‘সেকালে কলকাতায় বইবিক্রেতা ও প্রকাশকদের মূল আখড়া যেমন ছিল বটতলা, তেমনি পূর্ববঙ্গের প্রধান শহর ঢাকার জমজমাট বইপাড়া ছিল চকবাজার। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মূলত মুসলমানি পুথির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় একটি স্বতন্ত্র ‘কেতাবপট্টি’ গড়ে ওঠে। চকবাজারের পশ্চিম দিকে স্থাপিত কয়েকটি বইয়ের দোকান ও ছাপাখানাকে ঘিরে দানা বাঁধতে থাকে এই পুথি–সাম্রাজ্য। শুধু চকবাজার নয়, আশপাশের অন্য কয়েকটি মহল্লায়ও ছিল গ্রন্থবিপণি ও ছাপাখানা।’(চকবাজারের কেতাবপট্টি, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, পৃ. ১৪–১৫)। এ ছাড়া ঢাকা–কলকাতায় অনেকেই তখন পুরোনো বইয়ের ব্যবসা করতেন।
একসময় চট্টগ্রাম ছিল বইয়ের শহর। বই বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রকাশনা শিল্পেও চট্টগ্রামের নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ ছেড়ে কলকাতা অবধি। নিউমার্কেট, জলসা সিনেমা হল কিংবা আন্দরকিল্লার বইপাড়ায় সকাল–বিকেল ভিড় লেগে থাকত। নিউমার্কেটের একতলায় উজালা ও নিউজফ্রন্ট, দোতলায় বইঘর আর চারতলায় মনীষায় ভিড় লেগে থাকত সব সময়। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে এই বইয়ের দোকানগুলোয় জমজমাট বেচাকেনা হতো। গত শতকের আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকেও ভারত–বাংলাদেশের খ্যাতনামা কোনো লেখকের সামপ্রতিক বই, নিউজউইক, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, রিডার্স ডাইজেস্ট, দেশ পত্রিকা, সানন্দাসহ নানা ধরনের সাময়িকী, পেঙ্গুইন কিংবা ফেবার অ্যান্ড ফেবার প্রকাশিত ইংরেজি ভাষার বই, রুশ সাহিত্য–সবই মিলত এই পাড়ায়। নিউমার্কেট পার হয়ে জলসা সিনেমা হলের নিচে পাশাপাশি ছিল শুকতারা আর কারেন্ট বুক সেন্টার। এর অপর পাশে কো–অপারেটিভ বুক সোসাইটি। হেঁটে হেঁটে বই দেখা আর বই নিয়ে আলাপে ভেসে যাওয়ার সুযোগ ছিল তখন। সত্তর–আশির দশকে এসব বইয়ের দোকানে নিয়মিত আসতেন হুমায়ূন আহমেদ, আল মাহমুদ, মোহাম্মদ রফিকের মতো খ্যাতনামা লেখক ও সাহিত্যিকেরা।
কোনো বই হয়তো প্রিন্ট আউট। কোনো দোকানে নেই। এমন বই পাওয়ারও উপায় ছিল তখন। পুরোনো বইয়ের দোকান ‘অমর বই ঘর’এ গেলে মিলত সেসব বই। সেখান থেকে বই ভাড়া নিয়েও পড়ার সুযোগ ছিল।
অমর বই ঘরের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আবুল হোসেন। আবুল হোসেনের জীবনটাও গল্প–উপন্যাসের চরিত্রের মতোই। ১৯৬৮ সালে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ঢাকার শ্যামবাজারের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে এসেছিলেন। স্টেশন রোডে রিয়াজউদ্দিন বাজারের মুখে ফুটপাতে চট বিছিয়ে শুরু করেন পুরোনো বই বেচা। তখনো এত দালান হয়নি। আশপাশে ঝোপঝাড়। শুরুর দিকে ভাঙারির দোকান থেকে বেছে বেছে বই এনে বিক্রি করতেন। বছর দুয়েক চলার পর শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হলে আবার শুরু। সেই একই জায়গায়। ১৯৮০ সালের দিকে ফুটপাতের পাশে দালান হলো। সেখানে দোকান নিলেন। এর মধ্যে অমর বইঘরের কথা ছড়িয়ে পড়েছে সবার মুখে মুখে। বর্তমানে চারটি শাখা রয়েছে। তবে আগের সেই জৌলুশ এখন নেই।
চট্টগ্রামে একসময় চলন্তিকা, পাঠক–বন্ধু, বইঘর, উজালা বুক সেন্টার, নিউজফ্রন্ট, কো–অপারেটিভ বুক সোসাইটি, মনীষা লাইব্রেরি, কথাকলি, পিপলস বুক, ডি রোজিও নামের গ্রন্থরাজ্য গড়ে উঠেছিল। উল্লেখ্য, নিউজফ্রন্টের মালিক ছিলেন দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ চৌধুরী। তিনি বিখ্যাত ‘সিগনেট প্রেস’ এর মালিক ছিলেন। বাংলাদেশে ‘রিডার ডাইজেস্ট’ পত্রিকার পরিবেশক ছিল ‘নিউজফ্রট’।
অন্যদিকে আন্দরকিল্লায় ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর লাইব্রেরি, ইসলামিয়া লাইব্রেরির নাম এখনো পাঠকের মুখে মুখে ঘুরে ফিরে আসে। এসব বইয়ের দোকানগুলোয় চেনা–অচেনা কত লেখকেরই না বই ছিল। লিটল ম্যাগাজিন, পুস্তিকা, দেশ–বিদেশের পত্রিকাও ছিল। কালের বিবর্তনে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই হারিয়ে গেছে। কোনোটি টিকে আছে এখনো।
জুবলী রোডে জলসা ভবনের নিচে ছিল ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’। ‘বই হোক নিত্য সঙ্গী’ স্লোগান দিয়ে বইফেরি করত। ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’ এর মালিক ছিলেন মরহুম মোহাম্মদ আমিন সাহেব। ১৯৮৮ সালে মিমি সুপার মার্কেটে ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’র আরেকটি শাখা খুলে। আমিন সাহেবের আদিবাড়ি ঝালকাঠি জেলায়। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম এসে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের পশ্চিম পাশে পাহাড়ের ঢালুতে ‘স্ক্রীন এন্ড কালচার’ নামে একটি বইয়ের দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬২ সালে তা স্থানান্তর হয় সিডিএ বিল্ডিং এর নিচ তলায়। নাম দিলেন ‘সিডিএ বুক হাউজ’। ১৯৬৭ সালে জুবলী রোডে জলসা সিনেমা হলের নিচে আবার স্থানান্তরিত হয়। তখন নামকরণ করেন ‘কারেন্ট বুক সেন্টার’। পাশে ‘শুকতারা’ নামে আরও একটি গ্রন্থবিপণি ছিল।
নগরের মোমিন রোডস্থ কথাকলি‘র মালিক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক ভাষাবিজ্ঞানী ড.মাহবুবুল হক। তাঁর হাত ধরে ‘কথাকলি‘ ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কথাকলি’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। কথাকলি‘র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের উপস্থিতি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। বিভিন্ন সংগঠনে ভর্তি, প্রতিযোগিতার ফর্ম, নাটকের টিকিট ইত্যাদির জন্য কথাকলি ছিল অপরিহার্য ঠিকানা।
নিউমার্কেটের দোতালায় সিঁড়ির সামনে ছিল ‘বইঘর’। সৈয়দ মোহাম্মদ শফি ১৯৬০ সালে ‘বইঘর‘ প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বাংলার অন্যতম সেরা প্রকাশনা সংস্থা ছিল ‘বইঘর’। ‘বইঘর’ থেকে বঙ্কিম রচনাবলী, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, এখলাস উদ্দিন, পুর্ণেন্দু পত্রী, লীলা মজুমদারের বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলোর প্রচ্ছদ ডিজাইন করেছিল খালেদ চৌধুরী, পুর্ণেন্দু পত্রী, কাইয়ূম চৌধুরীর মতো নন্দিতশিল্পীরা। ১৯২৬ সালে শফি সাহেবের পিতা নূরুল আলম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দ্য আর্ট প্রেস’। শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসে কোতোয়ালীর মোড়ে এখনও সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে। নিউমাকের্টের চারতলায় ছিল মনীষা লাইব্রেরি। চাইনিজ বইয়ের জন্য এটা বিখ্যাত ছিল। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে ছিল চলন্তিকা ঘর ও পিপলস বুক। ডিসি হিলের উল্টো দিকে ডি রোজিও নামে একটি বইয়ের দোকান ছিল। লালদিঘির পশ্চিম পাড়, নিউমার্কেট এর ফুটপাত এবং নগরের নানান স্থানের ফুটপাতে তখন নতুন পুরাতন বই পাওয়া যেত।
সবকিছু ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বেশ কয়েক বছর ধরে সাড়া জাগিয়েছে বাতিঘর কিংবা নন্দনের মতো প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠক–লেখকদের ভিড় লেগে থাকে বছরজুড়ে।
লেখক : গবেষক ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।