অবশেষে আরও শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় রূপ নিয়েছে বঙ্গোপসাগরে থাকা গভীর নিম্নচাপ। এজন্য সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃহস্পতিবার আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে (ক্রমিক নম্বর–৫) এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দক্ষিণ–পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি উত্তর ও উত্তর–পশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হয়ে একই এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় পরিণত হয়েছে। এটি বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে এক হাজার ২২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
এটি আরও ঘণীভূত হয়ে শুক্রবার ১২ মে সকাল পর্যন্ত উত্তর ও উত্তর–পশ্চিম দিকে এবং পরবর্তী সময়ে দিক পরিবর্তন করে ক্রমান্বয়ে উত্তর ও উত্তর–পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর বিক্ষুদ্ধ রয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ নানা দুর্যোগের আশংকা করছেন। আশংকা করছেন ভূমিকম্পেরও। খুব বেশি গরম পড়লে অনেকেই বলেন, ‘এবার ভূমিকম্প হবে’। তবে কখন, কোথায়, কত মাত্রায় সেটা হবে তা বলতে না পারলে এটা কেবল আন্দাজেরই মর্যাদা পাবে, পূর্বাভাসের নয়। আবার ভূমিকম্প নিয়ে সব পেশার মানুষের ধারণা যে এক রকম নয়, সেটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এখানে উল্লেখ করতে পারি, গত ৫ মে ঢাকায় এবং ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রামে ভূকম্পন অনুভূত হয়। ঢাকায় ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩ এবং চট্টগ্রামে ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রাকৃতিক যেসব দুর্যোগ সংঘটিত হয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা থাকলেও ভূমিকম্প সম্পর্কিত তিক্ত জ্ঞান নেই বললেই চলে। জাতিসংঘের মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে ঢাকা অন্যতম। এ ছাড়া বাংলাদেশ পৃথিবীর ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত বিধায় প্রাচীনকাল থেকে এই দেশে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। হিমালয় রেঞ্জ হচ্ছে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। বাংলাদেশের ভূমিকম্প বলতে আসলে বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকার ভূমিকম্পকে বোঝায়। কারণ বাংলাদেশ আসলে ভারত ও মিয়ানমারের ভূ–অভ্যন্তরের দুটি ভূচ্যুতির প্রভাবে আন্দোলিত হয়। কেননা বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিকচ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। যথা– বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানরের চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুণ্ড টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতি এলাকা, ডাউকি চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজিবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক–ডাউকি চ্যুতি) এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা। বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হবে তা অনুমান করা অসম্ভব।
আমরা জানি, ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস নেই। যার কারণে মানুষ সতর্কতামূলক কোনো পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে না। ভূমিকম্পে বাংলাদেশের অসংখ্য ঘরবাড়ি ধসে পড়তে পারে; রাস্তাঘাট, ব্রিজ ভেঙে পড়তে পারে; মানুষসহ অসংখ্য প্রাণী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আশঙ্কা। যদি কখনো বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় তা হলে সারাদেশ একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার করা এক যৌথ জরিপে জানা গিয়েছিল, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ। এই অঙ্ক ঠিক হলে সে রকম পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী আমরা ঠিক করেছি।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বারবার বলছে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভূমিকম্প অসহনশীল ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। ইস্তানবুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব প্রকৌশলী অধ্যাপক নাসি বলেছেন, ‘আমি বলেছিলাম, দয়া করে শহরগুলোকে ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুত করার ব্যবস্থা নিন। আমরা যেহেতু ভূমিকম্প থামাতে পারব না, তাই এর ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হবে।’ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্ষতি কমানোর একটাই পথ চ্যুতি বা ফল্ট ধরে ধরে গৃহনির্মাণ কৌশল ঠিক করা। গৃহনির্মাণযোগ্য এলাকা চিহ্নিত করা, গৃহকাঠামোর ন্যূনতম মান ভিত্তি বেঁধে দেওয়া আর সেটা অনুসরণে বাধ্য করা। অতএব আমরা যেহেতু ভূমিকম্পের পূর্বাভাস জানবো না এবং তাকে থামাতেও পারবো না, সেহেতু ক্ষয়ক্ষতি যাতে কমানো যায়, তার প্রস্তুতি আমাদের গ্রহণ করতে হবে। ভূমিকম্প যখনই হোক, এখনই আমাদের সতর্কতা জরুরি।