চট্টগ্রাম পৌরসভার (বর্তমান সিটি কর্পোরেশন) সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজসেবক ও ক্রীড়া সংগঠক মরহুম ফজল করিমের ৪০ তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গত ২০ আগস্ট। দিনটি নীরবে চলে গেলো, অথচ তিনি দেশপ্রেম, সততা ও তাঁর সৃজনশীল কর্মের মাঝে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন। চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানেই বাংলাদেশের উন্নয়ন। হাজারো গুণী লোকের জন্মস্থান এ চট্টগ্রামে। যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে দেশের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন তাঁদের কথা জাতি দীর্ঘদিন শ্রদ্ধা ভরে আজও স্মরণ করছে। উনাদের জন্মই যেন হয়েছে মানুষের কল্যাণ সাধনে, মানবতার সেবায় নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে। যাঁরা আজীবন সংগ্রাম ও সাধনা করেন কীভাবে জনগণের সেবা করা যায় সেজন্যে। যাঁরা মানবতার কল্যাণে নিজের মেধা ও মননকে উজাড় করার মধ্যেই নিজের জীবনের সফলতা খুঁজে পান। মানুষ মানুষের জন্য‘ এ শ্লোগানই তাদের কর্মতৎপরতা ও অনুপ্রেরণার উৎস। এমন সোনার মানুষদের একজন জনাব ফজল করিম চেয়ারম্যান। চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম বাঙালি ও বেসরকারি চেয়ারম্যান ছিলেন খানবাহাদুর আমান আলী। ১৯০৮ সালে প্রথমে তিনি চট্টগ্রাম পৌর সভার ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১৯১৬ সালে প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। এর পূর্বে বৃটিশরাই প্রশাসক নিযুক্তি পেতেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মরহুম ফজল করিম সাহেব। এ জনপ্রিয় পৌর চেয়ারম্যান ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম পৌর সভা সিটি কর্পোরেশনে উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি জনগণের বিপুল ভোটে একাধিকবার নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান ছিলেন। চট্টগ্রাম শহরে সম্ভবত তিনিই প্রথম রিকশার লাইসেন্স চালু করেন এবং এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। অত্যন্ত সুন্দর স্মার্ট ভদ্র বন্ধু বৎসল, গরীব দরদী মানুষটির জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী। রিকশাওয়ালা, হকার, সুইপার সম্প্রদায় ও দিনমজুরদের তিনি শ্রদ্ধা ভালোবাসার পাত্র ছিলেন।
তাঁদের বাসার বাই লেইনটি এক সময় চেয়ারম্যান গলি হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। মরহুম ফজল করিম সাহেব এর আমলে চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যা কম ছিলো এবং একটি পরিচ্ছন্ন নান্দনিক সুন্দর শহর ছিলো। আজকের মতো পরিবেশ দূষণ, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণহীন ছিল না। রাস্তা ঘাটের যত্র তত্র, ফুটপাত, নালা–নর্দমার ওপর দোকান বাণিজ্য ছিলো না। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা জন সম্পদ আত্মসাৎ ও স্বজনপ্রীতির তেমন কোনো গুরুত্বর অভিযোগ শোনা যায়নি। একবার মনে আছে ওনার মেঝো সন্তান শাহীন ভাই এর সাথে খেলাধুলা নিয়ে সামনে আমাদের স্কুলের কিছু শিক্ষার্থীর ভুল বোঝাবুঝি হলে তিনি নিজেই তথায় হাজির হয়ে সন্তান তুল্য শিক্ষার্থী সহপাঠীদের ভুল বোঝাবুঝি নিমিষেই নিরসন করে দেন। নিজের সন্তানকেও শাসন করেন, পক্ষপাতিত্ব করেননি। আজকালকার প্রভাবশালী কেউ হলে কি হতো তা এখন আর ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না। অর্থাৎ তিনি কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার বা দাপট প্রদর্শন করেননি। চট্টগ্রাম সামাজিক জীবনের ঐতিহাসিক রূপান্তরে সেই সন্ধিক্ষণে নতুন আর পুরাতনের দ্বন্দ্বে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছিলো, সে নিরিখে চট্টগ্রাম পৌরসভায় ফজল করিমের নেতৃত্বের সাফল্য বিচার্য। ১৯২৫ সালে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু আন্দরকিল্লা নজির আহমদ চৌধুরী সড়কের এক (উপগলি)তে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ফজল উদ্দিন খান, যদিও আদি নিবাস পেশোয়ারে, ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামে আসেন। তিনি আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সম্মুখে ফলের ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল মডেল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশের পর খেলাধুলা এবং সমাজকর্মে আত্মনিয়োগ করেন এবং অচিরেই চট্টগ্রাম শহরে একজন নিঃস্বার্থ, অক্লান্ত সমাজসেবী হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন। তিনি প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ ওয়ার্ড থেকে সমাজসেবা শুরু করেন এবং তাঁর নেতৃত্বের সফল পরীক্ষায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে জনগণের ভোটে চেয়ারম্যান পদ লাভ করেন। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি হকি ও ফুটবল টিমের অধিনায়ক হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বার্মা ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান যাবার সুযোগ পান। খেলাধুলার সাথে সাথে জ্ঞান আহরণেও তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। ফজল করিম টেনিস, হকি, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, ফুটবল আর বিলিয়ার্ড প্রতিটি ক্ষেত্রেই একজন দক্ষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ক্রীড়াবিদ হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব অনেক। অবসরসময়ে তিনি নানা বইপুস্তক পড়তেন। ইংরেজি, বাংলা, উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায় তিনি বলতে ও লিখতে পারতেন। চট্টগ্রাম জিলা ক্রীড়া পরিষদ, আইনশৃঙ্খলা কমিটি, সমাজ কল্যাণ, কদম মোবারক এতিমখানা কমিটি, লায়ন্স ফাউন্ডেশন, প্রবর্তক সঙ্গ, পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সড়ক পরিবহন সমিতি, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আরো বহু সংগঠনের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন বিদ্যালয় ও ক্রীড়া সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। ১৮৬৩ সালের ২২ শে জুন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয়। চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম প্রশাসক ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. জে. ডি. ওয়ার্ড। তখন পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭ এবং আয়তন ছিল ৬ বর্গমাইল। ওয়ার্ড ছিল ৫টি আর এর নামকরণে পরিচয় ছিল এ, বি, সি, ডি, ই। মিঃ জে. ডি. ওয়ার্ড ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৭ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের পর আরো ৫ জন ইংরেজ প্রশাসকের নাম পাওয়া যায়। এরা হলেন মি. কার্কউড, মি. সি.এ.স্যামুয়েল, মি. এইচ.টি.এস কটন, মি. সি.এ.স্যামুয়েল, ক্যাপ্টেন এ আর এস এন্ডারসন ও মি. গুড। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেছেন ইংরেজরা। সে বছর প্রথম চেয়ারম্যান হন একজন বাঙালি। তিনি খান বাহাদুর আমান আলী। ১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন খান বাহাদুর আবদুস সাত্তার (১৯১৯–১৯২১)। এরপর একে একে নূর আহমদ, রফিক উদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করেন অবিভক্ত ভারতের আইনসভার সদস্য নূর আহমদ চেয়ারম্যান। তিনি ১৯২১ হতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত একটানা প্রায় ৩৩ বৎসর চেয়ারম্যান ছিলেন। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ সালে আবার শুরু হয় প্রশাসক নিয়োগ।স্বাধীনতার পর মিউনিসিপ্যালিটির প্রশাসক নিযুক্ত হন মোহাম্মদ হোসাইন ই.পি.সি.এস। ১৯৬০ সালে মিউনিসিপ্যাল কমিটি গঠন করা হয় এবং ওয়ার্ডের সংখ্যা ১৬ বাড়িয়ে পৌরসভা করা হয়। শহরের প্রধান এলাকা জামাল খান ওয়ার্ডকে ফজল করিম তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন ফজল করিম। ১৯৭৩ সালে সরাসরি ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। তিনি টানা ১০ বছর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালের ২৯ জুন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির নাম পরিবর্তন করে ‘চট্টগ্রাম পৌরসভা‘ নামকরণ করা হয় এবং ১৯৮২ সালেই চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি চট্টগ্রাম পৌর করপোরেশনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ এবং ১৯৭৮ সালে পৌর নির্বাচনে তাঁর জয়লাভ একদিকে যেমন ছিলো চমকপ্রদ, তেমনি বিপুল জনপ্রিয়তাকেও তুলে ধরেছিলো। এরপর যতদিন পৌরসভা ছিলো, ফজল করিমই ছিলেন চেয়ারম্যান। ১৯৮১ সালের ১৬ অক্টোবরে যখন চট্টগ্রাম পৌরসভা কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়, তখন তিনি উপ–প্রশাসক। তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালে খেলাধুলায় চট্টগ্রাম এগিয়ে যায়। ৮০ দশকে বিশ্বখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মমদ আলি ক্লে চট্টগ্রাম আসলে তিনি তাঁকে পৌরসভার পক্ষ থেকে নাগরিক সংবর্ধনা দেন এবং তাঁকে চট্টগ্রামের নগর চাবি হস্তান্তর করেন। তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী মেথর, সুইপারদের জন্য প্রথম আবাসস্থলের ব্যবস্থা করেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় তাঁর গৃহীত কর্মসূচি প্রনিধানযোগ্য। ফজল করিম দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম পৌরসভা সহ সরকারি– বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকার মাধ্যমে নগর উন্নয়নে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। দেশের প্রখ্যাত ক্রীড়া সংগঠক ফজল করিম আমৃত্যু সিজেকেপির সহ–সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেশের খেলাধুলার মানোন্নয়নেও নিরলস ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ২০ আগস্ট অর্থাৎ মৃত্যু পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। সমাজ সেবায় তাঁর গৌরবময় অবদান ও কৃতিত্বের স্বরূপ তাঁকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২০১৬ সালে মরণোত্তর ২১ শে স্মারক পদকে ভূষিত করেছে।
লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।