চট্টগ্রাম শহরের হৃদয়ে অবস্থিত লালদিঘি শুধু একটি জলাধার নয়, এটি বন্দরনগরীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এক প্রতীকী স্থান। চট্টগ্রামের প্রাচীন নগরকেন্দ্রের সঙ্গে এর সংযোগ এতটাই গভীর যে, লালদিঘির নাম উচ্চারিত হলেই ভেসে ওঠে বন্দরনগরীর রাজনৈতিক সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক চর্চা ও নাগরিক জীবনের এক বিশেষ পর্ব।
চট্টগ্রাম নগরের হৃৎকেন্দ্রে অবস্থিত লালদিঘি একটি দিঘি ও তার পাশের মাঠকে ঘিরে গড়ে ওঠা সামাজিক–রাজনৈতিক স্মৃতিস্তম্ভ। কার্তিকের রোদে যেমন জলে সোনালি রেখা পড়ে, তেমনি দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই জলাশয় ও উন্মুক্ত মাঠে পড়ে আছে বন্দরনগরের ইতিহাসের প্রতিচ্ছায়া।
অবস্থান ও ভৌগোলিক প্রেক্ষিত: লালদিঘি কোতোয়ালী থানা এলাকায় (জেল রোডের প্রান্তে), আন্দারকিল্লার কাছাকাছি। প্রায় ২.৭০ একর জায়গা জুড়ে দিঘিটি; চারপাশে প্রশাসনিক দফতর, ব্যাংক ও জনপথ। দিঘির পাশে যে উন্মুক্ত প্রান্তর এটি ‘লালদিঘি ময়দান’ নামে ঐতিহাসিক সমাবেশস্থল হিসেবে খ্যাত।
নামের উৎপত্তি: ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রাম দখলে নিলে, তৎকালীন এনতেকালি কাচারির (বর্তমান মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিস) ভবনটি লাল রঙে রঞ্জিত থাকায় ‘লালকুঠি’ নামে পরিচিত হয়; তার পূর্বদিকে লাল রঙে রঙ করা জেলখানা ‘লালঘর’ নামে খ্যাতি পায়। এই দুই লালচে প্রশাসনিক স্থাপনার পাশের ছোট জলাশয়টি ব্রিটিশ আমলেই সম্প্রসারিত হয়ে বড় দিঘিতে পরিণত হয়। আর সেই থেকেই নাম ‘লালদিঘি’।
উৎপত্তি ও নামকরণ: ব্রিটিশ শাসনের প্রারম্ভে এলাকাটিকে বড় আকারের ‘দিঘি’ হিসেবে রূপ দেওয়া হয় এবং আশেপাশে স্থাপিত প্রশাসনিক অবকাঠামো লালকুঠি (তৎকালীন পুলিশ সদরদপ্তর) ও লালঘর (কারাগার) থেকে ‘লালদিঘি’ নামটি প্রচলিত হয়। সময়ের সঙ্গে চারপাশে মাঠ, মেলা ও জনসমাবেশের জন্য উন্মুক্ত পরিসর গড়ে ওঠে, যা পরে ‘লালদিঘি ময়দান’ নামে পরিচিতি পায়। লালদিঘির নামকরণের পেছনে চট্টগ্রামের মানুষের মুখে একটা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। একবার এক দিনমজুরের মেয়ে ঐ দিঘিতে গোসল করতে নেমেছিলো। হঠাৎ পায়ে শিকল বেঁধে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো জলের নিচে একটা দেশে। আসলে ঐটা ছিলো এক বাদশার দরবার। সেই বাদশার বিয়ে ঠিক হয়েছিল লাল বেগমের সাথে। একদিন বাদশা লাল বেগমকে দেখতে চাইলেন কিন্তু খবর পাওয়া গেলো লাল বেগম তার মুল্লক থেকে এক ক্রীতদাসের সাথে পালিয়েছে। এ খবর বাদশা তখন জানতেন না। তাই মজুরের ঐ মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে বাদশার সাথে লাল বেগমের অভিনয় করার জন্য। অনেক কথা প্রসঙ্গে বাদশা মেয়েটার আসল পরিচয় জেনে যায়। ক্ষুদ্ধ বাদশার নির্দেশে সবাই আসল লাল বেগমকে খুঁজতে লেগে গেলো। তখন জানা গেলো সে আন্দরকিল্লার দিঘি থেকে দু’শ হাত দূরে পর্তুগীজদের কিল্লায় আছে। বাদশা ঐ কিল্লায় আক্রমণ করে। অনেক অনেক খুনে লাল হয়ে গেলো দিঘির পানি। বাদশা পরাজিত হল সেই যুদ্ধে। সবাই পালিয়ে গেল। তবুও সে দিঘির পাড়ে বাদশা থেকে গেল লাল বেগমকে উদ্ধার করার আশা নিয়ে। আরেকটি ধারণা প্রচলিত আছে লোকমুখে। ইংরেজ শাসনামলে এক লাল মেমসাহেবের নির্দেশে অথবা তাঁর স্মরণে এই দিঘিটি খনন করা হয়েছিল। সেই থেকেই নামকরণ হয় ‘লালদিঘি’। তবে স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, কখনও কখনও পানির রঙ লালচে দেখা যেত, সেই সূত্রেও নাম হতে পারে লালদিঘি।
ঔপনিবেশিক ও প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা: ব্রিটিশ শাসনে লালদিঘির পাড় ঘিরে বিভিন্ন কেরানিখানা ও বিচার–প্রশাসনিক কার্যক্রম চলত। পশ্চিম তীরে ‘রিকেটস ঘাট’ নামে একটি ঘাটের উল্লেখ মেলে।
দিঘির উত্তর পাড়ে একটি শাহী জামে মসজিদের গম্বুজে ১৯৩৯ সালের তারিখ খোদাই করা আছে। পরবর্তীতে দিঘির হেফাজতের দায় সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের অধীনে যায়। এ তথ্য লালদিঘির সামাজিক মালিকানা ও রক্ষণাবেক্ষণের ধারাবাহিকতাকে প্রমাণ করে।
লালদিঘির মালিকানা: লালকুঠি ও লালঘর এর কাছেই অবস্থিত একটি পুকুরকে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে পরিবর্ধন করে দিঘিতে রূপান্তর করা হয়। তখন থেকে দিঘিটি লালকুঠি ও লালঘরের নাম অনুসারে লালদিঘি নামে পরিচিত লাভ করে। লালদিঘির উত্তর পাশে রয়েছে একটা মঠ যার গায়ে ইংরেজিতে লেখা ‘রায় বাহাদুর রাজকুমার ঘোষ স্কয়ার: ১৯৩৯’। উল্লেখ্য, রায় বাহাদুর ছিলেন একজন জমিদার। তার নিজ বাড়ি ছিল রাউজান উপজেলার চিকদাইর গ্রামে। তিনি অবসর সময় কাটাতেন তখনকার খোলামেলা লালদিঘির পাড়ে। তিনি ছিলেন লালদিঘির অভিভাবক। পরবর্তিতে তিনি দিঘিটির মালিকানা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেন।
জনজীবন, মেলা–উৎসব ও ক্রীড়া: লালদিঘি ময়দান চট্টগ্রামের বৃহৎ এবং ঐতিহাসিক সমাবেশস্থলগুলোর একটি; নাগরিক জীবনের বহু মেলা, ধর্মীয়–সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও জনসভা এখানে হয়েছে। শহরের বৃহৎ পুকুরগুলোর মধ্যে লালদিঘি উল্লেখযোগ্য এটি রক্ষার জন্য নাগরিক–পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের কথাও নথিভুক্ত আছে।
জব্বারের বলিখেলা: চট্টগ্রামের লোকঐতিহ্যের উজ্জ্বল প্রতীক ‘জব্বারের বলিখেলা’ ১৯১০ সালের ১২ বৈশাখে প্রথম আয়োজন হয় লালদিঘির পাড়ে; তারপর থেকে বৈশাখে নিয়মিত এই কুস্তি–উৎসব শহরের পরিচয়ে মিশে গেছে।
রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী: লালদিঘি ময়দান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধপর্বের নানা গণসমাবেশের স্মৃতি বহন করে।
নগরায়ণ, সংরক্ষণ ও বর্তমান: তীব্র নগরায়ণের চাপে বন্দরনগরের বহু জলাশয় বিলুপ্ত হলেও লালদিঘি এখনো টিকে আছে; চারদিকে প্রাচীর, পার্ক–ঘেরা এই জলাশয় ও ময়দান আজও নাগরিকদের অবসর, উৎসব ও রাজনৈতিক অভিব্যক্তির প্রাণকেন্দ্র।
লালদিঘি কেবল একটা জলাশয় নয় এটি চট্টগ্রামের নাগরিক স্মৃতি, সংগ্রাম, উৎসব ও আধ্যাত্মিকতার সমবায়। লালকুঠি–লালঘরের ঔপনিবেশিক স্মৃতি, বলিখেলার লোকরস, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায় সব মিলিয়ে লালদিঘি আমাদের নগর ইতিহাসে এক বিরল জলচিহ্ন।
লেখক: সহ–সম্পাদক, দৈনিক আজাদী।