শিল্প নগরী চট্টগ্রাম, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম, অর্থনীতির কেন্দ্র বিন্দু চট্টগ্রাম ইত্যাদি বহুধা নামে অলংকারে ভূষিত হলেও রূপসী রাণী খ্যাত চট্টগ্রাম সর্বদা তার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের সংগ্রাম করছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৫.৫৫ শতাংশ হলেও চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি বিশেষ শ্রেণিভূক্ত। পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যাকা, বন, বণানীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে চট্টগ্রামের ভৌগোলিক বৈচিত্র বাংলাদেশের অন্য কোথাও নেই।
সুপ্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। স্বাধীনতার আগে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বা তারও আগে ব্রিটিশ ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রামের রয়েছে এক গৌরবোজ্জল ইতিহাস। সমুদ্র বন্দরের কারণে চট্টগ্রামকে বলা হলো ‘গেইটওয়ে অব দি ইস্ট’। মূলত ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বাণিজ্যতন্ত্রের স্বর্ণযুগে চট্টগ্রামও ব্যবসা বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। পরিচিতি পায় বাণিজ্যিক রাজধানীর। জাপান ভিত্তিক একটি কনসালটেন্ট গ্রুপ জাইকা ১৯৯৪ জুন হতে ১৯৯৫- এ সময়কালে পরিচালিত জরিপে চট্টগ্রাম এলাকার শিল্পোন্নয়ন বিষয়ক একটি সমীক্ষার চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে। সে রিপোর্টে বলা হয়েছে :
“বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়ন নীতিমালার মধ্যে চট্টগ্রামকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত কেননা আন্তর্জাতিক বন্দর সুবিধার কারণে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাণিজ্য ও শিল্পের ভিত্তি হিসাবে প্রাথমিক কার্যাদি সম্পাদন করেছে”। রিপোর্টের ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্প জোন “বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন (বেজা)”। যেটির নাম দেয়া হয়েছে “বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর”। আশা করা যায় যে, সঠিক নিয়মে চলমান প্রক্রিয়ায় কাজ এগিয়ে গেলে আগামী পাঁচ বছরে এখানে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং উৎপাদনে যেতে পারবে। ইতিপূর্বে ১৯৮৩ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ৪৫৩ একর জায়গা নিয়ে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয় দেশের “প্রথম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন” যা বর্তমানে আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সাড়া জাগানো উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাংলাদেশের সর্বমোট রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৭৫ ভাগ সংগঠিত হয়। অন্যদিকে আমদানী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এর হার ৮০ ভাগ। রাজস্ব আয়ও চট্টগ্রামের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের মোট রাজস্ব আয়ের শতকরা ৬০ ভাগ আসে চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্য থেকে।
বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চল খ্যাত চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলা এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার একর জমিতে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর” প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। বেজার বক্তব্য অনুযায়ী এ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্পায়ন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বেজা ১০ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম শিল্প নগরী হওয়ার সুবাধে সমগ্র চট্টগ্রামই একটি শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখানে বর্তমানে ঘোষিত এবং নিজস্ব উগ্যোগে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল সমূহ হলো, কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকা, কালুরঘাট বিসিক শিল্প নগরী, কালুরঘাট সেতুর অপর পাড়ে বোয়ালখালী, পশ্চিম পটিয়া। পটিয়ায় ইতিমধ্যে শিল্প উদ্যোক্তাদের নিজস্ব্ব উদ্যোগে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
এছাড়া দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতুর অপর পাড় কর্ণফুলী, পশ্চিম পটিয়া, আনোয়ারায় গড়ে উঠেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বৃহৎ ক্ষুদ্র শিল্প সমূহ। পশ্চিম পটিয়ার ইছানগর, আজিম নগর, কর্ণফুলী নদীর পাড় ধরে অনেকগুলো ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, তেলের মিল এবং সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া আনোয়ারায় গড়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ইপিজেড ‘কোরিয়ান ইপিজেড’। সেখানে আরো কয়েকটি বৃহৎ শিল্প স্থাপনার কাজ চলছে। চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা, নাসিরাবাদ বিসিক শিল্প নগরী সহ হাটহাজারী পর্যন্ত শিল্প স্থাপনা বিরাজমান। এখানেও পুনরায় নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। সাগরিকা শিল্প এলাকা এবং সাগরিকা বিসিক শিল্প নগরীতে অনেক বৃহৎ, মাজারী ও ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এ রাস্তা ধরে ফৌজদারহাট, বাড়বকুন্ড, সীতাকুণ্ড হতে মিরেরসরাই পর্যন্ত রাস্তার দুপার্শ্বে গড়ে উঠেছে টেঙটাইল, জুটমিল, ষ্টিল মিল সহ বৃহৎ আকারের শিল্প প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি বাড়বকুন্ডের সমুদ্র উপকূলবর্তী সমুদ্রের পাশ দিয়ে ঘিরে উঠেছে কয়েকটি পেট্টোলিয়াম, এলপি গ্যাস সহ অনেকগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান। যা দেখলে মনে হবে এটি একটি ‘এনার্জি হাব’। এ শিল্প এলাকা সমূহ শিল্প মালিকদের উদ্যেগে একান্ত আন্তরিক প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যেগে গড়ে উঠেছে। এছাড়া সমগ্র চট্টগ্রাম জুড়ে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্পাঞ্চল। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহ দেশের অর্থনীতিতে এবং চলমান সরকারের বিস্ময়কর উন্নয়নের অর্থনীতির একটি বড় অংশীদার।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম হলেও চট্টগ্রাম সর্বদা আমলাতান্ত্রিক রাজনীতির কোপানলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চল দেশের অর্থনীতিতে যেভাবে অবদান রাখছে সে অনুপাতে চট্টগ্রামবাসী সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে আরও বেশি মূল্যায়িত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। চট্টগ্রামের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সেটিও অক্ষুণ্ন রাখতে পারেনি। চট্টগ্রামের সকল প্রকার অবকাঠামোগত সুবিধাদি দেখে বন্দর সুবিধা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দেশি ও বিদেশে উদ্যোক্তারা বিপুল উৎসাহ নিয়ে বিনিয়োগে এগিয়ে আসলেও ঊর্ধ্বতন মহলের হিংসাত্মক মনোভাব এবং অসহযোগিতায় তারা উৎসাহ হারিয়ে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামের শিল্প উদ্যোক্তাদের আরো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছে। দেশের শিল্পোন্নয়নের প্রধানতম অংশ হলো ‘জ্বালানি’। যা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বিগত প্রায় ছয়মাসের অধিককাল সময় ধরে চট্টগ্রামের শিল্প সমূহে কোন গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছেনা। “সরকার ঘোষিত শিল্প এলাকার ঘোষণার একটি বিজ্ঞপ্তিকে অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করে চট্টগ্রামে আবেদিত অনুমোদিত এবং ইতিমধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। শিল্প সমূহ, অর্থ পরিশোধ করেছে এমন শিল্প সমূহে গ্যাস সংযোগের কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ রয়েছে। এতে অনেক উদ্যোক্তার হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মধ্যে পড়েছে।
চট্টগ্রামের উন্নয়নে দায়িত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ কাঁধে নিয়েছেন। চট্টগ্রামের শিল্প স্থাপনার জন্য তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এলএনজি আমদানির ব্যবস্থা করেছেন। তিনি চট্টগ্রামবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহের। কিন্তু বছর দুই যেতে না যেতে সেই পুরনো ষড়যন্ত্র মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে আবারও। কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় চট্টগ্রামের বিনিয়োগ বার বার বাধাগ্রস্ত হয়। বৃহৎ শিল্পাঞ্চল ও বঙ্গবন্ধু শিল্পাঞ্চল শিল্প স্থাপনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হতে আরো অনেক সময়ের প্রয়োজন। এছাড়া ছোট খাট শিল্প বেকারী, গার্মেন্টস্ সমূহ বড় শিল্পাঞ্চলে করা সম্ভব হবে না বা সেখানে জায়গা পাওয়া দুষ্কর হবে। এছাড়া একটি সুযোগ সুবিধা প্রস্তুত না করে চলমান সুযোগ সুবিধা বন্ধ করা কিসের আলামত?
চট্টগ্রাম নিয়ে চট্টগ্রামের সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন কম কথা হয়না। প্রতিটি সেক্টর হতে দাবি ওঠে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয়না, যদিও চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রাণভোমরা। স্বাভাবিকভাবে দেশের স্বার্থেই চট্টগ্রামের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন এবং পরিকল্পিত ও সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাধাগুলো অপসারণ করে কাজ করা জরুরি। শিল্পোন্নয়নের সাথে সাথে নাগরিক সৌন্দর্য এবং সুবিধা সমূহের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, গত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। চট্টগ্রামেও এই উন্নয়নের কিছুটা ছোঁয়া রয়েছে। কিন্তু পরিকল্পিত মাষ্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় অপরিকল্পিতভাবে শহর গড়ে উঠেছে। যে যে ভাবে পারছেন সেভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছেন। কর্ণফুলী টানেল, মেট্রো রেল, এঙপ্রেস ওয়ে সহ অনেক অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আনোয়ারা হতে মিরসরাই পর্যন্ত শহরের যে ব্যাপ্তি হচ্ছে এ কথা মাথায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে।
আমরা মনে করি চট্টগ্রামের উন্নয়নের কথা মানে আঞ্চলিকতার দোষে দুষ্ট কোন কথা না। চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানে দেশের উন্নয়ন। শুধু এটুকু বলতে চাই, চট্টগ্রামের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা ও আন্তরিকতা না থাকলে কোন কাজই সঠিকভাবে আলোর মুখ দেখবেনা। সকল উন্নয়ন প্রক্রিয়া হতে বঞ্চিত হবে চট্টগ্রামবাসী।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী