চট্টগ্রামে ২৩ জুন পার হয়ে গেলো নীরবে। ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় সমাবেশ করে আওয়ামী লীগের জন্মদিন উদযাপন করা হলেও চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের তিন শাখা–উত্তর–দক্ষিণ জেলা ও মহানগর কমিটি সম্মিলিতভাবে দলের জন্মদিন উদযাপনের জন্য কোন আনন্দ–উৎসবের আয়োজন করেনি । চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অবস্থান বর্তমানে যেকোন সময়ের চেয়ে সংহত ও শক্তিশালী। কিন্তু মাঠের রাজনীতি সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ফেইসবুকে স্থান করে নিয়েছে। দলীয় অফিসের চেয়ে নেতাদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত অফিস, বাসাবাড়িতেই সকাল–সন্ধ্যা কর্মীদের ভিড় জমে। হায় হায় দলীয় রাজনীতিকে অফিসমুখো করার জন্য মহিউদ্দিন চৌধুরী কত ভাবেই না চেষ্টা চালিয়েছিলেন। প্রতিদিন সকাল ১০টা/১১টা বাজলে ড্রাইভার শাহ আলমকে নিয়ে লক্করঝক্কর মার্কা কারটা নিয়ে তিনি চলে আসতেন দারুল ফজল মার্কেটে।
লন্ডন প্রবাসী অভিজিৎ ধর বাপ্পী, মরহুম লিয়াকত আলী খান, হাসান মাহমুদ শমসের, শমসুদার ছেলে নওশাদ মাহমুদ রানা, মফিজুর রহমান, আশীষ খাস্তগীর, ডা. জাকেরিয়া চৌধুরীর দু’পুত্রের মধ্যে শাহীন বা টিপু, চট্টগ্রাম কলেজের লিয়াকত, কখনো খালেকুজ্জামান, কখনো বা হাটহাজারীর আবদুল হাশেম, কর্মী বলতে এই তো ক’জন। বখতেয়ারউদ্দিন খান, সিরাজ–এরাও বোধ হয় আসতেন। আর মহিউদ্দিন চৌধুরীর বন্ধু রঘুদা। ২টা/৩টা পর্যন্ত অফিস করে তখন মধুবনের নতুন শো–রুম খুলেছিলো দারুল ফজল মার্কেটের নীচতলায়; সেখান থেকে বিস্কুট বা চানাচুর কিনে রাস্তা পেরিয়ে পূর্বদিকে বুক সোসাইটি বিল্ডিংয়ের দোতলায় পূর্বকাণে অফিসে চলে আসতেন। আমি বসে থাকতাম। এসে বলতেন নাসির, সবাইকে ডাকো, চলো কিছু খাই। এই ছিলো মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রাত্যহিক রুটিন।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী তো রাজনীতি করার জন্য বাসাতেই থাকতেন না। তিনি স্টেশন রোডে ডাক বাংলার ২৩নং কক্ষ ভাড়া নিয়ে, সেখানে তাঁর রাজনীতি, ট্রেড ইউনিয়ন ও ব্যক্তিগত অফিসও করতেন। রাতে কখনো বাসায় যেতেন, কখনো যেতেন না।
স্ত্রী–পুত্র নয়, তাঁর সংসার ছিলো বোয়াইল্লা অলা (বাকলিয়ার লোক) ইদরিস আলম; আমানত খাঁর পুত্র আশরাফ খান, কাট্টলীর ট্রেড ইউনিয়ন বিশেষজ্ঞ জামশেদ আহমদ চৌধুরী, আগ্রাবাদের ছিদ্দিক, বিটিসির মোহাম্মদ উল্লাহ ভুঁইয়া, আমিন জুট মিলের জয়নাল আবেদিন প্রধান, আতুরার ডিপোর ফজল হাজির ভ্রাতুষ্পুত্র কবি বদন দীদারি, বিটলীগঞ্জের নূর মোহাম্মদ চৌধুরী, খাতুনগঞ্জের শয়ীতুল্লাহ হাজির পুত্র শাহ বদিউল আলম, মহিউদ্দিন চৌধুরী, চন্দনাইশের আবদুর রহমান, পাঠানটুলীর খায়রুল আনোয়ার, জোয়ারার রাখাল বাবু, আনোয়ারার নিত্য বাবু, পাথরঘাটার সন্তোষ বাবু, সম্পদ বড়ুয়া–এঁদেরকে নিয়ে ছিলো জহুর আহমদ চৌধুরীর সংসার। আজিজ মিয়াও রাজনীতি করার জন্য জেলা আওয়ামী লীগের জন্য যে অফিস নিয়েছিলেন ১২০নং আন্দরকিল্লায়, সেখানে থেকে যেতেন। রাতে সঙ্গ দেয়ার তাঁর খালাতো ভাই মাইক এজাহারকেও রেখে দিতেন।
আজিজ–জহুর ছিলেন এক বৃন্তে দুুটি ফুল। আওয়ামী বৃক্ষে ফুটেছিলো খুশবুদার সুন্দর এই দুটি ফুল। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তনের জন্য যদিও আনোয়ারার রায়পুরের মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী সবচেয়ে বেশি; কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। ফলে তাঁর আর উত্তরণ ঘটেনি। আবদুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আরো যাঁরা ছিলেন তারা হচ্ছেন মওলানা আবু তাহের, সালারে জিলা শহীদ শেখ মোজাফফর আহমদ, আমীর হোসেন দোভাষ, লন্ডন শমসু–খ্যাত ডা. শামসুল আলম চৌধুরী, চান্দগাঁওর আজিজ মিয়ার খালাতো ভাই ইউনুছ খান, আনোয়ারার মওলানা ছালে জহুর, মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী প্রমুখ। চকরিয়ার গোরা আজিজ, সাবানঘাটার মওলানা নুরুল ইসলাম এবং হারবাংয়ের ডা. আনোয়ার, পাথরঘাটার সিএসপি আইয়ুব কাদেরী ও মুক্তিযোদ্ধা আনিস কাদেরীর পিতা কবির উদ্দিন আহমদ বিএ, আশরাফ আলী রোডের মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বিএ, পাথরঘাটা বান্ডেল রোডের বদর রহিম সওদাগরের পুত্র ও খাতুনগঞ্জের রাজা মিঞা সওদাগরের দৌহিত্র লন্ডন প্রবাসী ও সেখানে প্রয়াত এমএ গণি, খান সাহেব আবদুল হালিম চৌধুরীর পুত্র ও হাতি কোম্পানির নাতি চৌধুরী এন জি মাহমুদ কামাল, সাংবাদিক ওবায়দুল হক, চকবাজারের খড়ম ছালেহ ও আলকরণের এম ইউ সি মোহাম্মদ ছালেহ, বাংলা বাজারের বজল মিয়া, বালির বাপ ও আবুল খায়ের চৌধুরী–এঁরাও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা বা কর্মী।
জহুর আহমদ চৌধুরীর কথা বলা যাক। ১৯৭৪ সালে আজকের এই দিনে ঢাকা পিজি হাসপাতালে কেবিনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর শীর্ণ দেহপিঞ্জর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো প্রাণভোমরা। তার আগে দেশের প্রেসিডেন্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রিয়বন্ধুকে দেখতে এসে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে গিয়েছেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী অনেক কিছুই প্রথম করেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম তাঁর কাছে আসে। সারাদেশের আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে তিনি প্রথম সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যান সেদেশের সরকারের কাছে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও সাহায্য চাইতে। তাঁর সঙ্গে এমআর সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আল হারুন, আতাউর রহমান কায়সার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবিরের ধারণা ও বাস্তবায়ন তিনিই প্রথম করেন আগরতলায়। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা জন্য গঠন করেন ইস্টার্ন লিবারেশন কাউন্সিল। ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বেই তিনি কসবায় মুক্তাঞ্চলে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি প্রথম ঢাকায় গিয়ে বেতার থেকে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সংবাদ দেন।
মন্ত্রী হওয়ার পর ঢাকায় প্রথম যে বড় কাজটি তিনি করেন, সেটি হচ্ছে শাহবাগ হোটেলকে পিজি হাসপাতালে রূপান্তর। এখন জানা যাচ্ছে, ফয়স লেকের চক্ষু হাসপাতাল তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর জন্মস্থান চট্টগ্রামে একটি আন্তর্জাতিক মানের চক্ষু হাসপাতাল করার জন্য তাঁর বিবেকের কাছে সাড়া পেয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসে উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হন পশ্চিম জার্মানির আন্দেরি হিলফি নামের একটি মানবিক সংস্থার প্রেসিডেন্ট রোজি গোলম্যান। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জায়গা চাইলে রেলমন্ত্রী তো না দিয়ে পারেন না। সুতরাং চক্ষু হাসপাতালের জন্য ফয়’স লেকে রেল থেকে জায়গাটি পেয়ে যান তিনি। ফয়’স লেকে রেলওয়ে থেকে জমি বরাদ্দ নিয়ে বৈদেশিক আর্থিক সহায়তায় বর্তমান চক্ষু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশকে বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবা প্রদান করে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছে লাখো মানুষের চোখের আলোকবর্তিকা। চোখের চিকিৎসায় শুধু চট্টগ্রামেই নয়, পুরো দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে এই হাসপাতালটি। আজ দেশের অগণিত মানুষের চোখের চিকিৎসার বিশ্বস্ত ঠিকানা চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যার স্থানীয় নাম পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল।
তিনি একটি আধুনিক চক্ষু হাসপাতাল নির্মাণের লক্ষ্যে ২৪ মার্চ ১৯৭৩ ইং বাংলাদেশ অন্ধ কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রামের একটি এডহক কমিটি গঠন করেন। শিল্পপতি এ. কে. খানকে প্রেসিডেন্ট, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা: এস জোহা, খ্যাতিমান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা: এ. কে. এম. আবু জাফর ও সহকারী পরিচালক সমাজসেবা অধিদপ্তর জওশন আরা রহমানকে সহ–সভাপতি, বন্দর হাসপাতালের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা ডা: কামাল এ. খান ও বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা: এস. আর. দাশকে যুগ্ন সম্পাদক, এলিট পেইন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজ উদ্দিন আহমদকে কোষাধ্যাক্ষ এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন খ্যাতিমান ১৮ ব্যক্তিকে সদস্য করে উক্ত এডহক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির গঠন সংক্রান্ত নথিতে সম্পাদকের কোন নাম না থাকলেও; পরবর্তীকালে সম্পাদকের ঘরে একটি নাম হতে লিখে বসিয়ে দেয়া হয়। জানা যায়, জহুর আহমদ চৌধুরী মন্ত্রীত্বের ক্ষমতাবলে প্রথমে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লাস্থ জেনারেল হাসপাতালের দুটি রুম বরাদ্দ দিয়ে চক্ষু হাসপাতালের যাত্রা শুরু করেন। সরকারি কোষাগার থেকে উক্ত হাসপাতালের ব্যয় মিটানোর জন্য জহুর আহমদ চৌধুরী সম্ভবত ৬০ হাজারের অধিক পরিমাণ টাকার চেক প্রদান করেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন সেল্ফলেস বা আত্মত্যাগী নেতা। নিজের বা নিজের পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রত্যেক মানুষই তো আয়–রোজগার করে, সঞ্চয় করে, সোনা কেনে, জায়গা–জমি কেনে, বাড়িঘর তৈরি করে; জহুর আহমদ চৌধুরী সেসব কিছুই করেননি। রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে, মন্ত্রিত্বের ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে টাকা–পয়সা বানাবেন তেমন রুচি বা মনোবৃত্তি তাঁর ছিলো না। টাকা–পয়সার ব্যাপারে আশ্চর্য নির্লিপ্ত, উদাসীন ছিলেন তিনি। কিভাবে কত দুঃখ কষ্টের মধ্যে তাঁর বিরাট পরিবারের ছোট–বড় সদস্যদের দিন কাটতো, সে খবর তাঁর অজ্ঞাতই থেকে যেত। পল্টন রোডের তাঁর বাড়িটি ছিলো শ্বশুরের দান করা। শিবের মত সংসার সম্পর্কে উদাসীন উড়নচণ্ডী জামাইর স্বভাব বুঝে শ্বশুর যদি জায়গা দান না করতেন, তাহলে শহরে বিরাট পরিবার নিয়ে মাথা খোঁজার ঠাঁইও থাকতো না জহুর আহমদ চৌধুরীর। তাঁর ডাক বাংলার কর্মীদের কাছে শুনেছি দৈবাৎ পকেটে যদি টাকা থাকতো, তাহলে তা অন্যকে দিয়ে পকেট খালি করে না ফেলা পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পেতে না।
পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পর মরদেহ নিয়ে আসার সময় তাঁর কাছে যে ব্রিফকেস ছিলো, সেটি খুলে মাত্র ২০০টি টাকা পাওয়া গিয়েছিলো। চারটি মন্ত্রণালয়ের যিনি মন্ত্রী, তাঁর পকেট হাতড়ে মাত্র ২০০ টাকা পাওয়া গেল, আজকের দিনে এমন ঘটনা কি কল্পনাতেও আনা যায়?
আদেশ পালনের জন্য নিজের প্রিয় পুত্রকে কোরবানী দিতে উদ্যত হয়েছিলেন, জহুর আহমদ চৌধুরীও তেমনি প্রাণধিক প্রথম পুত্রটিকে দেশমাতৃকার মুক্তিযুদ্ধে কোরবানি দিয়েছিলেন। এই পুত্রের নাম সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী সবাই জানেন। ১৩ এপ্রিল ’৭১ রাউজান পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। একজন আইজি বা এনবিআর–এর সাবেক সদস্যের কাছ থেকে যে বিস্তর টাকা, বিপুল সম্পত্তি উদ্ধার হচ্ছে, তাতে চার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী চাইলে কত সম্পদের মালিক হতে পারতেন? জহুর আহমদ চৌধুরী এমএলএ (১৯৫৪), এমপি (১৯৭০ ও ১৯৭৩) ও মন্ত্রী (১৯৭২–১৯৭৪) হয়ে কানাকড়ির মালিকও হননি। টাকা–পয়সা বা সম্পত্তির প্রতি তিনি ফিরেও তাকাননি; বিষয়বাসনার বালাইও তাঁর ছিলো না।
হযরত ইব্রাহিম যেমন আল্লার আদেশ পালনের জন্য প্রিয়তম পুত্রকে কোরবানী দিতে উদ্যত হয়েছিলেন, জহুর আহমদ চৌধুরীও তেমিন প্রাণাধিক প্রথম পুত্রটিকে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে কোরবানী দিয়েছিলেন। এই পুত্রের নাম সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, সবাই জানেন। ১৩ এপ্রিল ’৭১ রাউজান পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন সাইফুদ্দিন।
জহুর আহমদ চৌধুরী একজন ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ। এমন নেতা গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না। কালেভদ্রে তাঁরা জন্মগ্রহণ করেন এবং কালকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণ হয়ে যান। তাঁরা যুগস্রষ্টা পরমপুরুষ স্বীয় জীবনকালেই তাঁরা কিংবদন্তী হয়ে যান এবং ব্যক্তি জীবনের গণ্ডি ছাপিয়ে ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন।
৪৭–এর দেশভাগ–উত্তর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আমরা যেসব প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিষ্ঠাবান নেতার সাক্ষাৎ পাই, তাঁদের মধ্যে খান সাহেব আবদুল হক দোভাষ, শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী, খান বাহাদুর ফরিদ আহমদ চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ব্যারিস্টার সানাউল্লাহ, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ, আমীর হোসেন দোভাষ, সুধাংশু বিমল দত্ত, নেলী সেনগুপ্তা, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, চৌধুরী হারুনুর রশিদের নাম উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানের তেইশ বছরের চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসকে পর্যালোচনা করে উপর্যুক্ত নেতাদের মধ্যে ৭০ সালে মাত্র দু’জনকেই নেতৃত্বের স্বর্ণ সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখা যায়। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী। মুসলিম লীগের সমস্ত নেতা স্বর্গচ্যুত হয়ে ধূলিশয্যা নিয়েছেন। যাঁরা প্রবীণ তাঁরা পরলোকবাসী; জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবল জোয়ারে ন্যাপ–কমিউনিষ্ট পার্টির আন্তর্জাতিক রাজনীতি খড়কুটোর মত ভেসে গেছে।
এমএ আজিজ ৭১–এর ১১ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জহুর আহমদ চৌধুরী একাই তখন চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। জহুর আহমদ চৌধুরী ইতিহাস গড়লেন। তাঁর সামনে আরো ইতিহাসের হাতছানি। জহুর আহমদ চৌধুরী তাতে সাড়া দিতে ভুল করলেন না। নব নব ইতিহাস সৃষ্টি করে তিনি নিজেও ইতিহাস হয়ে গেলেন। বাংলাদেশে তখন একে একে অনেক ঘটনা ঘটে যাবে। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালাবে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন এবং চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে সেই ঘোষণা পাঠাবেন দেশে বিদেশে প্রচারের জন্য।
জহুর আহমদ চৌধুরী সম্ভব সব পন্থায় সে ঘোষণা প্রচারে ব্যবস্থা করলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সাইক্লোস্টাইল করে হাজার হাজার কপি ছড়িয়ে দিলেন মানুষের মাঝে। ট্যাক্সি, রিক্সা, ঠেলা গাড়িতে মাইক লাগিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারে নিয়োজিত করেছিলেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা–কর্মীদের। তিনি নিজে, তাঁর পরিবার এবং সমস্ত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতৃ ও কর্মীবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন।
জহুর আহমদ চৌধুরীর দামপাড়া পল্টন রোডের বাড়িটি ছিলো শহরের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সে বাড়ি থেকেই শহরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাও পাঠিয়েছিলেন সেই বাড়ির টেলিফোনে। এসব কারণে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাড়িটির ওপর খড়্গহস্ত ছিলো। তাই ক্র্যাকডাউনের পর প্রথম চোটেই ক্রুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর বাসভবনটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ও পরে গুঁড়িয়ে দেয়।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।