চলতি বর্ষা মৌসুমে আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চিংড়িঘেরের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণের কারণে প্রতিনিয়ত এসব ঘেরে দেখা দিয়েছে মড়ক। এছাড়া পলিমাটি জমে ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়ায় চিংড়ি উৎপাদন একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে।
শুধু তাই নয়, এ অবস্থায় চিংড়ি চাষিরা বিনিয়োগকৃত অর্থ যেমন তুলতে পারছেন না, তার ওপর চাষিদের জন্য মহা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে চোর–ডাকাত ও দখলবাজদের ভয়। আবার চিংড়ি জোনে সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি প্রবাহের একমাত্র খালগুলোতে মাটির বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে বৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় চিংড়িজোনের মৎস্য ভান্ডার।
চিংড়ি চাষিরা বলছেন, চলতি চিংড়ি উৎপাদন মৌসুমে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। একদিকে প্রকৃতির বৈরী আচরণ অন্যদিকে চোর–ডাকাত ও দখলবাজদের ভয়ে এবারও চিংড়িঘেরগুলোতে চিংড়িসহ রকমারী মাছ উৎপাদনে ব্যাপকহারে ধস নেমেছে। এই অবস্থায় হাজারো চিংড়ি চাষি কম উৎপাদিত মাছ বিক্রি করে বিনিয়োগকৃত টাকাও তুলতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি উৎপাদন অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে।
চকরিয়ার বদরখালীর চিংড়ি চাষি মোহাম্মদ নুরুন্নবী আজাদীকে বলেন, এবার চিংড়ি উৎপাদনের মৌসুমে প্রকৃতি খুবই বৈরী আচরণ করেছে। বর্ষাকালে তেমন বৃষ্টিপাত তো হয়নি, তার ওপর মাত্রাতিরিক্ত ছিল তাপমাত্রা। এই অবস্থায় এবার বন্যাও হয়নি। ফলে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে কয়েকদফা মড়ক দেখা দেয় চিংড়ি ঘেরে। এছাড়া পলিমাটি জমে বেশিরভাগ চিংড়ি ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়ার কারণেও মাছ উৎপাদন আগের চেয়ে তুলনামূলক কমে গেছে।
চিংড়ি চাষি মো. মোজাম্মেল হক জানান, প্রকৃতির বৈরী আচরণ, ঘেরের পানির গভীরতা কমে যাওয়া, চোর–ডাকাত–দখলবাজদের ভয়ের পাশাপাশি প্যারাবন নিধন অব্যাহত থাকায় এবং চিংড়ি জোনের পানির প্রবাহের খালগুলোও জবর–দখলে নিয়ে সেখানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দুর্বৃত্তচক্র কর্তৃক মাটির বাঁধ দিয়ে রকমারী মাছ চাষ করা হচ্ছে। এসব কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে চিংড়িসহ মাছ চাষের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের সরবরাহকৃত তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনের রামপুর, বদরখালী, খুটাখালী, বহলতলী ও ডুলাহাজারা মৌজার ৬ হাজার ৮২৮টি ঘেরে ৮ হাজার ৪২০ টন, ২০২৩ সালে ৭ হাজার ৪৪৭টি ঘেরে ৯ হাজার ২১৬ টন, ২০২৪ সালে ৭ হাজার ৭৬৪টি ঘেরে ৯ হাজার ৫১৬ টন চিংড়ি এবং অন্যান্য প্রজাতির মাছ উৎপাদন হয়। কিন্ত চলতি মৌসুমে উল্লেখিত পরিমাণ ঘেরে মাছ চাষ করা হলেও প্রকৃতির বৈরী আচরণের কারণে মাছ উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় চিংড়ি চাষিরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চিংড়ি জোনে বর্তমানে ৯ হাজার ৫৮৯টি মৎস্য ঘের সরকারিভাবে নিবন্ধিত রয়েছে। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে অর্থাৎ ৯ হাজার ৫৮৯টি ঘেরে অতীতে বিপুল পরিমাণ মাছ উৎপাদন হলেও এবার ঘেরগুলোতে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন কমে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়ি জোনটি ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর বা ৫৬ হাজার একর জমি নিয়ে পরিবেষ্টিত। চকরিয়ার চিংড়িজোন এরিয়াটি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে চিংড়িসহ রকমারি মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে পরিচিত। কিন্তু চলতি বছর চিংড়িসহ মাছ উৎপাদনে ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছেন হাজারো মৎস্য চাষি।
চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ারুল আমিন আজাদীকে বলেন, চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোন দেশের মধ্যে একটি বিশাল মৎস্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। চলতি বছর প্রকৃতির বৈরী আচরণ, ঘের লাগোয়া প্রবহমান খাল বন্ধ করে কতিপয় মহলের অবৈধভাবে মাটির বাঁধ দেওয়া, বেশিরভাগ ঘেরে পানির গভীরতা কমে যাওয়া এবং পোনা সংকটের কারণেও উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে গেছে।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক চকরিয়া উপজেলার চিংড়িজোনের রামপুর মৌজায় ঘেরের চতুর্দিকে প্রায় ৭২ কিলোমিটারজুড়ে টেকসই বেড়িবাঁধ এবং সামুদ্রিক জোয়ার–ভাটার লবণাক্ত পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে ২৩টি আধুনিকমানের স্লুইসগেটও নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ঘেরের বাইরে বেড়িবাঁধে ইতোমধ্যে প্রায় ৩ লাখ বাইন ও কেওড়া গাছ লাগিয়ে প্যারাবন সৃজন করা হয়েছে। চলমান এসব উন্নয়ন কাজ অনেকটা সম্পন্ন হওয়ার পথে। এছাড়াও চিংড়ি ঘের এলাকার প্রবহমান খালের দুইপাশে প্যারাবন সৃষ্টির মাধ্যমে চিংড়ি চাষের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্যও মৎস্য অধিদপ্তর জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
উৎপাদন কমে লোকসানের মুখে চাষিরা : প্রতিবছর চিংড়িজোনের চরণদ্বীপ, রামপুর, বদরখালী, বহলতলী, খুটাখালী ও ডুলাহাজারা মৌজার অধীনে চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের চরণদ্বীপ, সাহারবিল ইউনিয়নের রামপুর, বদরখালী, ইলিশিয়া, দরবেশকাটা, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী ইউনিয়নের বহলতলী, বদরখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা ও কোনাখালী ইউনিয়নের অন্তত ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে চিংড়িসহ রকমারি মাছ চাষ হয়ে আসছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০০৫ সালে চকরিয়া উপজেলার চিংড়ি জোন এলাকায় ২২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৯ হাজার ৫০৬ টন চিংড়ি উৎপাদন হতো, সেখানে বর্তমানে তা ৪ হাজার টনে এসে দাঁড়িয়েছে।
উপজেলার রামপুর এলাকার চিংড়ি চাষি ও সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আজিজুল হাকিম বলেন, অতীতে প্রতি হেক্টর জমিতে ৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হতো, যা বর্তমানে ২০০ কেজির নিচে নেমে এসেছে। ফলে বেশির ভাগ ঘের মালিক পুঁজি হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়নের দরবেশকাটা এলাকার চিংড়ি চাষি মাওলনা শহিদুল ইসলাম বলেন, চিংড়ি ঘেরের ওপর দিয়ে প্রবহমান অন্তত ১১টি খাল রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে দখল করে মাটির বাঁধ দেওয়ায় পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদন করছে এসব প্রভাবশালী। এতে করে সামুদ্রিক জোয়ার–ভাটার পানি চলাচল বন্ধ হয়ে চিংড়ি ঘেরে প্রয়োজনীয় লবণাক্ত পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে চিংড়ি চাষ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তার ওপর প্যারাবন নিধন করে অনেক চিংড়ি ঘের সমপ্রসারণ করার কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চিংড়ি চাষি ও কক্সবাজার জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আবু তৈয়ব বলেন, চলতি বছর প্রায় এক হাজার একর জমিতে চিংড়ি চাষ করেছি। বিনিয়োগ করেছি কোটি টাকার বেশি। মৌসুমের শেষসময় পর্যন্ত ঘের থেকে চিংড়ি ও অন্যান্য প্রজাতির মাছ বিক্রি করে পেয়েছি বিনিয়োগের অর্ধেকের একটু বেশি। এই অবস্থায় বিপুল পরিমাণ টাকার লোকসান হয়েছে আমার।
মৎস্য চাষি আবু তৈয়ব বলেন, চলতি বছর অনাবৃষ্টির কারণে বেশিরভাগ ঘেরে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে কয়েকদফা ভাইরাসের সংক্রমণ হয় ঘেরে। আবার বৃষ্টি হলেও চলতি মৌসুমে বড় আকারে বন্যা হয়নি। ফলে অতিরিক্ত গরমের কারণে ঘেরের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণেও চিংড়িতে মড়ক দেখা দেয়। এতে করে মাছ উৎপাদনে ধস নেমেছে।
সাহারবিল ইউনিয়নের রামপুর এলাকার চিংড়ি চাষি নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ২০০ একর জমিতে চিংড়ি চাষ করে মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে মৌসুমের শেষপর্যন্ত ১০ লাখ টাকার মাছ পেয়েছেন মাত্র। এরমধ্যে চিংড়ি ২০০ কেজির বেশি হবে না। তিনি দাবি করেন, গত মৌসুমে লবণের ন্যায্যমূল্যও পাননি। চলতি মাছ মৌসুমে উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ করা পুঁজিও উঠবে না। অথচ অতীতে একই ঘেরের জমিতে চাষ করে অর্ধকোটি টাকা আয় করতেন।
চকরিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার আজাদীকে বলেন, দুর্গম ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বিশাল চিংড়ি জোনে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানো বেশ কষ্টসাধ্য। এই সুযোগে অপরাধীরা নানাবিধ অপকর্ম সংঘটিত করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এছাড়াও দখলবাজিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলেও সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।