চট্টগ্রামের শিল্প খাতে দুই হাজার বিদেশি

মেধা যায় বিদেশে, পাশাপাশি হাজার কোটি টাকাও মেধাবী সন্তানরা দেশে ফিরেন না কেন

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের শিল্প খাত হাজার দুয়েক বিদেশির ওপর নির্ভরশীল। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি এবং দক্ষতা অর্জন করেও দেশে না ফেরায় দেশের বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের সিইও, ভাইস প্রেসিডেন্ট কিংবা জেনারেল ম্যানেজারের মতো পদগুলোতে বিদেশি লোকজনকে বসাতে হচ্ছে। দেশের মেধা দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে প্রতি বছর দেশ থেকে চলে যাওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা করা সম্ভব হতো বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, আমাদের এক কোটি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রম বিক্রি করে যে রেমিটেন্স অর্জন করেন, মাত্র কয়েক হাজার বিদেশি তার একটি বড় অংশ নিয়ে যায়। দেশের মেধা দেশে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া গেলে এই টাকা রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এখনো অন্তত দুই লাখ শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে পড়তে যান। তারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, মালয়েশিয়া, চীন, জাপানসহ নানা দেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। কেবল আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৫ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। এসব শিক্ষার্থীর অন্তত ৭৫ শতাংশ বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, গণিত ও প্রকৌশলসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যয়ন করছেন। একইভাবে ইংল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, জাপান, রাশিয়া ও ভারতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশ গ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স কোর্স শেষে সংশ্লিষ্ট দেশে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে। যেসব দেশে সুযোগটি সীমিত সেখানে নানাভাবে কষ্ট করে হলেও দেশের মেধাবী সন্তানরা থেকে যাচ্ছেন। কেউ কেউ নাগরিকত্বের আশায়, কেউবা সামাজিক নিরাপত্তাসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অনেকে বিদেশে কষ্ট করছেন, জীবনজীবিকা নিয়ে টানাপোড়েনে রয়েছেন। কিন্তু তাদের সিংহভাগ দেশে ফিরছেন না। দেশে ভালো চাকরির নিশ্চয়তা না থাকা, জীবনমানের অনিশ্চয়তা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, চাকরির দুর্বল বেতন কাঠামোসহ নানা কারণে বিদেশ থেকে ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষার্থীদের দেশে ফেরার পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়েছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, দেশে সরকারি চাকরির নিয়োগে বছরের পর বছর দুর্নীতি হয়েছে। এছাড়া এই চাকরি সীমিত। আবার বেসরকারি খাতেও ভালো নিয়োগ পাওয়া যায় না। নিয়োগ পেলেও বেতন কাঠামো সন্তোষজনক নয়। বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আসা একজন প্রকৌশলীকে নিয়োগ দেওয়ার সময় বিভিন্ন শিল্পগ্রুপে ৩০/৪০ হাজার টাকা বেতন অফার দেওয়া হয়। আবার অনেকের উদ্যোক্তা হওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতিসহ পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা থাকে না। ফলে শিক্ষাগ্রহণ শেষ হলেও বিদেশে থেকে যান।

বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া মেধাবী সন্তানরা দেশে ফিরে না আসায় দেশের শিল্পখাতের শীর্ষ পদগুলোর অধিকাংশ বিদেশিদের হাতে রয়েছে। চট্টগ্রামেও একই চিত্র বিরাজ করছে। হাজার দুয়েক বিদেশি বিভিন্ন শিল্প কারখানার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে ছয় থেকে সাত ডিজিটের বেতনে কাজ করছেন। এদের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ, দেশিবিদেশি যৌথ বিনিয়োগ এবং দেশীয় বিনিয়োগের শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

চট্টগ্রাম ইপিজেডে ৩৫০ জনের মতো বিদেশি ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছেন। এর বাইরেও কিছু বিদেশি রয়েছেন। যারা বিভিন্ন কারখানার যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ এবং আফটার সেলস সার্ভিস দিতে চট্টগ্রামে এসে কয়েকদিন থেকে চলে যান। চট্টগ্রামের বিদেশি কারখানাগুলোর সবগুলোর শীর্ষ পদে রয়েছেন বিদেশি নাগরিক। দেশীয় এবং যৌথ বিনিয়োগে গড়ে তোলা কারখানাগুলোতে শীর্ষ পদে অনেক বিদেশি কাজ করেন। কর্ণফুলী ইপিজেড এবং কোরিয়ান ইপিজেডেও শীর্ষ পদে রয়েছে বিদেশিদের আধিক্য। শুধু ইপিজেড নয়, চট্টগ্রামের বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলোতেও বিদেশি লোকজন শীর্ষ পদে কাজ করছেন।

সরকারি হিসেবে চট্টগ্রামে চীনের ৫৫০ জন, ভারতের ৪২০ জন, কোরিয়ার ৩০০ জন, শ্রীলঙ্কার ২৫০ জন লোক কাজ করেন। এছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের হাজার দুয়েক মানুষ চট্টগ্রামের শিল্পবাণিজ্যসহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) থেকে অনুমোদন নিয়ে বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশিরা কাজ করছেন।

বিডার দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা গতকাল জানান, দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেও অনেক বিদেশি কাজ করছেন। সারা দেশে এই সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। এছাড়া বিভিন্ন এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও কিছু বিদেশি কাজ করছেন; যা বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসা দেশের সন্তানরা করতে পারেন।

দেশের শিল্প বিনিয়োগ এবং মানবসম্পদ নিয়ে সংশ্লিষ্ট একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, এই দুই হাজার মানুষ চট্টগ্রাম থেকে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা রেমিটেন্স নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। এদের বেতন পরিশোধ করতে হয় ডলারে। এদের কেউ ছয় ডিজিটের নিচের বেতনে কাজ করছেন না। আমাদের শ্রমিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনেন, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশ থেকে বিদেশিরা রেমিটেন্স হিসেবে নিয়ে যাচ্ছেন।

বিদেশি লোকবল নিয়োগের ব্যাপারে চট্টগ্রামের একটি শিল্প গ্রুপের মালিক বলেন, এরা প্রচুর পরিশ্রম করেন। সময় নষ্ট করেন না। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। বৈদেশিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এরা দক্ষ। ইংরেজিতে দক্ষতা অসাধারণ। তাই এদের বিকল্প দেশ থেকে নেওয়া সম্ভব হয় না।

তিনি বলেন, দেশের অনেক গ্র্যাজুয়েট এবং মাস্টার্স করা প্রকৌশলীকে দুই পাতা ইংরেজি লিখতে বললে পারেন না। বিদেশিদের সাথে বৈঠক করতে বললে ভয় পান। যোগ্য লোক পেলে আমরা বিদেশিদের নিয়োগ দিতাম না। তিনি আরো বলেন, আগে আমাদের এখানে অনেক বেশি বিদেশি কাজ করতেন। যেগুলো সম্ভব সেগুলোতে দেশের ছেলেমেয়েদের নিয়োগ দিচ্ছি। ক্রমান্বয়ে বিদেশির সংখ্যা কমে আসছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে আগে বহু বিদেশি ছিলেন। এখন অনেকটা কমে গেছেন।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ আজাদীকে বলেন, শিল্প এবং বাণিজ্য খাতে যে ডিমান্ড তার সাথে আমাদের এডুকেশন সিস্টেমের মিল নেই। কাজের ডিমান্ড অনুষায়ী কারিকুলাম না সাজালে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যেসব গ্র্যাজুয়েট প্রতি বছর বের হন তাদের অনেকেই এই খাতের ডিমান্ডগুলো পূরণ করতে পারছেন না। তাই বিদেশিদের মাধ্যমে কাজ করাতে হচ্ছে। তিনি শিক্ষা কারিকুলাম সাজানোর প্রস্তাব করেন। বিদেশ থেকে ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষার্থীদের দেশে না ফেরার পেছনে আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক, জীবনমানসহ নানা কারণ রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।

চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সোবহান জানান, চট্টগ্রাম ইপিজেডে সাড়ে তিনশর মতো বিদেশিকে কাজ করার ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি দেশীয় কোম্পানিতেও বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। অবৈধভাবে কোনো বিদেশির ইপিজেডে কাজ করার সুযোগ নেই। বিভিন্ন শিল্প কারখানার মেশিনারিজের শতভাগই আমদানি নির্ভর। এসব মেশিনের সমস্যা হলে বিদেশিরা এসে ঠিক করে দিয়ে যান। তারা সাময়িক সময়ের জন্য আসেন এবং কাজ শেষ করে চলে যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ ৯ মামলায় শ্যোন এরেস্ট
পরবর্তী নিবন্ধঐক্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়াটা জরুরি : প্রধান উপদেষ্টা