চট্টগ্রামের ফুড কালচার

বাসুদেব খাস্তগীর | মঙ্গলবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

সংস্কৃতির রূপ বৈচিত্র্য বিচিত্র রকমের। একটি সমাজ ব্যবস্থায় মানুষেরা প্রতিনিয়ত যে অভ্যাস, রুচি, পোশাকআশাক, বিশ্বাস নীতিনৈতিকতা, মূল্যবোধ, আচরণ,খাদ্যাভাস, নন্দনচর্চা, ইতিহাস ঐতিহ্যের সব কিছুকে ধারণ করে চলে সেটাকে সে অঞ্চলের সংস্কৃতি বলা যায়। অঞ্চলভেদে সংস্কৃতির পার্থক্য হয়। দেশে দেশে যেমন পার্থক্য হয় আবার একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যেও সংস্কৃতির ভিন্নতা দেখা যায়। সংস্কৃতির বহমাত্রিকতার বিশ্লেষণ বড়ই গভীর। জাতিতে জাতিতেও সংস্কৃতির ভিন্নতা বেশ দৃশ্যমান। এই সংস্কৃতি একটি অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠে এবং এটির মাধ্যমে সে অঞ্চলের পরিচিতি ঘটে। সংস্কৃতিকে সে সমাজের মানুষ অত্যন্ত গৌরবের সহিত হৃদয়ে লালন করে। সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়া মানে তার নিজের শিকড়কে ভুলে যাওয়া। ঐতিহাসিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি মানুষের জীবন যাত্রাকে ভিন্ন এক মাত্রা দান করে। সে জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশে কোথাও যখন আমরা যাই সেখানের মানুষের কথাবার্তা, আচারআচরণ, খাবারদাবার, পোশাকপরিচ্ছেদসহ আমাদের যাপিত জীবনের নানা বিষয় নিয়ে একধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। যাদের অভ্যাস আছে তাদের কথা ভিন্ন, কিন্তু যাদের নতুন পরিবেশ বা সংস্কৃতির সাথে পরিচয় ঘটেনি তারা প্রথমে গিয়েই বিষয়টি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারেন। আরবের সংস্কৃতির সাথে বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের অনেক পার্থক্যসেটা অনেকেই উপলব্ধি করেন কিংবা এমনকি আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গেলেও তার প্রমাণ মেলে। যাহাই হোক সংস্কৃতি প্রত্যেকের কাছে নিজের শিকড়ের বিষয় বলে একধরনের অন্যরকম ভালোলাগা থাকে প্রত্যেকের। সংস্কৃতি দিয়ে একটি সমাজের পরিচয় টানা হয়। সংস্কৃতির প্রবাহমান ধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়। সংস্কৃতির নানা উপজীব্য বিষয়ের মধ্যে খাবারদাবারের ব্যাপারটা অন্যরকম একটি বিষয়। ভিন্ন ভিন্ন দেশ তো আছেই, একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে খাবারদাবার ও আদর আপ্যায়নের সংস্কৃতির যে ভিন্নতা তা গবেষণা করলে বিচিত্র রকমের ও চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলানিকেতন আমাদের প্রিয় চট্টগ্রাম। পাহাড়, নদী ও সাগরের এই চারণভূমি সংস্কৃতির অন্যতম সূতিকাগার। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের গানের খ্যাতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বেও বিস্তৃত। এ গান চট্টগ্রামের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। চট্টগ্রামের গানের মত চট্টগ্রামের সংস্কৃতির অন্যতম দিক তার খাবারদাবারও। উদার অতিথি পরায়ন হিসাবে চট্টগ্রামের মানুষের সুখ্যাতি আছে। আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। আর মাছে ভাতে বাঙালি হলেও তার মাছে ভাতে খাবার দাবারের মধ্যে অঞ্চলভেদে রয়েছে নানা বিচিত্র রকমের খাবারের সংস্কৃতি। খাবারের সংস্কৃতি একটি নির্দিষ্ট সমাজ, অঞ্চল, জাতির খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি বরং সেই সমাজ, অঞ্চল, জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস এবং জীবনযাত্রার পরিচিতিকে সামনে তুলে ধরে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চট্টগ্রামের খাবারের সংস্কৃতি খাবারের ঐতিহ্য, খাবারের রীতিনীতি, খাবারের সাথে সামাজিক সম্পর্ক বা কিছু প্রতীকী খাবারের মত সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে যা এ অঞ্চলেই বেশি দৃশ্যমান হয়। নানান মুখোরোচক খাবারের পাশাপাশি খাবারে বিশেষ ধরনের মশলা ও উপকরণের ব্যবহার এখানকার খাবারের সংস্কৃতিকে একটি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে রূপ দিয়েছে। চট্টগ্রামের খাদ্য শুধু রসনার বিষয় নয়, এটি চট্টগ্রামের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। চট্টগ্রামকে নানা খাবারের বৈচিত্র্যময় স্বাদ,পরিবেশনার ঢং, সামাজিক নানা আনুষ্ঠানিকতায় বিচিত্র রকমের খাবারের জন্য অন্য যে কোনো অঞ্চল থেকে আলাদা করা যাবে। এটি দীর্ঘদিন গড়ে ওঠা চট্টগ্রামের খাবারের সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের এ খাদ্য সংস্কৃতির সাথে আত্মীয়তা কিংবা বন্ধুত্বের যে মেল বন্ধন রচিত হয় তা আমাদের চট্টগ্রামের পরিচয়কে শুধু দেশে নয় বিশ্বের মধ্যেও আলাদাভাবে পরিচিতি দান করেছে। চট্টগ্রামের মেজবান দেশবিদেশ বহুল সমাদৃত একটি সামজিক অনুষ্ঠানের নাম। এই অনুষ্ঠানে যে মাংস দিয়ে খাবার তৈরি হয়, তা মূলত গরুর মাংস দিয়েই হয়। এই মেজবানির মাংসে মশলার যে মিশ্রণ তা একমাত্র মেজবানির রান্নাতেই হয়। মেজবানির মাংস সামাজিক উৎসবে পরিবেশন করা হয়। এর শুধু স্বাদ নয়, পরিবেশন প্রথায়ও আছে ভিন্ন এক দিক। এটি চট্টগ্রামের মানুষের গর্বের বিষয়। এছাড়া জনপ্রিয় কালাভুনা, যা মাংসের সাথে বিশেষ মশলার মিশ্রণে রান্না করা হয়, তা চট্টগ্রামের খাদ্য সংস্কৃতির একটি অন্যতম দিক। চট্টগ্রামের খাবার পরিবেশনার মধ্যেও আছে এক ধরনের আলাদা বৈচিত্র্য। বিশেষ করে মেজবান অনুষ্ঠান শুধু খাবারের অনুষ্ঠান নয়, এটি মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে এবং সামাজিক সম্পর্কের একটি চিত্রও তুলে ধরে। যে কোনো রান্নায় মশলার ব্যবহারের একটি জাদুকরি প্রভাব আছে। অঞ্চলভেদে সেটা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এখানে নানা মশলার পাশাপাশি লেবুর রস, সরিষা বাটা, লবণ ও তেলের মিশ্রণ খাবারের স্বাদকে অসাধারণ সুস্বাদুময় করে তোলে। এটি চট্টগ্রামের খাবারের অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন হোটেল সামাজিক অনুষ্ঠানের খাবারে এর পরিচয় মেলে। যে কেউ অন্য অঞ্চলের খাবারের সাথে তার পার্থক্য নিরূপন করে নিতে পারেন। চট্টগ্রামের সাগর তীরবর্তী একটি শহর। ফলে এখানে বিভিন্ন রকমের প্রচুর তরতাজা সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। এছাড়া সামুদ্রিক মাছ নির্ভর ইলিশ, শুঁটকি, নোনা ইলিশ এ অঞ্চলের খাদ্য সংস্কৃতিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। বাইরের থেকে লোক আসলে রসনা তৃপ্তিতে সবাই সাগরের এই বৈচিত্র্যময় মাছের স্বাদ দিতে উতলা হয়ে যান। আলাদা ধরনের মশলার সাথে মাছের স্বাদ হয়ে ওঠে অসাধারণ। মেজবানি মাংসের পরে চট্টগ্রামের একটি জনপ্রিয় খাবার দুরুস কুরা। এটি মূলত মুরগি দিয়ে তৈরি একধরনের খাবার। পুরো একটি মুরগি দিয়ে তৈরি করা হয় এই খাবার। চট্টগ্রামের ভাষায় মুরগিকে ‘কুরা’ বলে। চট্টগ্রামের খাবারের মধ্যে শুঁটকি অন্যতম। দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে শুটকি খাওয়ার প্রচলন আছে। কিন্তু শুঁটকির সূতিকাগার কিন্তু চট্টগ্রাম। শুঁটকি দিয়ে বাহারি পদের রান্না চট্টগ্রামের খাদ্য সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। ‘আখনি বিরিয়ানি’ চট্টগ্রামের জনপ্রিয় আর একটি খাবার। আখনি দিয়ে পোলাও রান্না করে আর আলাদা করে অন্য পাত্রে মাংস রান্না করে পোলাও সিদ্ধ হয়ে এলে দুটি উপকরণ ভালোভাবে মিশিয়ে তৈরি করা হয় ‘আখনি বিরিয়ানি’। চট্টগ্রামের অনেক সাধারণ হোটেলে এসব সুস্বাদু খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন যে কেউ। সময়ে সময়ে বিশেষ দিবসে চট্টগ্রামে বিভিন্ন সাধারণ হোটেল মোটেলসহ তিন তারকা পাঁচ তারকা হোটেলেও চট্টগ্রাম সংস্কৃতির এ ঐতিহ্যের খাবারগুলো পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এছাড়াও চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের খুবই পছন্দের একটি খাবার হলো ‘আডোরা’। মূলত আঠারো থেকে ‘আডোরা’ শব্দটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়। আডোরা তৈরি করা হয় আঠারো রকমের সবজি ও ডাল দিয়ে। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি পদের সবজিও থাকে। এটাকে অনেকে বৈশাখী খাবার বলে থাকেন। চট্টগ্রামের ভাষায় একে অনেকে ‘পাঁচন’ বলে। এসব খাবারের পাশাপাশি আরো নানা ধরনের খাবারের জন্য আমাদের চট্টগ্রাম বিখ্যাত। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিশেলে তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। যেমন ফিরনি, মহেশখালীর পান, সাধুর মিষ্টি, বোস ব্রাদার্সের মিষ্টি, হাইওয়ের সুইসটের মিষ্টি ও আলফাতুন হালুয়া অন্যতম। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ের কিছু মিষ্টি জাতীয় বিশেষ খাবারের নামও শোনা যায়। চট্টগ্রামের বাহারি তালের পিঠাসহ কাঁঠাল পাতায় মোড়ানো তালের পিঠা , বাখরখানি, গণি বেকারির বেলা বিস্কুটের কথাতো মানুষের মুখে মুখে। চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্যের অনবদ্য মিশেলে ঘরে বাইরে ভুনা খিচুড়ি, সাদা ভাত, ডাল, ডিম ডাল, বিফ কালিয়া, মুরগি রসা ভুনা, মুরগি কালো ভুনা, হাঁস রসা ভুনা, দেশি রুই মাছ ভুনা, ইলিশ ভাজা, লইট্রা ফ্রাই, লাক্ষা মাছের দো পেঁয়াজা, কোরাল মাছের দো পেঁয়াজা, চিংড়ির দো পেঁয়াজা, মুড়িঘন্ট, মাছ ভর্তা, আলু ভর্তা, ডিম ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, শুটকি ভর্তা, বেগুন ভর্তা ,টমেটো ভর্তা, ঢেঁড়স ভর্তা, তিতা করলা ভাজা, কুমড়ো শাক ভাজা, পালং শাক, কলমি শাক ভাজা ও মৌসুমী শাক ভাজার কথা সকলেই জানি। এগুলোর রন্ধন প্রক্রিয়ার রন্ধন শৈলীতে চাটগাঁইয়া শিল্প ও সংস্কৃতির এক বিশেষ অংশ দখল করে আছে। এখানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিশেষ বিশেষ খাবারেরও সুনাম আছে, যেমনদস্তগীর হোটেলের নলা, নেভালের কাঁকড়া আর পেঁয়াজু, বিহারী কলোনীর বটের কাবাব, চট্টগ্রামের পাহাড়ি খাবার, মেম্বার হোটেলের ভর্তা, মিসকিন শাহ হোটেলের গরুর মাংস, চনার ডাল, নিজাম হোটেলের লাক্ষা মাছ, ড্রাইবার হোটেলের বিফ কাবাব, কর্ণফুলীর পাড়ের সী ফুড আর কোরাল মাছের বারবিকিউ, ঈদ স্পেশাল কিমা ভুনাসহ আরো বাহারি খাদ্যে সমৃদ্ধ চট্টগ্রামের খাবার সংস্কৃতি। এছাড়া চট্টগ্রামের জামান হোটেল, কটুম বাড়ি, সবুজ হোটেল, স্টার রেস্টুরেন্ট, সিলভার সাইন, বীর চট্টলা ছাড়াও রয়েছে আরো অনেক মানসম্মত চাটগাঁইয়া ঐতিহ্যের খাবারের হোটেল। চট্টগ্রামের মিষ্টিজাত খাবারের জন্য বনফুল, ফুলকলি, মিষ্টিমুখ ও ওয়েল ফুডও বেশ পরিচিত নাম। অতিথি আপ্যায়নে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মিষ্টি বেশ সমাদৃত। মধুভাত হলো চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন খাবার। চাল, দুধ, নারকেল এবং চিনি দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। চট্টগ্রামে বিভিন্ন উৎসব আয়োজনকে কেন্দ্র করে মধুভাত তৈরি করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে কোনো কোনো জায়গায় মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে কলসি করে মধুভাত পাঠানোর রীতি রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের খাবার গ্রহণ এবং পরিবেশনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম কানুন থাকে যা সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। যেমন কিছু সংস্কৃতিতে একসাথে বসে খাবার খাওয়া হয়, আবার কিছু সংস্কৃতিতে আলাদাভাবে খাবার গ্রহণ করা হয়। চট্টগ্রামের মানুষ খুব সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। বিয়ে বা বিভিন্ন সামজিক অনুষ্ঠানে দেখা যায় অনেকে এক টেবিলে বসে খাবার খায়, এজন্য অনেকেই বন্ধু বান্ধব বা নিকট আত্মীয় স্বজনের জন্য অপেক্ষা করেন। আবার কোনো কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে নারীপুরুষ একত্রে আবার কোথাও কোথাও নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়। এই ধরনের ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার একসাথে খাবার গ্রহণ করলে পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। চট্টগ্রামের খাবার সংস্কৃতিতে কিন্তু এ ঐতিহ্যের পরিচয় মেলে। অনেক এলাকায় খাবার সংস্কৃতিতে খাবার নির্দিষ্ট উৎসব যেমন আছে, আচার বা অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ও আছে। যেমন, বাংলাদেশের বিয়েতে মিষ্টিমুখ করানো বা বাড়িতে নতুন গেলে মিষ্টি নেবার সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের মানুষকে অনেকেই বড় মনের মানুষও বলেন। কারণ তাদের অনেকের অর্থ বিত্ত না থাকলেও খাবারদাবার, অতিথি আপ্যায়নে তাদের জুড়ি নেই। কোথাও কারো বাড়িতে বা বাসায় নতুন গেলে খালি হাতে কেউ সহজে যান না। বিয়ের মত সামাজিক অনুষ্ঠানে এখানে কারো বাড়িতে গেলে মিষ্টি নিতে দেখা যায়, যা পাঁচ দশ কেজি থেকে বিশ কেজির ওপরেও, সাথে পানও নিয়ে যান দশ থেকে বিশ বিরার ওপর। পানের হিসাবকে চট্টগ্রামের ভাষার ‘বিরা’ বলে। এটা অন্য কোনো অঞ্চলে তেমনটি দেখা যায় না। আমাদের পাশ্ববর্তী দেশে দেখা যায় তারা কারো বাড়িতে গেলে তারা গণনা করে মিষ্টি নেন। আমাদের এখানে এ সংস্কৃতি খুব একটা দেখা যায় না। এটার অবশ্য ইতিবাচক দিকও আছে। আবার আমাদের দেশে দেখা যায় বিয়ের পরে মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে ছেলের বাড়িতে ফলের মৌসুমে প্রচুর ফল পাঠানো হয়, আবার এগুলোর কিছু অংশ সমাজে বিতরণও করা হয়। রমজানে সেমাই ইফতারি পাঠনোর রেওয়াজের পাশাপাশি, কোরবানির ঈদের সময় মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে গরু বা ছাগলও পাঠানোর সংস্কৃতি দেখা যায় কোনো কোনো জায়গায়। এ সংস্কৃতিগুলো উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তেও ছড়িয়েছে। সুশীল সমাজ এগুলোকে নেতিবাচক হিসাবেই দেখেন। যে দেশের সংস্কৃতি যে রকম সেভাবেই সেখানে আদর আপ্যায়ন ও খাবার দাবারের সংস্কৃতিও গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রতিটা অঞ্চলেরই আছে নিজস্ব খাবারের সংস্কৃতি ও রন্ধনশৈলী। চট্টগ্রামের অনেক হোটেলে সপ্তাহের বিশেষ একটি বা দুটি দিনে মেজবানির গোশতো বিক্রি করতে দেখা যায়। কোনো

কোনো হোটেলে মাটিরপাত্রে এসব খাবার পরিবেশনেরও ঐতিহ্য রয়েছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে ঐতিহ্যের সে বিষয়গুলো অনেক জায়গায় হারিয়ে যেতে বসেছে। চট্টগ্রামের প্রতিটা ঐতিহ্যবাহী খাবার এখনও সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষেতো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী চাটগাঁইয়া মানুষসহ অনেকের কাছে বেশ সমাদৃত। চট্টগ্রাম অঞ্চলের খাদ্য সংস্কৃতির ওপর বিশাল প্রভাব ফেলে চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থান। গবেষণায় দেখা যায় চট্টগ্রাম একটি বন্দর শহর হওয়ায় কারণে বিশ্বের অনেক দেশের সাথে এর যোগাযোগের ইতিহাস সুপ্রাচীন। বলা হয় এ কারণে পারস্য, আরব, এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মশলা ও রান্নার প্রভাব চট্টগ্রামের খাবারকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সমৃদ্ধি চট্টগ্রামের খাদ্য সংস্কৃতিকে একটি অন্য মাত্রা দিয়েছে। ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে চট্টগ্রামের খাবার সংস্কৃতি সামজিক সম্পর্ক ও বন্ধনের একটি চমৎকার অনুষঙ্গ। চট্টগ্রামের এই খাদ্য সংস্কৃতি আমাদের আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, গবেষক, কলেজ শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালির খাদ্যসংস্কৃতির স্মারক পান্তাভাত