয়ার বাস্তুহারা এলাকার শুঁটকি পল্লী ঘুরে দেখা গেছে, বাঁশের মাচানের ওপর বসে শুঁটকি শুকানোর কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। এছাড়া পুরুষ শ্রমিকেরা মইয়ের মতো বাঁধা উচু বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে ছুরি, লাক্কা, লইট্টাসহ বিভিন্ন ধরনের শুঁটকি ঝুলিয়ে শুকানোর কাজ করছেন, এ কাজে আরো কয়েকজনকে সহায়তা করতে দেখা যায়। আর ছোট প্রজাতির মাছের মধ্যে ফাইস্সা, চিংড়িসহ নানা ধরনের পাঁচ মিশালী মাছের শুঁটকি মাচানে শুকানো হচ্ছে। অন্যদিকে নারীদের একটি দল শুকানোর আগে কাঁচা মাছের নাঁড়িভূড়ি পরিষ্কার করছেন, পরবর্তীতে পুরুষ শ্রমিকেরা সেইসব মাছ এক জায়গায় জড়ো করে লবণ দিয়ে শুকানোর উপযোগী করে তুলে তারপর মাচান কিংবা বাঁশে ঝুলিয়ে রাখছেন।
আলী হোসেন নামের একজন শ্রমিক বলেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে বিক্রির জন্য তৈরি করতে তিন থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। এখন শুঁটকি উৎপাদনের মৌসুম, তাই আমরা গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছি। চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র শুঁটকি উৎপাদন–বিপণন সমবায় সমিতির সহ–সভাপতি মোহাম্মদ মুসা সওদাগর দৈনিক আজাদীকে বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে শুঁটকি উৎপাদনের সাথে জড়িত। আমি পৈত্রিক সূত্রে এই ব্যবসা করছি। তবে দুঃখজনক হচ্ছে– শুঁটকি উৎপাদনের জন্য আমাদের নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই। সরকার যদি কোনো জায়গা আমাদেরকে দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা দেয়, তবে আমরা শুঁটকি উৎপানকারীরা নিশ্চিন্তে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারতাম। এখন বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বাৎসরিক চুক্তিতে জমি নেয়ার কারণে আমাদের স্থানও নির্দিষ্ট থাকছে না। এছাড়া শুঁটকি উৎপাদনে যেভাবে খরচ বেড়েছে, আমরা সেভাবে মুনাফা করতে পারছি না। আমরা আবার আছদগঞ্জের আড়তদারদের কাছেও জিম্মিও। তারা আমাদের কাছ থেকে এক লাখ টাকার শুঁটকি কিনলে টাকা দিচ্ছে মাত্র ৫ হাজার টাকা। এভাবে অনেক টাকা তাদের কাছে বকেয়া থেকে যাচ্ছে। এতে আমরা ব্যবসা করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। তবে ফিশারিঘাট থেকে বাকিতে মাছ নিতে পারার কারণে আমরা কোনোমতে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি।
এদিকে গতকাল আছদগঞ্জের শুঁটকিপট্টিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতি কেজি লইট্টা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৫০০টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার ৩০০টাকা পর্যন্ত। এছাড়া বাটা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা থেকে ৮০০টাকা, ছুরি শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৩০০টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার ৪০০ টাকা, চিংড়ি শুঁটকি প্রতি কেজি ৩০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, রূপচান্দা শুঁটকি ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা, লাক্কা শুঁটকি ২ হাজার ২০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং ফাইস্সা শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
আছদগঞ্জের শুঁটকি ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বলেন, শুঁটকির চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দাম বেড়েছে। গত ২ বছরে দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তাই গরীব ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকজন এখন আর শুঁটকি কিনতে পারছে না।
চট্টগ্রাম শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওসমান হায়দার দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে যে পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদিত হয়, তার মোট চাহিদার ৪০শতাংশের মতো যোগান দেয়। বাকি ৬০শতাংশ শুঁটকি বাইরে থেকে আমদানি হয়। আমাদের দেশে আমদানিকৃত শুঁটকির একটি বড় অংশ আসে ভারত ও মিয়ানমার থেকে। এছাড়া পাকিস্তান থেকেও কিছু শুঁটকি আসে। শুঁটকি আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর কারণে দামে প্রভাব পড়ছে। আমদানির শুঁটকিতে শুধুমাত্র শুল্কহার বেশি হওয়ার কারণে প্রতি কেজিতে ১২০ টাকা পর্যন্ত বেশি গুণতে হচ্ছে। এছাড়া মিয়ানমার থেকে এলসি (ঋণপত্র) খুলে সরাসরি আমরা শুঁটকি আমদানি করতে পারি না। এখন আমাদের মিয়ানমারের শুঁটকি আমদানি হচ্ছে সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে। এতে আমাদের অতিরিক্ত ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে ৫৩ শতাংশ। তাই এখানে যদি ২০ শতাংশ শুল্কহার বাদ দেয়া যায়, তবে আমদানিমূল্য কমে যেত, আমরা কম দামে শুঁটকি বিক্রি করতে পারতাম।












