‘
চাটগাঁ‘ নভেম্বর– ডিসেম্বর ১৯৯৪ সংখ্যায় প্রকাশিত ড. ময়ুখ চৌধুরীর (আনোয়ার উল আজিম চৌধুরী) প্রবন্ধ ‘প্রকৃতি কন্যা চট্টগ্রাম‘ সংখ্যা থেকে সংকলিত, ‘কালধারা‘ অষ্টম সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৪০৪, ডিসেম্বর ১৯৯৭ ‘কালধারা চট্টগ্রাম সংখ্যায়’ মুদ্রিত পৃষ্ঠা–১৪০ এর শুরুতে এক মনোহরী উপস্থাপনা করেছেন এভাবে যে, ‘বাংলাদেশ উড়ন্ত পাখির মতন একটি মানচিত্র। শীর্ষ দেশ উত্তরবঙ্গ, স্পষ্ট একটি ডানার মত সিলেট। আর মায়াবী পুচ্ছের মত চট্টগ্রাম। সবটা মিলিয়ে মনে হয় লাল সবুজের মাছরাঙা সমুদ্র থেকে এইমাত্র উড়াল দিয়েছে উত্তরের পাহাড় ছাড়িয়ে সুনীল আকাশে। এই বাংলাদেশেরই অন্যতম প্রান্তিক এলাকা চট্টগ্রাম, তাকে যখন আলাদা দৃষ্টিতে দেখি, মনে হয় সমুদ্র সৈকতে শুয়ে থাকা মৎসকন্যা, নিটোল এক তন্বী।
প্রকৃতির রানি কাকে বলে জানি না তবে চট্টগ্রাম আক্ষরিক অর্থে প্রকৃতি কন্যা। এর ভূগোল, এর ইতিহাস, এর কিংবদন্তী–সর্বত্রই প্রকৃতির মায়াবী স্পর্শ। সাধারণত প্রকৃতির প্রধান উপকরণ রূপে বন– বনানী, পাহাড়–হ্রদ, নদী ও সমুদ্রকে ভাবা হয়। আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, অল্প –দূরত্বের মধ্যে এর সব কিছুই চট্টগ্রামে বর্তমান’।
ঐ একই সংখ্যায় কবি ও সাহিত্যিক আবুল মোমেন তাঁর ‘চট্টগ্রামের সংস্কৃতি: স্বাতন্ত্র্য ও ঐক্যের উপাদান‘ প্রবন্ধে পৃঃ ১৪, বলেন, ‘পাহাড় ও সমুদ্র চট্টগ্রামকে ভৌগলিক বিশিষ্টতা দিয়েছে। ভৌগলিক পরিবেশের সাথে মানুষের জীবনধারণের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে সম্পর্কিত। চরের মানুষে, হাওড়ের মানুষে, নদীপাড়ের মানুষে ও বনাঞ্চলের মানুষে, সমতলবাসী ও পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার তফাত কে অস্বীকার করতে পারে। জীবনধারণের ক্রিয়াকর্মের উপরেই তো সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে। তাই চট্টগ্রামের প্রকৃতির দুই প্রধান উপাদান সমুদ্র ও পাহাড়। সমুদ্র প্রকাণ্ড ও উত্তাল, পাহাড় মুক ও নিথর।’
একই ভাবে ড. মোহীত উল আলমের ভাষায় তাঁর প্রবন্ধ ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও কতিপয় মনীষীর রায়’ পৃঃ ৪২ এ বলেছেন, ‘চট্টগ্রামে ঘটেছে সমুদ্র ও পাহাড়ের সন্ধি। এ জন্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র। মানুষগুলোর চরিত্র স্বতন্ত্র, উদার, মহৎ, সাহসী, সরল, আন্তরিক, কূটকৌশলবিহীন, এবং একই সংগে কল্পনাপ্রবণ ও বৈষয়িক ।’
উক্ত সংখ্যায় কবি সৈয়দ আলী আহসান ‘আমার চট্টগ্রাম’ পৃঃ ৮৯,এ স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, ‘কলকাতায় হাবিবুল্লাহ বাহারের সাথে পরিচয় হয়, সম্ভবত ‘আজাদ অফিসে’ ১৯৪০ এর দিকে। কি কথায় যেন তিনি চট্টগ্রামের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘পাহাড় উপত্যকা এবং সমুদ্র নিয়ে যে অঞ্চল শোভমান তার সংগে অন্য কোন অঞ্চলের তুলনা চলে না। সে এক কথায় অতুলনীয়। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতায় চট্টগ্রামের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যের এত সুন্দর বর্ণনা আমি আর কোন কবিতায় পাইনি।’
চট্টগ্রাম সম্পর্কিত আমার পূর্বের লেখায় উল্লেখ করেছি, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নদী কর্ণফুলী, শহর চট্টগ্রাম, তার চেয়ে সুন্দর তার আঞ্চলিক ভাষা ও গান। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান বাংলার লোকসংগীতকে করেছে অপার সমৃদ্ধ। দেশের বাইরেও এ গান প্রভূত জনপ্রিয়। চট্টগ্রামের সৌন্দর্য, ইতিহাস, প্রকৃতি, মানুষের জীবন, জীবিকা, হাসি কান্না, সুখদুঃখ বিচ্ছেদ বেদনা, আশা প্রত্যাশা আরো বিপুলভাবে ধরা পড়ে কালজয়ী কিছু আঞ্চলিক গানে।
সবুজে শ্যামলে, ফুলে ও ফসলে রূপে অপরূপে বাংলা যেমন তেমনি চট্টগ্রামকে নিয়ে যে সকল কালজয়ী গীতিকার সংগীত রচনা করেছেন তাদের মূল বিষয় ছিল চট্টগ্রামের প্রকৃতি, নদী, কর্ণফুলী, হালদা, শঙ্খ, সাগর, বন্দর, সবুজ পাহাড়, মাঠ, সাম্পান, মাঝি, রাখাল, নদী পাড়ের মানুষের জীবন, জেলে, চাষী, কৃষক, মজুর, ধান, শস্য, জোয়ার ভাটা, বৃষ্টি, জমি, মানুষের সুখদুঃখ, সংগ্রাম, বিয়ে, প্রেম, বিচ্ছেদ, পীর আউলিয়া, তাদের কেরামতি, দরগাহ, মাজার ইত্যাদি। তার উপর ভিত্তি করে উপস্থাপন করলাম কিছু গান।
আমার শোনা সেই সত্তরের দশকে গ্রামের মাইকে প্রথম চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান
‘মনর জ্বালা ন ফুরাইল আঁর
কোয়ালর দুঃখ ন ফুরাইল
ছাড়কোয়াইল্লা লারি জেইরগান্যুয়া
রাড়ি বানাইল’।
শিল্পী ছিলেন মিয়া মোহাম্মদ বদরুদ্দিন।
অন্য দুটি গান চট্টগ্রাম বেতারে শুনেছিলাম শিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের কণ্ঠে। একটি অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তীর লেখা, শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের সুর ও কণ্ঠে,
‘গুরা বউ বউরে
সন্ধ্যা কালে চেরাগ দিত গেল’।
অন্যটি তাঁরই লেখা সুরে গাওয়া
চল অপুত বিলত যাই
জালা বিচানা চঅন পরিব
আলো রুইবার লাই’ ।
এসব গান সহ অনেক গান সময়ের স্রোতে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে কোথায় হারিয়ে গেছে। হয়ত বেতারের সংরক্ষণ রুমে বা রেকর্ড কোম্পানির কো গুদামে অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হয়ে আছে।
পাকিস্তান আমলে সত্তরের দশকে পাকিস্তান কাউন্সিল, পরবর্তীতে বাংলাদেশ কাউন্সিল, এখন পাবলিক লাইব্রেরিতে সে সময় বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে শিশুদের অনেক গান শিখানো হত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশনের জন্য বাংলা, উর্দু ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান শেখানো হত যার প্রশিক্ষক হিসেবে থাকতেন বাবু সুকোমল বড়ুয়া ও শিল্পী, গীতিকার মলয় ঘোষ দস্তিদার। তার মধ্যে আমাদের যে দুটি গান শেখানো হয়েছিল তার একটি কাজী নজরুল ইসলাম এর
‘বাজিছে দামামা বাদরে আমামা
শির উচা কর মুসলমান‘ প্রশিক্ষক ছিলেন বাবু সুকোমল বড়ুয়া এবং অন্যটি,
‘চোড চোড ঢেউ তুলি পানিত
চোড চোড ঢেউ তুলি
লুসাই পাহাড়ত্তুন নামিয়ারে
যারগই কর্ণফুলী’। যার রচয়িতা ও সুরকার এবং প্রশিক্ষক ছিলেন মলয় ঘোষ দস্তিদার। সে গানই হয়েছে কাল জয়ী, যা এখনো সমান জনপ্রিয়, দর্শক শ্রোতার কাছে সমানে গ্রহণযোগ্য, অনুষ্ঠান আলোকিত করা গান, যে গান চট্টগ্রামকে সাবলীল ও চিরন্তন করে রেখেছে সুরে, ছন্দে এবং পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের জাতীয় সংগীতে।
বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, সামসাদ ইংরেজী বাংলা অভিধান, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা প্রতিটি বইয়ের অনুসন্ধানে আমরা পাই।
‘কালজয়ী’ শব্দটির অর্থ সময়কে অতিক্রমকারী বা যুগান্তকারী যে বিষয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর এবং ফ্যাশনেবল থাকা, চিরকাল বেঁচে থাকাই কালজয়ী। যে বিষয় সময় কে জয় করেছে বা যা অনাদি, চিরকালীন, কালাতীত, চিরপ্রবাহমান, দীর্ঘস্থায়ী, শাশ্বত, সার্বকালীন, ধ্রুপদী, মহাকাব্যিক, মার্গীয় তাহাই কালজয়ী।
যদিও অধিক প্রচার ও বিস্তৃতির কারণে মলয় ঘোষ দস্তিদারের ‘চোড চোড ঢেউ তুলি’ গানটি কালজয়ী হয়েছে তার সাথে তার রচিত, সুরারোপিত ও গীত অনেক গান আছে। যেমন,
‘বাহার মারি সাম্পান যার
দড় দুইয়ানে কেক্রোত গরে
দৈর্যা হয় তোলপাড়
বা,
ওভাই আরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান,
দৈর্যার কোলত বসত গরি
শিনাদি ঠেকাই জড় তুয়ান’
বা
চাটগাঁইয়া নওজোয়ান আরা চাটগাঁ আরার জান
কর্ণফুলী র পানিত অভাই জুড়াই রে পরাণ’ ইত্যাদি ।
তার আগে ১৯৩২–৩৪ সালে কিছু মাইজভাণ্ডারি গানের সাথে শিল্পী জগন্ময় মিত্রের তত্ত্বাবধানে কোলকাতার এইচ এমভি রেকর্ড করে আহমুদুল হক সিদ্দিকীর লেখা, শিল্পী মোঃ নাসিরের সুর ও কণ্ঠে ‘চান মুখে মধুর হাসি’। যা এখনো সমান জনপ্রিয় এ গানের ভাব, ভাষা ও উপস্থাপনার কারণে ।
মোঃ নাসিরের আরো অনেক গানের মধ্য
‘ঝর পড়েদ্দে লোচারে লোচা
উজান উডের কৈ
এমন বরিষি কালে রাইখ্যম কারে লই’।
বা
‘হাউসের যৌবন আমার শেষ করি
বন্ধু যায় আমার বুকেরে শেল মারি‘
অসম্ভব জনপ্রিয়।
আমরা পাই, পণ্ডিত খাইরুজ্জামার গান,
‘বৈনের বেনরশী শাড়ি গায়
আয়না ধরি শীতা পারের বৈনে
খিড়কির কিনারায়’।
আশকর আলী পণ্ডিতের অনেক গানের মধ্যে পাই
‘কি জ্বালা দি গেলা মোরে
নয়নের কাজল পরাণের বন্ধুরে
ন দেখিলে পরাণ পোড়ে।
বা
‘ডালেতে লরিচরি বইঅ চাতকী ময়নারে
গাইলে বৈরাগীর গীত গাইও’।
বা
‘একসের পাবি দেড়সের খাবি
ঘরত নিবি কি’।
কবিয়াল রমেশ শীল লিখেছেন,
‘আন্ধার ঘরত রাইত কাডাইয়ম কারে লই
বন্ধু গেলে গৈ’।
বা শিশুতোষ গান
‘নাতিন বরই খা বরই খা
হাতে লুইয়া নুন
টেইল ভাঙিয়া পৈরগে নাতিন
বরই গাছত্তুন’।
অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী লিখেছেন,
‘সুর্য উডের অভাই লাল মারি
রইস্যা বন্ধু ছারি গেলগই আমার
বুকেরে শেল মারি’।
বা
বদর বদর বদর হেইয়া
বেবাম দরিয়ার মাঝে হায়রে
কুল কিনারা নাই’।
মোহন লাল দাস লিখেছেন,
‘ওরে সাম্পানওয়ালা
তুই আমারে করলি দিওয়ানা’।
এম এন আকতারের লেখা, সুরে,
‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম
বকশীর আইট্টা পানর খিলি
তারে বানাই খাওয়াইতাম’।
বা
‘ও পরানর তালত ভাই
চিডি দিলাম পত্র দিলাম
নো আইলা কিয়ুলাই‘
বা
‘কৈলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে
শিনার লগে বাজাই রাইখ্যম তোঁয়ারে
অ ননাইরে’।
বা
‘বরই ফুলর থামি আর এক্কান গুলবাহার
যদি পাইতাম আই পিনতাম
আয়না ধরি চাইতাম আরে
কেন সোন্দর লার‘।
মহসিন চৌধুরী লিখেছেন,
‘কুতুবদিয়া আর বাড়ি পয়রি ন নাইয়
যাইবার সমত আর ঘাডত সাম্মান ভিড়াইঅ’।
বা
‘অদ্দা গুরাইয়ার বাপ
নোয়া কথা উন্ননি
মদার গাছত আইট্টা কেলা
কাউয়ার গুনগুনি’।
লক্ষীপদ আচার্য লিখেছেন ,
‘রঙিলা মাঝিরে
এই ঘাডদি সাম্মান ভিড়াইঅ
আইস্যরে তুই নিশি রাইতে
চুপতে গরি মাতাইঅ’।
বা
‘প্রেম জ্বালায় জ্বলি পুড়ি
সোনার অংগ গৈরলাম ছাঁই
মাতাই ন গেল
যাইবার কালে বন্ধু
কি দোষ গৈরলাম আই’।
আব্দুল গফুর হালির,
‘ঢোল বাজের আর মাইক বাজের
আর পরাণে কেন গরের
কেন গরি যাইয়ম পরর ঘর‘।
বা
অ শ্যাম রেংগুম ন যাইও রে
বা
রেঙুম রঙিলার সনে মজি রৈল মন
এমন দেওয়ানা হৈয়া
রৈল কত জন রে রেঙুম রঙিলা রে’।
সনজিত্ আচার্যের কথা ও সুরে
‘ওরে কর্ণফুলীরে
সাক্ষী রাখিলাম তোরে‘
বা
‘বাঁশখালী মইষখালী
পাল উড়াইয়া দিলে সাম্মান
গুরগুরাই টানে
তোরা কন কন যাবি আঁর সাম্মানে‘।
উপরোক্ত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানগুলি এখনো চিরন্তন, সীমাহীন জনপ্রিয় কেন তার অবধারিত কারণ, সেখানে স্থিত উপাদাগুলির মোহ যা এ প্রবন্ধের প্রারম্ভে গুণীজনরা বিমোহিত চিত্তে চট্টগ্রামের ভূ– প্রকৃতির সৌন্দর্য, সমাজ জীবন, পরিবেশ, প্রেম, বিচ্ছেদ, বিরহ, সংগ্রাম, সুখদুঃখের উপলব্ধির ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেই বিষয়াবলী আবার চট্টগ্রামের গীতিকার, সুরকার, শিল্পী তাদের লেখায়, সুরে, কন্ঠে অসম্ভব সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার আবেশে, আবেগে, দরদে তাদের গানে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়ে লক্ষ জনতার হৃদয়ে স্পর্শ করতে পেরেছে যা যুগযুগান্তরে প্রবাহমান।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী, লোক গবেষক।
        











