‘চট্টগ্রামের পর্যটন ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা’: পাঠ প্রতিক্রিয়া

ছন্দা চক্রবর্ত্তী | মঙ্গলবার , ৬ মে, ২০২৫ at ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ

নুসরাত সুলতানা চট্টগ্রামের লেখালেখির জগতে একটি পরিচিত নাম। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর পদচারণা রয়েছে। পত্র পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লেখেন, বিশেষ করে সময়ের হাত ধরে চলে তার লেখালেখির বিষয় সমূহ। সমকালীন প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও তিনি ভ্রমণকাহিনি, কবিতা ও ছড়াও লেখেন। নারী উন্নয়ন ধর্মী লেখাও তার কলম থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কৃতী জনদের মূল্যায়নধর্মী লেখাতেও তার আগ্রহের প্রমাণ রেখেছেন। তবে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সচেতন নাগরিক হিসেবে লিখে সাহিত্য জগতে সবার নজর কেড়েছেন। সেই সব প্রবন্ধ সমূহকে মলাটবদ্ধ করে গ্রন্থাকারে রূপ পেয়েছে ‘চট্টগ্রামের পর্যটন ঐতিহ্য ও সম্ভাবনা’ গ্রন্থটি। গ্রন্থটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ। গ্রন্থটি উৎসর্গিত হয়েছে লেখকের শ্রদ্ধেয় পিতামাতা যথাক্রমে মরহুম মোঃ শফিকুল ইসলাম ও মোছাম্মৎ রওশন আরা বেগমের নামে।

গ্রন্থটিতে বিভিন্ন বার্তা নিয়ে মোট সাতটি প্রবন্ধ রয়েছে, প্রবন্ধগুলি সংখ্যা গত দিক দিয়ে কম হলেও গুণগত দিক দিয়ে সমৃদ্ধতা রয়েছে। বইটিতে তিনি চট্টগ্রামের পর্যটন স্থান সমূহ, ঐতিহ্যসমূহ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূল্যবোধ, কিংবদন্তি নারী ও কীর্তিমতি নারী, চট্টগ্রামের বন্যা কবলিত অবস্থা ইত্যাদিকে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অংশ হিসেবে সংশ্লেষিত করেছেন। নুসরাত সুলতানার তীক্ষ্‌ণ অন্তর্দৃষ্টিগত ভ্রমণ অনুধাবনে ঐতিহ্যকে পরখ করে নিজের আকাঙ্ক্ষার সম্ভাবনাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। পাঠকগণ, লেখকের সাথে সাথে নিজেও উপলব্ধি করতে পারবেন তাঁর সহজ সরল এবং নিখুঁত বর্ণনার জন্য।

গ্রন্থটির প্রথম প্রবন্ধ ‘চট্টগ্রাম: পর্যটনে অপার সম্ভাবনার হাতছানি’ মূলত গ্রন্থটির নামকরণে এই প্রবন্ধটির অবদান সর্বাধিক এবং যুক্তিযুক্ত। গ্রন্থাকার প্রবন্ধটির মাধ্যমে পাঠককে চট্টগ্রামের যাবতীয় পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ করান। চট্টগ্রামে কেউ বেড়াতে আসলে এই প্রবন্ধটি একটি ভ্রমণ নির্দেশিকা হিসাবে পাঠককূলকে সাহায্য করবে। চট্টগ্রামের দক্ষিণে পৃথিবীর দীর্ঘতম বালুময় সমুদ্র সৈকত, ইনানী, হিমছড়ি, সোনাদিয়া দ্বীপ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ছেঁড়া দ্বীপ, সাফারী পার্ক ও টেকনাফ। পূর্বে বান্দরবান, নীলগিরি, নীলাচল, বগা লেক, চিংড়ি ঝিরি জলপ্রপাত, সাংস্কৃতিক যাদুঘর, কেওক্রাডাং পাহাড়, তাজিংডং পাহাড়, শুভ্রনীলা। পশ্চিমেপতেঙ্গা সী বীচ, পারকি বীচ, নেভাল একাডেমী, উত্তরে পাহাড় ঢাকা সাজেক, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, চন্দ্রনাথ পাহাড়, সীতা মন্দির, মুহুরী প্রজেক্ট, সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক ও পাহাড় ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝখানে অবস্থিত নয়নাভিরাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আর কেন্দ্রে মাথার মুকুট হয়ে মধ্যমণিদের অবস্থান, যথা সিআরবি, ডিসি হিল, বাটালি হিল, টাইগার পাস, বন্দর, এয়ার পোর্ট, ফয়’স লেক, রেলওয়ে স্টেশন, ও শাহ আমানত ব্রীজ। এসব জায়গার স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে চিত্রিত হয়েছে প্রাচ্যের রানী চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক চিত্রায়ণে পর্যটন স্থান এবং পর্যটনের সম্ভাবনা।

গ্রন্থটির দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘মেজবান : চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের ধারক বাহক’। এতে অতিথিপরায়ণ চট্টগ্রামবাসীর মেজবানের উৎপত্তি, ঐতিহ্যগত অবস্থান, মেজবানের নামকরণ, কখন, কেন চট্টগ্রামের মানুষের কাছে মেজবান ব্র্যান্ডখ্যাত আইকন হিসেবে স্থান পেল তার সুন্দর বর্ণনা তুলে এনেছেন। মেজবানে অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা অর্থাৎ অমুসলিমদের জন্য আলাদা রান্নার উদাহারণ তুলে এনে সমাজকে সম্প্রীতির সম্পর্ক ও সচেতনতার দৃষ্টান্ত তুলে এনেছেন সাথে সাথে মেজবান চট্টগ্রামবাসীর গর্বিত ঐতিহ্য কে ঐতিহাসিক করে রাখলেন। মেজবান উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামের কবিসাহিত্যিকরাও পূর্বে অনেক অনেক গল্প, কবিতা প্রবন্ধ ও অসংখ্য ছড়া প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে চট্টগ্রামের ভাষায় বিশিষ্ট ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার কয়েকটি ছড়া এখানে সংযোজিত হয়েছে। একটি ছড়া যেমন ওরে দেশের ভাই,/খুশির সীমা নেই,/ জলদি আইয়ু সাজিগুজি,/ মেজ্জান খাইবার লাই। এই রকম আরো অনেক মেজবানের সমৃদ্ধ স্মৃতিও তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব নিয়ে যেন এসব প্রবন্ধগুলিকে এই গ্রন্থে তুলে ধরলেন। ঐতিহ্যবাহী মেজবানের সাথে বেলা বিস্কুট, শুটকি, জব্বারের বলীখেলা ইত্যাদি চট্টগ্রামের স্পেশাল ঐতিহ্যগুলোকেও সুন্দরভাবে যুক্ত করে চট্টগ্রামকে আলাদা মাত্রায় ভূষিত করেছেন।

নুসরাত সুলতানা বয়সে একজন তরুণ মানুষ হয়ে দেশের উন্নতির কথা, চট্টগ্রামকে রক্ষার কথা, চট্টগ্রামের মানুষদের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির কথা ভেবেছেন সচেতন নাগরিক হয়ে। তাই তো তিনি কলম ধরলেন চট্টগ্রামের দুঃখ চাক্তাই খাল নিয়ে, তিনি লিখলেন ‘দেখতে চাই, দূষণমুক্ত’ চাক্তাই। একসময় এই চাক্তাই খাল দিয়ে শত শত নৌ যান দিয়ে মালামাল আনা নেওয়া হতো, কিন্তু এখন তা কেবল স্মৃতি।

সুশৃংখল, সুন্দর সোনার বাংলা দেখতে চাই’ প্রবন্ধটিতে পাঠক, লেখকের উদার মনোভাব, অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ ন্যায়বোধ ও মানবতা বোধের এক সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্তের পরিচয়ে একজন সত্যিকারের দেশপ্রমিকের সাথে পরিচিত হবেন। তাঁর লেখা দুটি লাইন সমাজের সাম্প্রদায়িক মানুষগুলোকে একটু হলেও সজাগ হতে সাহায্য করবে। যেমন ‘ধর্ম নিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধানো মানুষ কখনোই ধার্মিক হতে পারে না। ধর্মের নামে অধর্ম করে অশান্তি সৃষ্টি করা যাদের উদ্দ্যেশ্য, তারা পরিবারের শত্রু, সমাজের শত্রু, জনগণের শত্রু, দেশের শ্‌ত্রু। লেখক এর যাপিত জীবনে অসংখ্য অমুসলিম মানুষের সাথে মিলে মিশে যে সব আন্তরিক সম্পর্কের চর্চার মধ্যে গিয়েছেন তা এক কথায় অপূর্ব, সেখানে তিনি প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু হরিপদ দাশ থেকে কলেজের শেষ পর্যায়ের শিক্ষক প্রফেসর হরিশংকর জলদাস স্যারদেরকে স্মরণ করে তাঁদের আন্তরিক সম্পর্কের কথা ব্যক্ত করেছেন পরম শ্রদ্ধায়, পরম মমতায়। পাঠক এখানটায় লেখক যে কতোটা মিশুক এবং কৃতজ্ঞ দায়িত্ববান তার পরিচয় পাবেন।

কিংবদন্তী নারী, স্বনামধন্য লেখক, রম্য সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় ফাহমিদা আমিন এর স্মরণানুষ্ঠান জনিত এক সভার পুংখানুপুংখ বর্ণনায় অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সবাইকে তিনি ইতিহাসের অংশ করে রাখলেন, ‘সশ্রদ্ধ চিত্তে ফাহমিদা আমিনকে স্মরণ’ নামক প্রবন্ধটির মাধ্যমে। এই শ্রদ্ধেয় মানুষটাই যে লেখকের লেখালেখির অনুপ্রেরণাকারী ছিলেন, তা লেখক কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলেন যা পাঠককে এক সমৃদ্ধ মূল্যবোধ জাগাতে উদ্বুদ্ধ করলেন।

নুসরাত সুলতানা শুধু চট্টগ্রামের নয় সারা বিশ্বের নারীদের সাফল্যে গর্বিত। তাঁর চিন্তা ভাবনায় নারীর শত বাধা বিপত্তিকে পিছনে ফেলে যে নারীরা আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছিনিয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, তাই তিনি উচ্ছ্বসিত। তার প্রমাণ হিসেবে ‘২০২৩ সালে আমাদের সম্মানজনক অর্জন’ নামের প্রবন্ধটি। এখানে তিনি ১০০ জন প্রভাবশালী নারীর মধ্যে ০৭ জন নারীর সম্মাননা পাওয়াকে পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে নারীর অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে এনেছেন যা একটা গবেষণা লব্ধ কাজ।

বন্যায় নারী ও শিশু সুরক্ষায় সম্মিলিত উদ্যোগ ও সচেতনতা প্রয়োজন প্রবন্ধটি যুক্ত করে চট্টগ্রামের মানুষের এক জলন্ত প্রশ্ন কে তিনি প্রশাসন ও সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু বন্যার সময় মানুষের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের দুর্ভোগ উঠে চরমে, বন্যার জলে ভেসে চলে যায় কোলের শিশু, গত আগস্টের ১১টি জেলার ভয়াবহ বন্যার সময় নারী শিশুদের অসহায় অবস্থা বিশেষ করে তুলে এনে মানুষকে এবং প্রশাসনকে করণীয় ব্যবস্থার কথাই তিনি ব্যাখ্যা করলেন নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে।

গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন লেখকের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক। তিনি লেখকের প্রতি আশীর্বাদের হাত মাথায় রেখে মুগ্ধতার সাথে পাঠক প্রিয়তার প্রত্যাশা করেছেন।

সুন্দর প্রচ্ছদে ছিলেন উত্তম সেন এবং মুদ্রণে আইকো, আর নির্ভুল বানানে গ্রন্থটি মলাটবদ্ধ হয়ে গ্রন্থ রূপে প্রকাশিত হয়েছে শৈলী প্রকাশন থেকে, যার তত্ত্বাবধানে আছেন প্রকাশক আয়েশা হক শিমু, এবং প্রকাশনা উপদেষ্টা রাশেদ রউফ। লেখককে ধন্যবাদ। গ্রন্থটি বহুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করুক।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, হুলাইন সালেহ নূর কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসময় সচেতন সুশৃঙ্খল ও প্রযুক্তিনির্ভর দেশ জাপান
পরবর্তী নিবন্ধকিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ