চটপটি বিক্রেতা আলাউদ্দিনের নামে একের পর এক মামলা

২০ বছরে সাতবার কারাগারে, সম্পৃক্ততা না থাকায় বেশিরভাগ মামলায় অব্যাহতি

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

নগরীর কাট্টলীতে ফুটপাতে চটপটি বিক্রেতা আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক, অস্ত্রসহ নানা অপরাধের ঘটনার অভিযোগে বিভিন্ন সময় অন্তত এক ডজনের অধিক মামলা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ মামলায় তার কোনো সম্পৃক্ততা আদালতে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
আলাউদ্দিনের পরিবারের অভিযোগ, ‘গত বিশ বছরে তাকে সাতবার কারাগারে যেতে হয়েছে। পরোয়ানা নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই ছিলেন পরিবার ছাড়া। এমনকি ভিন্ন জেলার মামলায়ও আসামি হিসাবে তাকে গ্রেপ্তার চেষ্টার পাশাপাশি পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী বানোনোরও অপচেষ্টা হয়েছিল।’
পরিবারের আরও অভিযোগ, একটি দুর্ঘটনায় আলাউদ্দিন পঙ্গু হওয়ার পরও ক্ষান্ত হয়নি মামলা দিয়ে হয়রানি করা চক্রটির তৎপরতা। একটি মামলা থেকে অব্যাহতি পেলে তার কপালে আরেকটি মামলা এসে জুটে।
স্থানীয় ও জনপ্রতিনিধির তথ্য অনুযায়ী আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে এলাকায় অপরাধে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। এটা নিয়ে প্রত্যয়নপত্রও দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও কাউন্সিলরসহ অনেকে।
তার পরিবারের দাবি, দুই দশক আগে আলাউদ্দিনের এক আত্মীয়ের সাথে সামান্য কিছু জায়গা নিয়ে বিরোধে জড়ানোর পর থেকেই একের পর এক মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি হচ্ছে। বিভিন্ন মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনেও একই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী- আলাউদ্দিনের সাথে তার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জায়গা জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে একাধিক মামলা হয়। প্রতিপক্ষ বিভিন্ন মামলায় আলাউদ্দিনকে জড়ায়। ওইসব মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে অপরাধের সাথে আলাউদ্দিনের কোনো সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় পৃথক আদালতে এক এক করে প্রায় সব মামলায় আলাউদ্দিন খালাস পেয়েছেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট ধৃতিমান আইচ আজাদীকে বলেন, ‘লোকটি (আলাউদ্দিন) নিরীহ এবং নিতান্তই গরীব লোক। অথচ তাকে একের পর এক বিভিন্ন থানার মামলায় জড়িয়ে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে তার প্রতিপক্ষ। এখনও একের পর এক তার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। পূর্বের বেশিরভাগ মামলায় তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।’
আইনজীবী ধৃতিমান আইচ আরো বলেন, আমরা তার আর্থিকসহ সার্বিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মামলাগুলো পরিচালনায় কোনো ফি পর্যন্ত নিচ্ছি না। মূলত আত্মীয়-স্বজনের সাথে জায়গা সংক্রান্ত বিরোধ থেকেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। তার এক ভাই বধির। অথচ তাকেও কোতোয়ালী থানায় একটি মামলায় আসামি করা হয়েছিল।
এটা নিয়ে সিএমপি সদর দপ্তর থেকে একটি তদন্তও চলছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন বলে জানতে পেরেছি। এসময় বিভিন্নজন বক্তব্য দিয়েছেন।’
২০১৯ সালের ২৩ মার্চ আলাউদ্দিনের বিষয়ে পাহাড়তলী জোনে তৎকালীন সহকারী কমিশনার পঙ্কজ বড়ুয়ার করা সর্বশেষ একটি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, ‘আলাউদ্দিন তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দশটি মামলার মধ্যে পাহাড়তলী থানার ৬(৫) ২০০৭ ইং, একই থানার ৩০ (২) ২০০৯ ইং, ৮ (১১) ২০০০ইং, ৯ (১১) ২০০০ইং, ৫(৮) ২০০৩ইং, ৭ (৫) ১৯৯৯ ইং, ডবলমুরিং থানার ৭ (১) ২০০৫ ইং, আনোয়ারা থানা ৭ (৯) ২০০২ইং মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।’ এছাড়া তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একাধিক জিডির বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘উল্লেখিত জিডিগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো বাদী নেই। কয়েকটি জিডির বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’
হয়রানি থেকে রেহাই পেতে প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি প্রশাসন ও আইনশৃক্সখলা বাহিনীর দপ্তরে তার স্ত্রী বিবি মরিয়ম চিঠি দিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন। তিনি আজাদীকে বলেন, নিজের স্বর্ণ বিক্রির পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন ও ১০/১২টি সমিতির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এত মামলার খরচ চালিয়ে আসছেন। তাদের পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে বলেও জানান ভুক্তভোগীর স্ত্রী।
মরিয়ম দাবি করেন, আলাউদ্দিনের এক আত্মীয়ের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ পুলিশে, কেউ আইনজীবী আবার কেউ আদালতে কর্মচারী হিসেবে কর্মরত আছেন। এতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারাই মূলত তার স্বামীর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের করে চলেছেন।
পরিবার বলছে, বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ১৯টি মামলার মধ্যে আদালত ১৩টি মামলা থেকে আলাউদ্দিনকে খালাস দিয়েছেন। ২০১৬ সালে একটি দুর্ঘটনায় পঙ্গু থাকাকালীন কোতোয়ালী থানায় ডাকাতি ও অস্ত্র মামলায় আসামি করা হয় আলাউদ্দিনকে। ২০১৯ সালে ইপিজেড থানার একটি হত্যা মামলায় (নং-১৬(০৬)১৯) তদন্ত প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই অপরাধের সাথে আলাউদ্দিনের কোনো সম্পৃক্ততা না পেয়ে তাকে মামলা থেকে বাদ দেয়ার সুপারিশ করেন।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট এএইচ এম জিয়া হাবীব আহসান আজাদীকে বলেন, প্রভাবশালীরা জায়গা-জমি বিরোধ কিংবা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে বিভিন্ন সময় প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্য এ ধরনের মামলায় ফাঁসিয়ে সর্বস্বান্ত করে। এটা শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারাদেশে এ ধরণের মামলায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে সর্বস্বান্ত করার ঘটনা অহরহ ঘটছে।
মানবাধিকারের এ নেতা বলেছেন, ভুক্তভোগী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় সাধারণত আদালত তাকে খালাস দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন। আদালত যদি ভুক্তভোগীকে খালাস দেয়ার পাশাপাশি তাৎক্ষণিক মামলায় জড়ানোর জন্য ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দান কিংবা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিতেন তাহলে এ ধরণের মামলায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর ঘটনা অনেক কমে যাবে। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে বিভিন্ন সময় মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে নিম্ন আদালতগুলোতে এ ধরণের ব্যবস্থা দেখা যায় না।
উত্তর কাট্টলীর কর্ণেলহাট এলাকার মৃত শেখ আহমদের ছেলে আলাউদ্দিন কর্ণেলহাটে দীর্ঘসময় ফুটপাতে ফুচকা ও চটপটি বিক্রি পেশার সাথে জড়িত থাকায় স্থানীয়রা তাকে চটপটি আলাউদ্দিন্যা বলে চেনে। মোহাম্মদ ইসহাক ও হাফিজুর রহমান নামে তার দুই ভাইও একই পেশায় জড়িত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদ্বিতীয় টিউবের কাজ শুরু হচ্ছে আজ
পরবর্তী নিবন্ধমোবাইলে ইউটিউব দেখতে না পারায় কিশোরীর আত্মহত্যা