জেনে ভালো লাগলো যে, সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দের অর্ধেকই চট্টগ্রামের জন্য। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত ১০ মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) মোট ১০টি সভা করেছে। এসব সভায় সারা দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় অনুমোদন করা হয়েছে। এই উন্নয়ন বরাদ্দের অর্ধেকই ব্যয় হবে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের জন্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম শহরের নাগরিক সমস্যার পাশাপাশি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের সমস্যা সমাধানে মুহাম্মদ ইউনূস সরকার নজিরবিহীন উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের নাগরিক দুর্ভোগ যেমন দূর হবে, নগর–পরিকল্পনার ঘাটতি এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতাও অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। চট্টগ্রাম জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি–এমন উপলব্ধি থেকেই সরকার চট্টগ্রামকেন্দ্রিক মহাপরিকল্পনা নিয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সচিব ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন পত্রিকান্তরে বলেন, যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তা দেশের স্বার্থেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় প্রতিটি একনেক সভা শেষে সাংবাদিকদের জানান, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো মেগা প্রকল্প নেবে না। তবে বাস্তব চিত্র হলো, এরই মধ্যে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক দুটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। এর একটি হলো চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর একটি রেল কাম সড়কসেতু নির্মাণ প্রকল্প। ইউনূস সরকারের দ্বিতীয় একনেক সভায় অনুমোদিত এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। একনেকের অষ্টম সভায় চট্টগ্রামে বে–টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে, যার প্রাক্কলিত ব্যয় ১৩ হাজার ৫২৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৫ হাজার ১৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প ও ২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম নগরীর কাট্টালী ক্যাচমেন্ট স্যানিটেশন প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নেই। মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর গড়তে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বিগত সরকার। তাই দেশের অর্থনীতির স্বার্থে চট্টগ্রামের বে–টার্মিনাল প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমরা বলছি, মেগা প্রকল্প নিচ্ছি না, তবু দেশের স্বার্থে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে এগুলো খুব বড় প্রকল্প নয়। তালিকায় অনেক মেগা প্রকল্প ছিল, সেগুলো নিচ্ছি না।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঐতিহ্যগতভাবে চট্টগ্রাম ভূ–প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর নগরী। এই নগরীকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার অনেক অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে। এই নগরীর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন সত্যিকার অর্থে নানান আর্থিক সংকটসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত থাকায় এই নগরীকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে উন্নীত করার মতো দায়িত্ব পালনে সফল হতে পারে নি। তবে এটাও সত্য যে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের অনেক সম্ভাবনার দুয়ার খোলা রয়েছে। নগরীর বেনিফিশিয়ারি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব আয় ও তহবিলের একটি অংশ বরাদ্দ নিশ্চিত হলে এই নগরীকে আন্তর্জাতিক মানের উন্নীত করার সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর হবে। সর্বোপরি নাগরিক সুযোগ–সুবিধা এবং বিভিন্ন সেবাখাতগুলোর কার্যক্রম যথাযথভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে উঠবে।
আমাদের ভাবতে হবে নাগরিকেরা কী চায়। তারা চায় এই নগর যেন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকে, রাস্তার বাতি যেন ঠিকমতো জ্বলে, ফুটপাতে যেন চলাচল করতে অসুবিধা না হয় ইত্যাদি। বিশ্বের অভিজাত সুন্দর শহর যেমন সিউল, ক্যানবেরা, সিঙ্গাপুর, নিউইয়র্ক, মস্কো, টোকিও–এসব শহরে গড়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ। কিন্তু আমাদের নগরীতে সেই তুলনায় অনেক বেশি মানুষ বাস করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগর–পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন নেতৃত্ব। সিটি করপোরেশনের মেয়র যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এখন সবার কাজ হলো তাঁকে সহযোগিতা করা। বর্তমানে টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং অ্যাক্ট হওয়া দরকার। এর জন্য ন্যাশনাল আরবান পলিসি ছিল। নীতিটি অনুমোদন হওয়া প্রয়োজন। তাহলে প্রায় সবকিছুই এর মধ্যে চলে আসবে।
৭৫ শতাংশ জিডিপি শহর থেকে আসে। নগর–পারিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখন যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগ ছাড়া কাজ হবে বলে মনে হয় না। মোট কথা, দীর্ঘমেয়াদি নগর–পরিকল্পনা প্রয়োজন।