কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হওয়া ছাড়াও নিতে হয় ট্রেড লাইসেন্স। এর বাইরে নিতে হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও ফায়ার সার্ভিসের সনদপত্র। এর কোনোকিছু সম্পাদন না করে কক্সবাজারের চকরিয়ায় স্থাপন করা হয়েছে তিনটি অটো ব্রিকস কারখানা। কারখানাগুলো হল– চকরিয়া পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী তরছপাড়াস্থ মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রি, বাটাখালীর এলএইচবি অটোব্লক সেন্টার ও সাহারবিলের চৌঁয়ারফাঁড়িস্থ মা–বাবার দোয়া হলো ব্লক ফ্যাক্টরি।
অভিযোগ রয়েছে, তিন কারখানার কোনোটিরই সরকারি অনুমোদন না থাকলেও দিব্যি এক বছর ধরে চলছে কার্যক্রম। দুটি কারখানার শুধুমাত্র ফায়ার সনদ থাকলেও অন্যটির তাও নেই। কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়াতে নেই কোনো উদ্যোগও। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর নজরদারি এড়িয়ে চালানো হচ্ছে কারখানার কার্যক্রম। এতে কর্মরত থাকাবস্থায় সম্প্রতি একটি ব্রিকস কারখানায় মিক্সচার মেশিনে আটকে গিয়ে দুই কিশোর শ্রমিকের প্রাণহানিও ঘটেছে। এরপরও প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরের টনক নড়েনি।
সম্প্রতি চৌঁয়ারফাঁড়ির মা–বাবার দোয়া হলো ব্লক ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে এর অফিসকক্ষ পুড়ে যায়। এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পৌরসভার তরছপাড়াস্থ মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস কারখানায় ইট ব্লক তৈরির মিক্সচার মেশিন পরিষ্কার করার সময় বৈদ্যুতিক লাইন চালু হয়ে দুই কিশোর শ্রমিক শাহাদাত হোসেন শাহীন (১৬) ও কামরানুল ইসলাম জিহান (১৭) প্রাণ হারায়। পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ৩১ অক্টোবর পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি দল বাটাখালীস্থ এলএইচবি অটো ব্লক সেন্টার পরিদর্শন করে শব্দ দূষণের সত্যতা পান। দপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় কারখানাটি বন্ধের জন্য মালিকপক্ষকে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক জমির উদ্দিন একটি পত্র দেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর লাইন্সেস ছাড়াই মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রি, এলএইচবি অটো ব্লক সেন্টার ও মা–বাবার দোয়া হলো ব্লক ফ্যাক্টরি কারখানায় উৎপাদন চলমান রয়েছে। সরেজমিন আরও দেখা যায়, মাতামুহুরী নদীর তীরে চকরিয়া পৌরসভার তরছপাড়া মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রির অবস্থান। সেখানে চার ধরনের হলো ব্লক, লোগো ব্রিকস, সলিড ব্রিকস ও ইউনি পেভার ইট ও ব্লক তৈরি করা হয়। উৎপাদিত কয়েক লাখ ইট ও ব্লক কারখানার ভেতরে ও বাইরে মজুদ করে রাখা হয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর এই প্রতিষ্ঠানে দুইজন শিশু শ্রমিক নিহত হওয়ার পর থেকে কারখানাটি বন্ধ রয়েছে। তরছপাড়ার বাসিন্দা ছিদ্দিক আহমদ, মনসুর আলমসহ বেশ কয়েকজনের ভাষ্য– কারখানার শব্দ দূষণ ও ধূলোবালির কারণে এলাকায় বসবাস করা যাচ্ছে না। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে বার বার তাগাদা দেওয়া হয় এসব দূষণ থেকে তাদের রক্ষা করতে। এরইমধ্যে দুইজন শিশু শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে সেখানে নিহতও হয়েছে। এরপরও তাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রির ম্যানেজার জামাল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, কারখানায় প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র নেই। তবে মালিকের ব্যক্তিগত অফিসে রয়েছেন তার সঙ্গে দেখা করলে বিস্তারিত জানবেন। ইন্ডাস্ট্রির মালিক ইঞ্জিনিয়ার কফিল উদ্দিন বলেন, কারখানা খুলতে আমরা কোম্পানি খুলেছি। যে দুইজন শ্রমিক মারা গেছে, তারা আল্লাহর হুকুমে মারা গেছে। আমাদের কাছে সব ধরনের কাগজপত্র আছে। তবে তার কাছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের লাইন্সেস, পরিবেশ ছাড়পত্র ও ট্রেড লাইন্সেসের কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এ ব্যাপারে চকরিয়া পৌরসভার লাইন্সেস পরিদর্শক কামাল হোছাইন বলেন, মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস এন্ড সিরামিক্স ইন্ডাস্ট্রির নামে ট্রেড লাইন্সেসের জন্য আবেদন করেন প্রতিষ্ঠানটির একজন ব্যক্তি। কারখানা স্থাপনের জন্য যেসব কাগজপত্র ও শর্তাবলি রয়েছে তা না থাকাই ট্রেড লাইন্সেস দেওয়া হয়নি। যদি এসব শর্ত পূরণ করে লাইন্সেস প্রদান করা হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চকরিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়্যারহাউজ পরিদর্শক দিদারুল হক বলেন, মাস্টারমাইন্ড অটো ব্রিকস কয়েকদিন আগে ফায়ার সনদ নিয়েছেন। মূলত সেখানে পাথর, বালি ও সিমেন্ট দিয়ে ব্লক তৈরি হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস চকরিয়া স্টেশন কর্মকর্তা সেলিম উদ্দিন বলেন, মা–বাবার দোয়া হলো ব্লক ফ্যাক্টরির অফিসকক্ষে আগুন লাগলে তা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে প্রতিষ্ঠানটির অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকায় তেমন ক্ষতি হয়নি। ফ্যাক্টরিটিতে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত্র হয়েছিল।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, চকরিয়ার কোনো অটো ব্রিকসকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়নি। এলএইচবি অটো ব্লক সেন্টার পরিদর্শন করে শব্দ দূষণের সত্যতা পাওয়ায় বন্ধ করতে পত্র দেওয়া হয়েছে। একইভাবে অবৈধ বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোও পরিদর্শন করে পরবর্তী আইনগত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ–মহাপরিদর্শক শাহ মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, অটো ব্রিকস বা ব্লক তৈরির কারখানাগুলো অত্র দপ্তরের কোনো অনুমোদন নেয়নি। তাদের নামে কোনো লাইন্সেসও নেই। নিয়মানুযায়ী কোনো কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদের জানানোর নিয়ম থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলো তা করেনি। এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, উপজেলায় তিনটি অটো ব্রিকস কারখানা রয়েছে। অনুমোদন ছাড়া এসব কারখানায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে।