১৯৭২ ইংরেজি সনের ১৭ মার্চ। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের একপাশে নৌকার আদলে তৈরি করা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। নাম দেয়া হয়েছে ‘ইন্দিরা মঞ্চ’। কারণ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে এ বিশাল আয়োজন। লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ, দুই দেশের নেতার গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ শেষে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন। ভারত বাংলাদেশ দুই দেশের বাঘা বাঘা শিল্পীদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে। এসেছে ওপারের বিশ্বখ্যাত বাউল পূর্ণ চন্দ্র দাস সহ অনেকে। লোকে লোকারণ্য তিল ঠাঁই নেই মাঠের কোথাও। বক্তব্য শেষে শুরু হল শিল্পীদের একে একে পরিবেশনা। একসময় অনুষ্ঠান জমে উঠল। বক্তব্যের মাঝে ইন্দিরা গান্ধীও তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের দুই লাইন গাইলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে‘। অনেক শিল্পীর পরিবেশনার পর স্টেজে উঠলেন পূর্ণচন্দ্র দাস বাউল। গান গেয়ে নেচে যেন কি ঝড় তুললেন সারা মাঠে। তার পর আর কোন শিল্পী সাহস করেনা মঞ্চে উঠতে। হঠাৎ ঘোষণা আসল এবারে মঞ্চে গাইবেন চট্টগ্রামের শিল্পী শেফালী ঘোষ। সারা মাঠে পিন পতন শব্দ নেই। আজানা অচেনা মফস্বলের কোন না কোন শিল্পী কি না কি গায়। সামনে বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী সহ দুই দেশের বাঘা বাঘা উচ্চতর, শীর্ষস্থানীয় লোকজন। স্বাভাবিক ভঙ্গীতেই নিজস্ব স্টাইলে শিল্পী মঞ্চে উঠেই গান ধরলেন, ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম বকসীর আইট্যা পানর খিলি তারে বানাই খাবাইতাম’। আর যায় কোথায় শুরু হল তালি সঙ্গে নৃত্য। লক্ষ জনতার সারা মাঠ জুড়ে সে কি টালমাটাল অবস্থা। পূর্ণ চন্দ্র দাসের ঝড় পরিণত হল টর্ণেডোতে। গান শেষে বঙ্গ বন্ধু উঠে এলেন মঞ্চে। (এখানে উল্লেখ্য, শেফালী ঘোষের স্বামী ননী গোপাল দত্ত এক সময় বঙ্গবন্ধুর ব্যবসায়িক অংশীদার ও মানিক মিয়াসহ কোন এক গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামি ছিলেন। সে সূত্রে পূর্ব পরিচিত)। জানতে চাইলেন টেলিভিশনে গান গাওয়া হয় কিনা? সেদিন থেকে কোনো প্রকার অডিশন ব্যতিরেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ টেলিভিশনে শেফালী ঘোষের গান গাওয়া শুরু হয়। যে গান গেয়ে এ বিশাল মঞ্চ, লক্ষ লক্ষ দর্শক, বিশাল মাঠ টালমাটাল করল সে গানের রচয়িতা ও সুরকার আর কেউ নয় চট্টগ্রামের দরদী সুর সাধক এম এন আখতার। স্বপন দাসাধিকারী সম্পাদিত, সঙ্গীতের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থে দীননাথ সেনের প্রবন্ধ, গানের কাল কালান্তর, পৃ, ১৬৯ এ লিপিবদ্ধ আছে, ‘সব আওয়াজই শেষ পর্যন্ত গান। শব্দ বিজ্ঞান অবশ্য শ্রবণ ক্ষমতার মাত্রা মেপে ডেসিবলের মাপ ঠিক করে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে আমরা শ্রবণসহ বিবিধ পশুপাখির আওয়াজের মিষ্টত্ব খুঁজে পেয়েছি। ঝিঁ ঝিঁ, ঘুঘু, কোকিল, ময়ুর, এমনকি ব্যাঙ সবার ডাকাডাকিতেই আহা, উহু উচ্ছ্বাস শোনা যাবে গানে কবিতায়। ওই সঙ্গী সান্নিধ্যের ব্যাকুলতার আওয়াজই মানুষের কানে গান হয়ে বাজে। শুধু প্রাণী কেন, গান বাজে জড়বস্তুর আঘাতে, কম্পনে, ঘর্ষণে। তবলায় আঘাত, বাঁশীতে ফুঁ, হারমোনিয়ামের বেলো, করতলে ঘর্ষণ–এসব তো সঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী অথবা সঙ্গীতের উৎস।
সত্যজিত রায় তাঁর রবিশংকর প্লেগ রাগ চলচ্চিত্রে দেখিয়ে দিয়েছেন শ্রমজীবীর হাত ও পায়ের কারুকৃতিতেও রাগ রাগিনীর সুর বাজে’। আমরা এমন বক্তব্যের অনুকূলে আমাদের মহান সুর সাধক এম এন আকতারের রচিত গানের গ্রন্থ ‘এম এন আখতারের গান‘ এর ভেতরের মলাটে তার লিখিত সমসুরের বক্তব্য পাই, তিনি বলেন, ‘আদি কালে গান বলে কোন শব্দ ছিলনা। গান মানেই সুর। বিজ্ঞানীরা যখন ভাবলেন সুর বলে একটি মহান শক্তি বাতাসের মত পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে এবং প্রাণীজাত তথা মানব দেহের সাথে সম্পৃক্ত, মুখে প্রকাশ পায়। যেমন, কোকিল শেয়াল, মোরগ ডাকে, পাঁচ ওয়াক্ত আজানের সুর কতই মধুর, সুন্দর। তারা কি সঙ্গীত চর্চা করেছিল? এই সুর হচ্ছে পৃথিবীর কক্ষ পথের মেজাজ। যার গতি আছে, লয় আছে, দোল আছে, ছন্দ এবং সুর আছে। গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবী আপন কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে চব্বিশ ঘণ্টায়। এর মধ্যে সে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। যেমন দিন, রাত, সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা এবং প্রদক্ষিণকালে বিভিন্ন স্বর বা মেজাজ সৃষ্টি করে। এ সকল সম্মিলিত স্বরের ধ্বনি থেকেই সুরের সৃষ্টি হয়। তার মতে, সুর হচ্ছে আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামত, অতীব পবিত্র, পবিত্র এ সুর মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে, হৃদয়ে প্রেম সৃষ্টি করে, মানুষকে ভালোবাসতে শিখায়। সঙ্গীতের পবিত্র সুর আল্লাহ্ ও রসুলের প্রতি অনুরাগী করে তোলে। সুর মানুষকে কাঁদাতে পারে, হাসাতে পারে, উজ্জীবিত করতে পারে। আল্লাহ্ পাক পবিত্র কোরআন এর এক জায়গায় বলেছেন, ‘আপনার পালন কর্তার দয়ার আশা আপনিও করুন, সেই দয়ার আকাঙ্ক্ষীদের কাছে প্রিয় হতে চাইলে তাদের সাথে নরম সুরে, বিনয়ের সাথে এবং মিষ্টি সুরে কথা বলুন। সুরেলা কথা আমার কাছে গান বলে বিবেচিত। সুতরাং পৃথিবীর কক্ষপথের সৃষ্টি আল্লাহ্ প্রদত্ত। সুর ছাড়া গান কোন দিনই হবে না। তাই প্রতিটি মানুষের কলব বা অন্তর পরিষ্কার করার লক্ষ্যে অন্তত দু–এক লাইন সুরেলা গান মুখে আওড়ানো উচিত’।
তার রচিত ও বহুল জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক গানের মধ্যে ‘ও পরাণের তালত ভাই চিডি দিলাম পত্র দিলাম নো আইলা কিল্লাই’। ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম বকসীর আইট্যা পানর খিলি তারে বানাই খাবাইতাম’। ‘বরই ফুলর থামি আর একখান গুলবাহার যদি পাইতাম আই পিনতাম আনা ধরি চাইতাম আরে কেন সুন্দর লার’। ‘কৈলজার ভিতর গাথি রাইখ্যম তোয়ারে শিনার লগে বাজাই রাইখ্যম তোয়ারে ও ননাইরে’। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সাবিনা ইয়াসমিন এর সাথে যুগল কণ্ঠে গ্রামোফোন এ গান রেকর্ড করেন। ‘যৌবন জ্বালায় মরি আই বুদ্ধি হন্নান গরি’। ‘ন যাইয়ম বদ্দা যাইতান আই লাল মিয়ার বাড়ী ইতা আরলয় কথা কয় চউক মারি মারি’। ‘ন যাইয়ম যাইতাম নঅ, পইরর ঘাডত ঘরা লই হেইদিন্না আর হাউসর ঘড়া ভাঁই গেইয়ে গৈ’। ‘ও বালি আয় আয় ওরে না না এক্কান মিনিট আঁর লগে তুই কথা কৈ য না’। উমা খানের সাথে রেকর্ড আছে দ্বৈত কণ্ঠে। ‘বাছুরে জি, অ বাচু জি জি জি চাটগাঁ শহরত যাইঅম আই তোয়াল্লাই আইন্ন কি’। উমার সাথে রেকর্ড আছে। ‘ছাম্মান ওয়ালা কে কোরত কেনে যাইঅম বব্বুরত বব্বুর জামাই থিয়াই রৈয়ে ঘাডার দুয়ারত’। ‘বন্ধু কথা ন কইও তুই ইত্তার ন যাইও যাইবার সময় এক্কান মিনিট আরলাই থিয়াইও’। ‘অ নাসিমন, কঅ কি কারণ শাড়ি পিনতে লাগে যদি এতক্ষণ’। ‘আট্টুউয়া পার হৈতে শাড়ি ছিড়িলি বৈন কি গরলি’। ‘জালালী কৈতর বাহ বাইন্দে খাইল্যা ডোলর ভিতরে’। এ ছাড়াও বহুল জনপ্রিয় আধুনিক গান মধুমিতা ছবিতে শেফালী ঘোষের গাওয়া, তুমি যে আমার জীবনের উপহার কি করে তোমায় আমি ভুলব। পল্লী গীতি, মাঝি রে রঙিলা নাও ভিড়াও ভিড়াও আমার ঘাটে তোমায় নিয়ে যাব আমি ময়না মতির হাটে। আবার বন্ধু রে কি করি উপায় তোমার প্রেমে পরাণ বুঝি যায়। মাইজভাণ্ডারি, ‘আমি ঐ গাউছিয়া নামের দেওয়ানা’, ১৯৭৭ সালে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে রেকর্ড করেন। যদিও স্বাধীনতাপূর্ব কালে আমার প্রথম শোনা মাইকে ‘কুকুর মাথাওয়ালা’ পিন দিয়ে গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন বিয়ে বা আনন্দোৎসবে দুটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গান শিল্পী মিয়া মোহাম্মদ বদরুদ্দিন এর গাওয়া বেশ জনপ্রিয় ছিল। একটি, ‘মনর জ্বালা ন ফুরাইল আঁর কোয়ালর দুঃখ ন ফুরাইল ছারকোয়াইল্লা লারি জেইরগান্নুয়া রাড়ি বানাইল’ অন্যটি মনে নেই। আমরা জানি মলয় ঘোষ দস্তিদার এর রচনা ও সুরে ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি’ প্রথম আঞ্চলিক গান। যা চট্টগ্রামের জাতীয় সঙ্গীত। সবার কাছে সমধিক সমাদৃত ও যা চিরকালের, চট্টগ্রামের সঙ্গীত জগতে চির অম্লান, অমর হয়ে থাকবে। ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম বেতারে শিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব প্রথম দুটি আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন একটি নিজের রচনা ও সুরে , ‘চল অ পুত বিলত যাই জালা বিচানা চয়ন পরিব আলু রুইবার লাই’।
অন্যটি অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তীর কথা ও সুরে, ‘গুরা বউ বউ রে সন্ধ্যা কালে চেরাগ দিত গেল’। সব ছাপিয়ে ১৯৩৪ সালে জগন্ময় মিত্রের তত্ত্বাবধানে কোলকাতা থেকে সর্ব প্রথম চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের গ্রামোফোন রেকর্ডে আহমুদুল হক সিদ্দিকী রচিত ও শিল্পী মোঃ নাসিরের কণ্ঠে ও সুরে ‘চাঁনমুখে মধুর হাসি ওভাই দেবাইল্যা বানাইল রে মোরে সাম্পানর মাঝি’। যে গান আমি প্রথম শুনি আমাদের গ্রামের বৈশাখী মেলার শেষে রাতের ‘ভ্যারাইটি’ শো তে নৃত্য শিল্পী আলম আরার কণ্ঠে (বর্তমান বেতার ও টেলিভিশনের বিশিষ্ট তবলা বাদক আরজুর মা)। নৃত্যের তালে তালে অসাধারণ সে গান। গানের মোহময়তা মায়াময়তা অপূর্ব। অনেক পরে আমরা মাইকে ও বেতারে সে গান পাই। একটা বিষয় ছিল, সেকালে আঞ্চলিক গান সকল শ্রেণির লোকজন শুনত না। কেমন যেন নাক সিটকাত। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দেওয়ানা’ গেয়ে মঞ্জুশ্রী সেন নামে এক নৃত্য শিল্পী মানুষকে প্রথমবার উন্মাতাল করে দেয়। বেতার ও টিভিতে শেফালী ঘোষ গেয়ে জনপ্রিয় করার আগে। সে সময় আমরা যাত্রা ভ্যারাইটিতে আরো শুনেছি, ‘ন যাইয়ম বদ্দা যাইতাম ন আই লাল মিয়ার বাড়ী ইতা আরলয় কথা কয় চউক মারি মারি বা ন যাইয়ম যাইতাম ন ফৈর ঘাডত ঘড়া লৈ এদিন্না আর হাউসর ঘড়া ভাঙি গেইয়ে গই’। দুটি গানই আগেই বলেছি এম এন আখতারের রচিত ও সুরারোপিত।
আমরা রমেশ শীলের, ‘আঁধার ঘরত রাইত কাডাইয়ম কারে লৈ, আস্কর আলী পণ্ডিতের ‘কি জ্বালা দি গেলা মোরে’, পণ্ডিত খাইরুজ্জামা’র, ‘বৈনর বেনারশী শাড়ি গায়, আয়না ধরি সিতা পারের বৈনে খিড়কির কিনারায়’সহ অনেক কালজয়ী গান পেয়েছি যা সংখ্যায় অল্প তবে অনেক আগের রচনা। যেগুলি আমাদের কিছু অসাধারণ কণ্ঠশিল্পী জনগণের কাছে এনে, গেয়ে, রেকর্ড করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তুলেছেন। তবে দরদী সাধক এম এন আখতার দেড় হাজারের অধিক বিবিধ গান লিখেছেন, আঞ্চলিক ভাষায় নাটক রচনা করেছেন অনেক এবং সঙ্গীতের প্রতি একমাত্র ভালোবাসার কারণে একজন সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও একটা বিশেষ আবহে, ভিন্ন সুরে, ব্যতিক্রমী কথায়, বিষয়ে, প্রেম ও যৌবনের ইশারায়, কালের স্রোতের অবগাহনে, সমাজ সংস্কৃতি ও প্রকৃতির নানা উপাদান অন্তর্ভুক্ত ও উপস্থাপন করে অন্যান্য গানের পাশাপাশি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যে এতো গান রচনা ও সুরারোপিত করে আমাদের জন্য রেখে গেছেন তা আর কেউ করেনি। যার সব ক’টি রুচিসম্পন্ন, সমান জনপ্রিয় ও দর্শকের মন জয় কারী, কালজয়ী গান হয়ে থাকবে। দরদী সুর সাধক এ মানুষটি ১৯৩১ ইংরেজি সনের ১ জুলাই রাউজান উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ও ২০১২ ইংরেজী সনের ১৮ এপ্রিল সুরের সাধনা ছেড়ে , করুণার বাণী ও হারমোনিয়াম ত্যাগ করে সৃষ্টি কর্তার কাছে চলে যান।
লেখক: প্রাবন্ধিক, লোক সংগীতশিল্পী