ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে শেষ হয়ে গেল চলতি মৌসুমের লবণ উৎপাদন। গত রোববারের এ ঝড়ে সৃষ্ট সামুদ্রিক উচ্চ জোয়ার ও বৃষ্টিপাতে তলিয়ে যায় জেলার লবণ মাঠ সমূহ। আর এর আগের দিন শনিবার (২৫ মে) পর্যন্ত দেশে লবণ উৎপাদন হয় ২৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন লবণ, যা ৬৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে জানায় বিসিক।
কক্সবাজারস্থ বিসিক লবণ কেন্দ্রের উপ মহাব্যবস্থাপক মো জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, চলতি মৌসুমে কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ, রামু ও বাঁশখালী উপজেলার ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর বাঁশখালীতে চলতি মৌসুমের প্রথম লবণ উৎপাদন শুরু হয় এবং এরপর ধীরে ধীরে কক্সবাজারের চাষিরাও লবণ উৎপাদনে নামে। এরপর ২৫ মে পর্যন্ত দেশে লবণ উৎপাদন হয় ২৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন লবণ, যা ৬৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড। তিনি জানান, গত মৌসুমে (২০২২–২৩ সাল) ৬২ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেশে লবণ উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ মেট্রিক টন। আর চলতি মৌসুমে ৬৩ বছরের রেকর্ড ভেঙে গত মৌসুমের চেয়ে ২ লাখের টনে বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছে। তবে চলতি মৌসুমে বিসিক দেশের লবণ চাহিদা ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন।
প্রতিবছর ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত প্রায় ৬ মাস সময়কালকে লবণ উৎপাদনের মৌসুম হিসাবে ধরা হয়। তবে বৃষ্টিপাতের উপর ভিত্তি করে মৌসুমের ব্যাপ্তি বাড়ে–কমে।
বাংলাদেশে লবণ উৎপাদনের ইতিহাস : লবণ উৎপাদন আদিকাল থেকে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের একটি দেশীয় শিল্পোদ্যোগ ছিল। মুলঙ্গী নামে পরিচিত চট্টগ্রামের এক শ্রেণির লোক অতীতকাল থেকে সমুদ্রের পানি সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত। তাদের লবণ উৎপাদন ক্ষেত্রকে ‘তোফল’ বলা হতো। মোঘল আমলে ‘নিমক জায়গীর মহাল ও নিমক এয়জ মহাল’ নামক দুটি সরকারি বিভাগ এই শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতো। নিজামপুর, জুলদিয়া ও বাহারছরা এই তিনটি চাকলার অধীনে মোট ৩৯টি লবণ সংগ্রহ ক্ষেত্র ছিল। ষোড়শ শতকে লবণ উৎপাদনকারীদের সরকারি খাতে মাশুল দিতে হতো। মোঘল আমল পর্যন্ত লবণ শিল্পে সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল জমিদার শ্রেণির হাতে। তারা লবণ চাষিদের দিয়ে লবণ তৈরি করার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাদন প্রদান করত। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে অনেক ইংরেজ প্রত্যক্ষভাবে ও বেনিয়াদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে লবণ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশদের উদ্যোগে ১৭৬৫ সালে বণিক সমিতি গঠিত হয় এবং এতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা লাভবান হয়। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস লবণ শিল্পের ওপর সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য প্রয়োগ করে লবণ আবাদের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতাকে লবণ উৎপাদনের জমি পাঁচ বছরের জন্য লিজ দিতে শুরু করেন। ১৭৭৭ সালে এ পদ্ধতি বাতিল হয়ে বার্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হতে থাকে। নতুন পদ্ধতি ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কোম্পানি এরপর এজেন্সির মাধ্যমে সরাসরি লবণ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় জড়িত হয় এবং যৌথ নিলামের আয়োজন করে বাজারজাতকরণেও সম্পৃক্ত হয়। ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানির আধিপত্য চলতে থাকে। কোম্পানি কর্তৃক আরোপিত কর প্রশাসন, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি এবং ভারতে লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশীয় লবণ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির শাসনের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে ৭৯–৯৯ হাজার মণ লবণ উৎপাদিত হতো। তখন কোম্পানির কর্মচারীরা চট্টগ্রামে উৎপাদিত লবণের ব্যবসা করত। পরবর্তীকালে লিভারপুর থেকে লবণ আমদানির কারণে প্রকৃতিজাত এই শিল্পটি ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার সামুদ্রিক লবণ উৎপাদন করা বেআইনি ও দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে এবং স্বদেশি লবণের উপর অতিমাত্রায় কর আরোপ করায় এই শিল্প বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রামের বহু মুলঙ্গী জীবিকার তাগিদে লুকিয়ে লবণ চাষ করতে গিয়ে ধরা পড়ে শাস্তিও ভোগ করত। এভাবে নির্যাতন চালিয়ে চট্টগ্রামের প্রাচীন লবণ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে মহাত্মা গান্ধীর লবণ আন্দোলনের প্রভাবে লবণ উৎপাদন আবার শুরু হলেও নতুন লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশদের প্রবল বিরোধিতা ছিল। ১৯৪৭–এর পর থেকে এই লবণ শিল্পটি পুনরুজ্জীবিত হয়।
১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (ইপসিক) প্রতিষ্ঠিত হয়, যেটি বর্তমানে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নামে পরিচিত। ইপসিক বা বিসিক ১৯৬০–৬১ অর্থবছর থেকে লবণ শিল্পসংক্রান্ত কার্যক্রম আরম্ভ করে। ১৯৬৪ সালে লবণ উৎপাদনকারী ইউনিটসমূহের একটি শুমারি অনুষ্ঠিত হয়। শুমারিতে সর্বমোট ১৬,৫৪১টি লবণ উৎপাদনকারীর ইউনিট, লবণ উৎপাদনের আওতায় মোট ১১,৭৬৯ একর জমি এবং এই শিল্পে মোট ৫০,৮৫৪ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান নথিভুক্ত করে। সেসময় লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন।