চট্টগ্রামের পুরাকীর্তি সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | বৃহস্পতিবার , ৬ জুন, ২০২৪ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাশে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরের একদিকে পাহাড় ও অন্যদিকে সমুদ্র। দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরটি চট্টগ্রাম শহরেই। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা এসেছিলেন চট্টগ্রামে। তিনি এ শহরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। চতুর্দশ শতকে বাংলার সুলতানরা এ চট্টগ্রামে একটি টাকশাল স্থাপন করেছিলেন। চট্টগ্রাম নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর একটু আলাদা গর্ব আছে।

চট্টগ্রামের রাজনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। তা শুধু এ কালে নয়, ১৯১৫ সালেই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেছিলেন, ‘শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমহিমায় মহিমান্বিত বলিয়া নহে, অতি প্রাচীনকাল হইতে রাজনীতির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে বিজড়িত থাকায়, চট্টগ্রাম রাজনৈতিক লীলাক্ষেত্র এবং ঐতিহাসিকের গবেষণার প্রকৃষ্ট স্থানও বটে।’

দেড়শ বছর আগে ব্রিটেনের নাগরিক আর্থার লয়েড তাঁর স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ লিভস ফ্রম আ ডায়েরি ইন লোয়ার বেঙ্গলএ চট্টগ্রাম শহরের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন ঠিক এইভাবে, ‘ভাটিবাংলার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা চাটগাঁ। নিচু টিলা, তার চূড়ায় বাড়ি, ঘুরে ঘুরে হেঁটে উঠতে হয়। কোনো কোনো পাহাড়ে বা টিলায় উঠলে চমৎকার সব দৃশ্য চোখে পড়ে। দূরে দিগন্তে কর্ণফুলী গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে, চারপাশে ছড়ানোছিটানো পাহাড়ের চূড়ায় বিন্দুর মতো সাদা বাংলো।তিনি ১৮৭১ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত দুই দফায় চট্টগ্রামের কালেক্টর ছিলেন।

একসময় চট্টগ্রামে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছিল। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে ছিল চট্টগ্রামে একটি বড় বসতি যা মগ দস্যুরা ধ্বংস করে দিয়েছে। এ জেলায় ছিল আরব আর বর্মিদের, আর ছিল পর্তুগিজ আর ইংরেজদের ব্যবসাবাণিজ্য।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর প্রয়াত গবেষক ও ইতিহাসবিদ ড.শামসুল হোসাইন চট্টগ্রামের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে ইটারনাল চিটাগং ও মুসলিম মন্যুমেন্ট অব চিটাগং নামে দুটি বই লিখেছিলেন। বই দুটিতে তিনি মোগল আমল, সুলতানি আমলসহ চট্টগ্রামে প্রাচীন যুগের ৩৬টি স্থাপনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সরকার যদি জরিপ চালায়, চট্টগ্রামে এ রকম আরও স্থাপনা পাওয়া যাবে।’

প্রয়াত গবেষক ড. শামসুল হোসাইন বইয়ে রয়েছে মোগল আমলে নির্মিত আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ, মালখার মসজিদ, ওয়ালী বেগ খান মসজিদ, হামজারবাগ মসজিদ, হামজারবাগ গেট ও সমাধি, মোল্লা মিসকিন মসজিদ ও সমাধি, কদম মোবারক মসজিদ, বায়েজিদ বোস্তামী মসজিদ, চট্টেশ্বরী মন্দির, সীতাকুণ্ডের শাহজানির মাজার ইত্যাদি।

চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তির তালিকায় আছে বাঁশখালীর হামিদ বকশি মসজিদ, মিরসরাইয়ের শমসের গাজির কেল্লা, হাটহাজারীর উপজেলার আলাওল মসজিদ, ফতেপুর পাথরের শিলালিপি, বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রথম মূল ভবন, কধুরখীল পার্বতী চরণ দিঘি, চকবাজারের ওয়ালী বেগ খান মসজিদ ( অলি খাঁ মসজিদ) এবং আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ।

চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারক ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোগল আমলের। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে ছোট্ট একটি পাহাড়ের ওপর এই মসজিদের অবস্থান।

নকশা অনুযায়ী, মূল মসজিদটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) লম্বা, ৭ দশমিক ৫ গজ (৬ দশমিক ৯ মিটার) চওড়া এবং প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২ দশমিক ৫ গজ (২ দশমিক ২ মিটার) পুরু। পশ্চিমের দেয়ালটি পোড়ামাটির এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মসজিদের ছাদের মাঝখানে একটি বড় গম্বুজ এবং দুটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। ১৬৬৬ সালে নির্মিত মসজিদের অষ্টভুজাকৃতির চারটি বুরুজের মধ্যে পেছনের দুটি বুরুজ টিকে আছে। মসজিদটির পূর্ব দিকে তিনটি, উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে মোট পাঁচটি দরজা রয়েছে। মসজিদের ভেতর তিনটি মেহরাব রয়েছে। তবে মাঝখানের সবচেয়ে বড় মেহরাবটিই এখন ব্যবহৃত হয়।

চট্টগ্রাম নগরের অন্যতম ঐতিহ্যময় মসজিদ নবাব ওয়ালি বেগ খাঁ জামে মসজিদ। নগরের চকবাজার মোড়ে ১৮০০ শতকে এটি নির্মিত হয়। মসজিদটি স্থানীয়ভাবে অলী খাঁ মসজিদ নামে সমধিক পরিচিত। চট্টগ্রাম মুঘল ফৌজদার ওয়ালী বেগ খাঁ ১৭১৩ থেকে ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এটি নির্মাণ করেন।

নগরের চকবাজার ওয়ার্ডের সিরাজউদদৌলা সড়কে চন্দনপুরা বড় মসজিদ অবস্থিত। অনেকের কাছে এ মসজিদটি চন্দনপুরা বড় মসজিদ বা তাজ মসজিদ নামেও পরিচিত।

১৮৭০ সালে মাটি ও চুন সুরকির দেয়াল আর টিনের ছাদ দিয়ে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন আবদুল হামিদ মাস্টার। মসজিদটিতে রয়েছে ছোটবড় ১৫টি গম্বুজ। গম্বুজের চারপাশে জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম। মসজিদের চারদিকে আছে হরেক রঙের ব্যবহার। স্থাপনার প্রতিটি অংশে লতাপাতার নকশা আর নানা কারুকাজে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

নগরের পাঁচলাইশ থানার শুলকবহর এলাকার আবদুল্লাহ খান সড়কে শেখ বাহার উল্লাহ শাহী জামে একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। ধারণা করা হয়, মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁর পৌত্র শেখ বাহার উল্লাহ ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল স্থাপত্যে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এ মসজিদ শেখ বাহার উল্লাহ শাহী জামে মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর অধিভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ মহামূল্যবান ও অতিসংবেদনশীল স্থাপনা। ভারতের দিল্লির কেন্দ্রীয় মহাফেজখানা ও ব্রিটেনের লন্ডনস্থ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে শেখ বাহার উল্লাহ জামে মসজিদ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ প্রায় ১৭০ বছর ধরে সংরক্ষিত আছে।

সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরায় সুলতানি আমলে নির্মিত হাম্মাদিয়া জামে মসজিদ প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো মসজিদ। জানা যায়, মসজিদের প্রবেশপথে রয়েছে কালো বেসল্ট পাথরের আরবি শিলালিপি।

হাটহাজারীর বড়দিঘির সুলতানি আমলের নসরত শাহ মসজিদ, মোগল আমলের পোস্তার পাড় ও হাজি মসজিদের মূল স্থাপনা চাটগাঁর নান্দনিক ঐতিহ্য। নগরের ‘মাদার ডেইটি’ নামে পরিচিত চট্টেশ্বরীতে প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো মন্দিরটি মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংস করে দিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী।

এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম আদালত ভবন, জেনারেল হাসপাতাল, সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং, রেলওয়ের কাঠের বাংলো, পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন ও কর্ণফুলী রেলওয়ে সেতু (কালুরঘাট সেতু)

উল্লখ্য, চট্টগ্রাম বিভাগ ও চট্টগ্রাম জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্রের অবস্থান একটি পাহাড়ের চূড়ায়। এটি ‘পরীর পাহাড়’ নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, চতুর্দশ শতাব্দীতে পাহাড় ও টিলাবেষ্টিত চট্টগ্রাম ঘিরে ছিল নানা গল্প। একটি আখ্যান আছে যে পাহাড়ের চূড়ায় একসময় পরীরা বাস করত। তাই মানুষ পাহাড়টিকে এই নামে ডাকা শুরু করে।

ব্রিটিশ শাসনামলে পরীর পাহাড়ের মালিক ছিলেন পর্তুগিজ নাগরিক জন হ্যারি। পরে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন টেক্সরা হ্যারির কাছ থেকে পাহাড়টি কিনে নেন। এরপর পেরেডা নামের এক ভদ্রলোক টেঙরা থেকে পাহাড়টি কেনেন। পরে চট্টগ্রামের পটিয়া মহকুমার ছনহরা গ্রামের জমিদার অখিল চন্দ্র সেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ৯ হাজার টাকায় পেরেডার কাছ থেকে পাহাড়টি কিনে নেন।

ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কেন্দ্রটি প্রাথমিকভাবে মাদ্রাসা পাহাড়ের (বর্তমান সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ পাহাড়) চূড়ায় অবস্থিত ছিল। সে সময় মাদ্রাসা পাহাড়ের চূড়ায় আদালত ভবন ও প্রশাসনিক অফিস ছিল।

পরবর্তীতে নতুন শহর দক্ষিণে বিস্তৃত হলে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক অফিস ও আদালত অন্য জায়গায় স্থানান্তরের পরিকল্পনা করে। এ লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৮৮৯ সালে জমিদার অখিল চন্দ্র সেনের কাছ থেকে পরীর পাহাড় অধিগ্রহণ করে এবং ১৮৯৩১৮৯৪ সালে ওই পাহাড়ের চূড়ায় ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি দোতলা ভবন নির্মাণ করে। পরে মাদ্রাসা পাহাড় থেকে আদালত ও অন্যান্য প্রশাসনিক অফিস সেখানে স্থানান্তর করা হয়।

প্রসঙ্গত, সরকার ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের বেশ কিছু স্থাপনা সংরক্ষিত পুরাকীর্তির তালিকায় এনেছে। তবে এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা যথাযথভাবে সংরক্ষণ জরুরী হয়ে পড়েছে। এগুলো ছাড়া চট্টগ্রামে শতাধিক অরক্ষিত পুরাকীর্তিও ছড়িয়ে আছে। সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এসব ঐতিহ্য একসময় হারিয়ে যাবে।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুর আদর্শ জীবন গঠনে পারিবারিক শিক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম