ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ পেয়ে কক্সবাজারের চকরিয়া সাব রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে রুদ্ধশ্বাস অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি এনফোর্সমেন্ট টিম। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত একটানা ৯ ঘণ্টার এই অভিযানে জব্দ করা হয়েছে সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া ঘুষ বাবদ ৬ লাখ ৪২ হাজার ১০০ টাকা। ঘুষের এই টাকা হেফাজতে পাওয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে চকরিয়া সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কুতুবদিয়া কার্যালয়ের সাব রেজিস্ট্রার মো. নাহিদুজ্জামান ও চকরিয়া অফিসের মোহরার দুর্জয় কান্তি পালকে। তবে অভিযানকালে পালিয়ে যান সহকারী শ্যামল বড়ুয়া।
এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক ও এনফোর্সমেন্ট দলনেতা মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর দণ্ডবিধির ১৬১/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা তৎসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় দুদক কার্যালয়ে মামলা করার জন্য আবেদন দাখিল করেছেন। অপরদিকে একটানা অভিযান শেষে গ্রেপ্তারকৃত সাব রেজিস্ট্রার ও মোহরারকে চকরিয়া থানা পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়। এর পর তাদেরকে কঙবাজারস্থ বিশেষ জজ আদালতে সোপর্দ করার কথা থাকলেও বন্ধের দিন হওয়ায় গতকাল শুক্রবার তাদেরকে চকরিয়া উপজেলা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এ সময় আদালত তাদের জেলহাজতে প্রেরণ করেন।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক ও এনফোর্সমেন্ট দলনেতা মো. রিয়াজ উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজু করার জন্য দুদক প্রধান কার্যালয়ে আবেদন দাখিল করা হয়েছে। এর পর অনুমোদন সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে অচিরেই দুদক কার্যালয়ে মামলা রুজু হবে। তিনি আরো জানান, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে টাকা স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তরপূর্বক ভোগ-দখলে রাখার ও মানি লন্ডারিং আইনের ধারায় মামলার আবেদনটি অনুমোদনের আগে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের আদালতে সোপর্দ করা হবে। এই মামলার তদন্ত করে পরবর্তীতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে আদালতে।
যেভাবে অভিযান : গত ১৬ মার্চ দুদক ঢাকা কার্যালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতা চকরিয়া পৌরসভার পালাকাটা গ্রামের রশিদ আহমদের অভিযোগটি গোপনে তদন্তে নামে দুদকের একটি টিম। এর পর তারা বেশকিছুদিন ধরে সাদা পোশাকে সাব রেজিস্ট্রি অফিসে সেবাদানের বিপরীতে ঘুষের কারবারের প্রাথমিক সত্যতা পায়। এর পর পরিকল্পিতভাবে অভিযান চালানোর জন্য গত বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে সাদা পোশাকে দুদকের তিন সদস্য কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। ওইদিন সন্ধ্যার দিকে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম রেজিস্ট্রি অফিসের ভেতরে ঢুকে পুরো অফিসের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং কেউ যাতে বেরুতে না পারে সেজন্য তালা ঝুলিয়ে দেন। এ সময় সাব রেজিস্ট্রার, অফিস সহকারী, মোহরারসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর টেবিল, ড্রয়ার, আলমারি ও রেকর্ড রুমে দফায় দফায় তল্লাশি চালানো হয়। কার্যালয়ের ভেতর প্রথমদফা অভিযান শেষ করে সাব রেজিস্ট্রারকে সাথে নিয়ে তাঁর বাসায়ও অভিযান চালায় দুদক টিম। এ সময় দুদক টিমকে সহায়তা করার জন্য নিয়মানুযায়ী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তানভীর হোসেনও অভিযানে নেতৃত্ব দেন। অবশ্য সাব রেজিস্ট্রারের বাসায় তল্লাশি চালানো হলেও তেমন কিছু পায়নি দুদক টিম। বাসায় অভিযানের তেমন কিছু না পেলেও ফের কার্যালয়ে তল্লাশি অভিযান শুরু করে ঘুষের টাকার সন্ধানে। এ সময় একে একে তিন স্থান থেকে পাওয়া যায় ঘুষ বাবদ সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া ৬ লক্ষ ৪২ হাজার ১০০ টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাব রেজিস্ট্রারসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জব্দকৃত নগদ এই টাকার বৈধ কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
এদিকে সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে দুদকের শ্বাসরুদ্ধকর এই অভিযানের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে উৎসুক মানুষের ভিড় জমে যায়। সন্ধ্যা ৬টা থেকে একটানা রাত তিনটা পর্যন্ত এই অভিযান চলে দুদকের।
দুদকের জাল থেকে লাপাত্তা অফিস সহকারী শ্যামল বড়ুয়া : অভিযানের সময় দুদক টিম পুরো অফিসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাইরের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিলেও কৌশলে অফিস থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে সক্ষম হন অফিস সহকারী শ্যামল বড়ুয়া। এনিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে যায় অফিসের ভেতর। নিরুদ্দেশ হওয়া শ্যামলের সন্ধান পেতে পুলিশের সহায়তাও নেওয়া হয়। এমনকি বাইরে থেকে মই এনে কার্যালয়ের ছাদেও তল্লাশি চালায় দুদক টিম। কিন্তু সবাইকে ফাঁকি দিয়ে নিরুদ্দেশ হতে সক্ষম হন অফিস সহকারী শ্যামল।
অভিযানের সময় কার্যালয়ের ভেতরের সিসি ক্যামেরা বন্ধ ও কয়েকজন কর্মকর্তাকে মারধরের অভিযোগ : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আতঙ্কিত সাব রেজিস্ট্রি অফিসের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী দাবি করেছেন, অভিযানের শুরুতে দুদক টিমের ৭-৮ জন সদস্য কার্যালয়ের ভেতর থাকা সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন এবং কয়েকজন কর্মকর্তাকে লাঠি মারধর করেন। এতে অফিসের ভেতর আটকা পড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই অবস্থায় শ্যামল বড়ুয়া কৌশলে ছাদে উঠে পেছনের গাছ বেয়ে নিচে নেমে পালিয়ে যান। এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
অবশ্য অভিযানের শুরুতে সিসি ক্যামেরা বন্ধ এবং কয়েক কর্মকর্তাকে মারধর করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অভিযানে নেতৃত্বে দেওয়া দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক ও এনফোর্সমেন্ট দলনেতা মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘এই অভিযোগ কোনো অবস্থাতেই সত্য নয়। ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে ধৃত আসামিরা নিজেদের অপকর্ম ধামাচাপা দিতে এই অবান্তর অভিযোগ করছেন।
কার হেফাজত থেকে কী পরিমাণ টাকা উদ্ধার : এনফোর্সমেন্ট দলনেতা মো. রিয়াজ উদ্দিন জানান, অভিযানের সময় অফিস সহকারী শ্যামল বড়ুয়া ও মোহরার দুর্জয় কান্তি পালের টেবিলের ড্রয়ার থেকে পৃথকভাবে ২ লক্ষ ৮৯ হাজার ৫৫০ টাকা ও ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। এর পর সাব রেজিস্ট্রার মো. নাহিদুজ্জামানের ব্যবহৃত রেকর্ড রুমে অবস্থিত স্টিলের লকারের প্রথম ড্রয়ার তল্লাশি করে জব্দ করা হয় ১ লক্ষ ৯২ হাজার ৫৫০ টাকা। এছাড়া উক্ত তিনটি ড্রয়ার থেকে ঘুষ লেনদেনের হাতের লেখা ৪১টি স্লিপ উদ্ধারপূর্বক জব্দ করা হয়েছে। স্লিপগুলোতে সাব রেজিস্ট্রার মো. নাহিদুজ্জামানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ লেনদেনের তথ্য উল্লেখ আছে।
দুদক কর্মকর্তা জানান, জব্দকৃত টাকাগুলোর বিষয়ে বৈধ বা সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি সাব রেজিস্ট্রার মো. নাহিদুজ্জামান, অফিস সহকারী শ্যামল বড়ুয়া ও মোহরার দুর্জয় কান্তি পাল। এ কারণে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া গেছে জব্দকৃত এসব টাকা সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ঘুষ বাবদ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত-সমপ্রতি চকরিয়া পৌরসভার কাহারিয়া ঘোনা গ্রামের রশিদ আহমদ নামের এক ব্যক্তি দুদকে অভিযোগ করেন তার একটি দলিল রেজিস্ট্রেশন সম্পাদনের জন্য ঘুষ দাবি করা নিয়ে। দুদক কর্মকর্তারা ভুক্তভোগী সেই অভিযোগকারীকে নিয়ে এই অভিযান চালান।