নির্ঘুম রাত কাটছে কক্সবাজারের চকরিয়ায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আশপাশে গড়ে ওঠা অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষের। গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাতে তো আছেই, দিনের বেলাতেও উপদ্রব করছে ছোট–বড় প্রায় ২৫টি বন্য হাতি। এতে এসব গ্রামের হাজারো মানুষকে প্রতিনিয়ত ভয়–আতঙ্কে সময় পার করতে হচ্ছে। এতে হাতি ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
পরিবেশ সচেতন লোকজনের ভাষ্য, সংরক্ষিত বন উজাড় ও দখল, জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড় সাবাড়, বন্য হাতির অভয়ারণ্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত অবৈধ বসতি। এতে খাদ্যভাণ্ডার নষ্ট হওয়া ছাড়াও তাদের বিচরণের জায়গাটুকুও উজাড় করে ফেলায় বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ক্রমাগত চাপের কারণে আবাসস্থল হারিয়ে অনেকটাই ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে বন্য হাতি। এসব কারণে প্রায়ই লোকালয়ে দেখা মিলছে এই বুনো প্রাণীর। ক্ষুধার তাড়নায় দল বেধে হাতির পাল খাবারের সন্ধানে প্রতিনিয়ত লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। ভুক্তভোগী গ্রামের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সংরক্ষিত বন উজাড় ও আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে লোকালয়ে চলে আসায় বন্য হাতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়ছে মানুষের। এতে বন্য হাতির আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়া ছাড়াও মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়ন, কাকারা, ফাঁসিয়াখালী, হারবাং ও ডুলাহাজারা এলাকার লোকালয়েও প্রতিনিয়ত হাতির পাল বিচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। দিনের বেলায় পাহাড়ের ভেতর অবস্থান করলেও রাতের অন্ধকারে বন্য হাতির পাল চলে আসছে লোকালয়ে। তবে বেশি উপদ্রব বেড়ে গেছে সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়নে। এখানে রাতের বেলায় তো হানা দিচ্ছেই দিনের বেলাতেও এখানে ওখানে ঘুরে ফিরছে হাতির পাল।
উপজেলার সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম দৈনিক আজাদীকে বলেন, বন্য হাতির এই পালটির মানিকপুর সড়কের পাশে ফসলি জমিতেও দেখা মিলছে। এই হাতির পালে একাধিক শাবকসহ অন্তত ২৫টি হাতি রয়েছে। এসব হাতি লাইন ধরে সশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গ্রামে গ্রামে মানুষের নির্ঘুম রাত কাটছে। বন বিভাগ ও এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) এবং ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদারদের পাহারায় রাখা হচ্ছে যাতে বন্যহাতি মানুষ ও ঘরবাড়ির ক্ষতি করতে না পারে।
হাতি, মানুষ, সম্পদ রক্ষায় বনবিভাগের তৎপরতা : এদিকে–বনাঞ্চলে হাতির খাবার বাড়াতে এবং সংরক্ষিত বনের ভেতর হাতিগুলোর নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কঙবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ সূত্র জানায়, বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ক্রমাগত চাপ অব্যাহত রয়েছে বনজ সম্পদের ওপর। এতে সংরক্ষিত বন ও বন্য হাতির আবাসস্থল ছোট হয়ে যাচ্ছে এবং বনের ভেতর দেখা দিয়েছে হাতির খাদ্যাভাব। এই পরিস্থিতিতে হাতির পাল লোকালয়ে চলে আসায় মানুষের সঙ্গে এর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে।
বন বিভাগ জানায়, কঙবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জাধীন পাঁচটি বন বিটের মধ্যে কাকারা, মানিকপুর, ডুলাহাজারা ও ফাঁসিয়াখালী বন বিটের যেসব স্থানে হাতির আবাস রয়েছে সেখানে নিরাপদ খাদ্যভাণ্ডার তৈরি ও বিভিন্ন ফাঁদ থেকে বনের হাতিকে রক্ষা করতে বেশ তৎপর রয়েছে বন বিভাগ। বন কর্মকর্তা, বিটের কর্মচারী, সিপিজি ও ইআরটির সমন্বয়ে হাতি ও বনজ সম্পদ সুরক্ষায় নিয়মিত টহল কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এ সময় জব্দ করা হচ্ছে ফসল রক্ষা করতে তৈরি করা বৈদ্যুতিক ফাঁদের তার। সংরক্ষিত বনাঞ্চল সংলগ্ন লোকালয়গুলোতে হাতি সুরক্ষাসহ মানুষ ও হাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনে করা হচ্ছে মতবিনিময় ও সচেতনতামূলক সভা।
এ ব্যাপারে কঙবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মেহরাজ উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, সংরক্ষিত বন ও বন্য প্রাণী দেশের সম্পদ। বন্য হাতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বন্য হাতি লোকালয়ে চলে এলে বন কর্মী ও এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) দিয়ে হাতির পালটিকে বনের ভেতর ফেরানোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
রেঞ্জ কর্মকর্তা আরও জানান, এরই মধ্যে সিএমসির সহযোগিতায় বনের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের অধীন পাঁচটি বন বিটের যেসব স্থানে বন্য হাতির আবাসস্থল ছিল, সেখানে কলাগাছ ও ঘাসের চারা রোপণের মাধ্যমে হাতির খাদ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে। বন বিভাগের টহল দলের তৎপরতা অব্যাহতভাবে চলমান রয়েছে। অনেক স্থান থেকে হাতি মারার জন্য তৈরি করা ফাঁদ থেকে জব্দ করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক তার।