চকরিয়ায় পাহাড় সাবাড়ের প্রতিযোগিতা

থেমে নেই মাতামুহুরী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া | শনিবার , ১৪ জুন, ২০২৫ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের চকরিয়ার বিভিন্ন স্থানে বন উজাড়, পাহাড় সাবাড় ও মাতামুহুরী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের প্রতিযোগিতা চলছে যেন। সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনে দিনরাত সমানে অনেকটা বিনা বাধায় চলছে পাহাড় কাটা। বর্তমানে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সিন্ডিকেট করে পরিবেশবিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে কাড়ি কাড়ি টাকা পকেটস্থ করলেও পরিবেশ অধিদপ্তর, বনবিভাগ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই। এতে অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালী সিন্ডিকেটগুলো। সর্বশেষ পাহাড় সাবাড়ের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে গত বুধবার রাতে উপজেলার কাকারা ইউনিয়নের মাঝের ফাঁড়ি এলাকায় স্থানীয় পাহাড় ও বালু খেকো সিন্ডিকেটের সঙ্গে স্থানীয়দের বাদানুবাদের মাধ্যমে। এ সময় পাহাড় সাবাড় করে মাটি ও নদী থেকে অবৈধভাবে উত্তোলিত বালু ডাম্পার ভর্তি করে পাচারের সময় বাধা দিতে গেলে দলবদ্ধ আক্রমণের শিকার হন জুলাই যোদ্ধা মোহাম্মদ হাসান। এ নিয়ে পুরো চকরিয়ায় বর্তমানে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে পাহাড় সাবাড় ও বালু খেকো চক্ররা সংঘটিত হয়ে জুলাই যোদ্ধা হাসানসহ পরিবেশ রক্ষায় এলাকায় ভূমিকা পালনকারীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদগার করে আসছেন। পাল্টা হিসেবে পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন, চকরিয়া পৌরশহর চিরিঙ্গায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী চকরিয়ায় নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মাতামুহুরী নদী থেকে ড্রেজার ও শ্যালো মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। অন্তত শতাধিক পয়েন্টে বালু উত্তোলনের এই অবৈধ কারবার চলমান রয়েছে। অপরদিকে পাহাড়বেষ্টিত বিভিন্ন ইউনিয়ন যেমন সুরাজপুরমানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, বরইতলী, হারবাং, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা ও খুটাখালী ইউনিয়নে চলছে পাহাড় সাবাড় করে মাটি পাচারের রমরমা কারবার।

সরেজমিন সুরাজপুরমানিকপুর ইউনিয়নের সুরাজপুর তেতুলতলা এলাকায় গেলে দেখা যায়, কিছুদিন আগেও এখানে বিশাল বিশাল পাহাড়ের ওপর ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিল অসংখ্য গাছগাছালি। কিন্তু সেই গাছগাছালি উজাড়ের পর বর্তমানে চলছে পাহাড় সাবাড় করে মাটি পাচারের ঘটনা। ইতোমধ্যে বিশালায়তনের একাধিক পাহাড় স্কেভেটর দিয়ে কেটে সাবাড়ের ঘটনা ঘটেছে। আর বেশ কয়েকটি পাহাড় সাবাড় করে মাটি পাচারের জন্য বেশ তৎপর রয়েছে পরিবেশবিধ্বংসী সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটে রয়েছেনসানাউল্লাহ, শাহেদ, হুবাইব, সিরাজুল মোস্তফা, জমির উদ্দিনসহ আরও অনেকে। এরা সকলেই বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন হামলায় জুলাই যোদ্ধা মোহাম্মদ হাসানসহ স্থানীয় পরিবেশ সচেতন লোকজন। একইভাবে উপজেলার খুটাখালী, ডুলাহাজারা, ফাঁসিয়াখালী, বরইতলী, হারবাং, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের অসংখ্য স্থানে পাহাড় সাবাড় করে মাটি পাচার করছেন এলাকায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শক্তিশালী সিন্ডিকেটগুলো।

চকরিয়া পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক এম আর মাহমুদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পাহাড় ও বালু খেকোচক্রের তৎপরতা বেড়ে যায় দেদারছে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্তরাই পরিবেশবিধ্বংসী এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন বলে তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়। তাই পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনিক কঠোরতার পাশাপাশি স্ব স্ব রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে বরাবরের মতোই এসব পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড রোধ করা সম্ভব হবে না। ড্রেজার ও শ্যালো ৫ম পৃষ্ঠার ৭ম কলাম

মেশিন বসিয়ে মাতামুহুরী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চকরিয়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রূপায়ন দেব দৈনিক আজাদীকে বলেন, মাতামুহুরী নদী থেকে বৈধভাবে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। এই নদী বালু মহাল হিসেবেও জেলা প্রশাসনের ইজারা দেওয়ার তালিকায় নেই। কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে নদী থেকে যারা বালু উত্তোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে মাতামুহুরী নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় একাধিক স্থানে। যার ফলশ্রুতিতে আগে থেকে উত্তোলিত বালুর স্তূপ জব্দপূর্বক নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। তবে এখন থেকে সংশ্লিষ্ট আইনে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জেলজরিমানার বন্দোবস্ত করা হবে।

বন উজাড় ও পাহাড় সাবাড় করে মাটি পাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে কঙবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের কর্মকর্তা মো. মেহরাজ উদ্দিন বলেন, সুরাজপুরমানিকপুর ইউনিয়নে পাহাড় সাবাড় করার ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। যারা এই পাহাড় সাবাড়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তাদের আদ্যোপান্ত সংগ্রহ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বন রেঞ্জ কর্মকর্তা ফাঁসিয়াখালী আরও বলেন, আমার রেঞ্জাধীন পাঁচটি বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর পাহাড় সাবাড় করার মতো ঘটনার তথ্য আমার কাছে নেই। তবে ব্যাপকভাবে খোঁজ নিয়ে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লামা তৈয়্যব শাহ্‌ (রহ.) দ্বীনি সংস্কারকের অবদান রেখেছেন
পরবর্তী নিবন্ধহাসিনা-জয়সহ ২২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা