পলাশীর যুদ্ধ মানে আমার কাছে সাহসী দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজ উদ দৌলার অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে মীর জাফর, জগৎ শেঠ, রাজবল্লভদের মতো আস্থাভাজনদের বিশ্বাসঘাতকতা। তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতনের মধ্যে দিয়ে প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলাসহ গোটা ভারতবর্ষ ইংরেজদের পরাধীনতার নিষ্পেষণে নিষ্পেষিত হতে থাকে। পলাশীর যুদ্ধ বললে, বাংলা সিনেমা সিরাজ উদ দৌলার দৃশ্য চোখের সামনে ভাসে। ছোটবেলায় এই ছবি যতবার দেখেছি ততবার নবাব সিরাজের অসহায় অবস্থার জন্য মন আর্দ্র হয়েছে। কিন্তু এই পলাশীর প্রান্তরে যে বিশ্বাসঘাতকতার নগ্নরূপ ভেসে উঠেছে তা তো একদিনে হয়নি। বিন্দু বিন্দু করেই যেমন মহৎ কর্ম হয়, ঠিক তেমনি ভয়ংকর খারাপ পরিণতির পেছনেও অনেক বড় ইতিহাস লুকানো থাকে। সেই ইতিহাসটুকু সব সময় আমাদের জানা হয় না। আর ইতিহাসের ভারিক্কি বই পড়ে সেই ইতিহাসের মূলে সকলে যেতেও চায় না। কিন্তু ইতিহাস যখন সাহিত্য মেজাজে ধরা দেয় তখন বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। সেরকমই একটি উপভোগ্য উপন্যাস হলো জয়দীপ দে রচিত ‘কাসিদ’। পাতায়-পাতায় ইতিহাসের চরিত্ররা জীবন্ত হয়ে হাঁটছে। কাসিদ পাঠে আমরাও চলে যাই সেই পারস্যের নাদির শাহ থেকে শুরু করে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের পরাজয়ের দিনগুলোতে। পলাশীর ইতিহাসের সেই চেনা রূপটার আড়ালের আরও অনেক লুকানো ইতিহাস লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তার ৩০৩ পৃষ্ঠার উপন্যাসে। বইটি পড়ছি আর ইতিহাসের চেনা নামগুলোর পাশাপাশি অচেনা অজানা অনেক নাম, চরিত্র, স্থান,কালের টুকরো টুকরো অংশসহ পলাশীর যুদ্ধের সেই সময়টার সাথে দারুণ সংযুক্ত হচ্ছিলাম।
বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলী খানের জামাতা সুজা মির্জা মোহাম্মদ আলীকে সামান্য সৈনিক থেকে রাজমহলের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। তার কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে উপাধি দেন আলীবর্দী । সেই আলীবর্দী পরবর্তীতে গিরিয়ার যুদ্ধে সুজার পুত্র সরফরাজের সাথে বেঈমানি করে বাংলার নবাব পদ লাভ করেন। নবাব সুজার আমলে মূলত দেশ চালাত তিন মন্ত্রী- দেওয়ান আলম চাঁদ, জগত শেঠ ফতেচাঁদ আর হাজি আহম্মদ। সরফরাজ নবাব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে এই তিন মন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। এই তিন মন্ত্রীই সরফরাজের ছাঁটাই করা সৈন্যদের পাটনায় পাঠিয়ে আলীবর্দীর সৈন্য বাহিনী গঠন করে এবং আলীবর্দীকে দিয়ে সরফরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করায় এবং সেই যুদ্ধে তারা তাদের নবাবের সাথে করে গোলন্দাজদের কামানে গোলা না ভরে মাটি ভরে ফায়ার করেছিল। ঘুষ দিয়ে সৈন্যদের যুদ্ধের ময়দানে নিস্পৃহ থাকতে বলে। আর এতে করে সরফরাজকে খুব সহজেই পরাজিত করে বাংলার ক্ষমতা দখল করে আলীবর্দী। নিয়তির নির্মমতা হলো এ ঘটনার ঠিক ১৭ বছর পরে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে আসা ইংরেজ বাহিনীর সাথে পলাশীর যুদ্ধে আলীবর্দীর নাতি নবাব সিরাজের সাথে তার সহযোগীদের এবং সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজের পতনের পাশাপাশি প্রাণনাশ হয় নির্মমভাবে।
এতদিন জগৎশেঠ বলতে আমি জানতাম জগৎশেঠ একজন ব্যক্তি বিশেষ। কিন্তু ‘কাসিদ’ পড়ে জানলাম ‘জগটৎশেঠ’ হলো উপাধি। লেখকের ভাষায়, ‘১৭২২ সালে দিল্লিতে যখন তারল্যের সংকট (অর্থের অভাব) দেখা দেয়, তখন জগৎশেঠ ফতেচাঁদ গদি থেকে হুন্ডি ছেড়ে সেই সংকট মোকাবেলা করেছিলেন। বাদশাহ মুহাম্মদ শাহ এতে যারপরনাই খুশি হয়ে জগৎশেঠ উপাধিটি দেন। এর অর্থ সারা বিশ্বের ব্যবসায়ী। এখন এটা তাদের পারিবারিক উপাধিতে পরিণত হয়েছে।’
এরকম অনেক মজার মজার কিন্তু ইতিহাস সংবলিত তথ্যে ভরপুর কাসিদ। লেখক বেশ বড় পরিসরে পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাসকে আমাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো দা গামার আগমন থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজা রাণীদের ভারতবর্ষের প্রতি আগ্রহের কারণগুলো বেশ বিশ্বস্ততার সহিত ব্যাখ্যা করেছেন লেখক।
ভারতের প্রধান বহিঃবাণিজ্য কেন্দ্র ছিল গুজরাটের সুরাট আর মালাবারের কালিকট। ইংরেজ বণিকরা ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতে এসে প্রথম ওঠে গুজরাটের সুরাটে। কিন্তু সেখানে তারা তেমন সুবিধা করতে না পারায় পরবর্তীতে তারা বাংলার দিকে নজর দেয়। কিন্তু তারা চাইলেই তো আর বাণিজ্য করতে পারবে না। দিল্লীর বাদশাহর অনুমতি লাগবে। ইংরেজদের ভাগ্য সহায়ক ছিল বলা যায়। সুরাট বন্দরে ইংরেজদের জাহাজে ছিল গ্যাব্রিয়েল বৌটন নামে একজন ডাক্তার। বলা যায় সেই ডাক্তারই গোটা ভারতবর্ষে ইংরেজদের ব্যবসার ভাগ্য ঘুরিয়ে দেয়। সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারার চিকিৎসা করে জাহানারাকে সুস্থ করে তুলে সম্রাট শাহজাহানের মন জয় করে নেন ডাক্তার বৌটন। বাদশাহ খুশি হয়ে বৌটনকে বলে সে যা চায় তা দিবে। ডাক্তার বৌটন নিজের একার জন্য কিছুই চাইলেন না। চাইলেন ইংরেজদের বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি। বাদশাহ রাজি হলেন। মাত্র তিন হাজার টাকা খাজনার বিনিময়ে ইংরেজরা বিনা শুল্কে বাংলায় ব্যবসা করার অনুমতি পায়। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে বাংলায় শুরু হয় ইংরেজদের আধিপত্য। কপাল ভালো হলে যা হয় আর কি!
বেচারা নবাব সিরাজ শুরু থেকেই অন্যদের চক্ষুশূল। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, নারী আসক্তি, শারাব, অল্প বয়স, রগচটা মেজাজ এসব মিলিয়ে প্রথম থেকেই সিরাজের প্রতি রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের অনীহা থাকা সত্ত্বেও আলীবর্দি তার প্রিয় নাতির হাতেই বাংলার শাসনভার তুলে দিলেন। মসনদে বসে নতুনভাবে তার পর্ষদ সাজাতে গিয়ে মীর জাফর, জগতশেঠ মহাতপ রায়, রাজবল্লভসহ অন্যান্যরা নবাবের বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায়। ক্ষমতায় বসেই একের পর এক তাকে ইংরেজ আক্রমণে ব্যস্ত থাকতে হয়। একের পর এক যুদ্ধ বিগ্রহ , সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা, কে কখন কোন দিক দিয়ে কতল করে দেয়, সিংহাসন করে নেয়, বর্গী আক্রমণ, নিজের ঘরের শত্রুদের ষড়যন্ত্র, সব মিলিয়ে বেসামাল অবস্থা।
ইতিহাসের অসংখ্য চরিত্রের আনাগোনা পুরো কাসিদ জুড়ে। পারস্যের নাদির শাহ থেকে শুরু করে দিল্লির বাদশাহ মুহাম্মদ শাহ , সুজাউদ্দীন, আওরঙ্গজেব, মোর্শেদ কুলী, হোসেন কুলী, বাংলার সুবাদার মীর জুমলা, শায়েস্তা খাঁ, বাহাদুর খাঁ, ইব্রাহিম খাঁ, জগৎশেঠ মানিক চাঁদ, ফতেচাঁদ, রাজবল্লব, রায়বল্লভ, সুজাউদ্দীনের জামাতা নবাব সরফরাজ, গাউস খাঁ, আলীবর্দী খাঁ , মীর জাফর, মোহনলাল, মীর মদন এবং ট্র্যাজিক হিরো নবাব সিরাজ উদ দৌলাসহ কত কত চরিত্র। সামান্য অন্যমনস্কতায় খেই হারিয়ে ফেলার অবস্থা। পর্তুগীজ, ডাচ, ইংরেজদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চরিত্র ক্লাইভ,ওয়াটস, স্ক্রাফটন, এডমিরাল ওয়াটসন, কিলপ্যাট্রিক, ফরাসী জেনারেল বুসিসহ আরও অনেক অনেক চরিত্রের উপস্থিতি এবং তাদের কর্মকান্ড সব মিলিয়ে ভালোই আয়োজন।
ইতিহাস খুবই মজার বিষয়। যখন তা গল্প আকারে পড়ি। কিন্তু পাঠ্য আকারে ইতিহাস মানেই যেন খালি সন তারিখ মুখস্থ রাখা। কোন রাজা মরেছে, কোন শাসক ক্ষমতা দখল করেছে, কে কার স্ত্রী ,কন্যাকে অপহরণ করেছে এসব কি আর চাইলেই মনে থাকে। শেরশাহ’র মূল নাম জিজ্ঞেস করলে, কিংবা পানি পথের যুদ্ধের সাল জানতে চাইলেই ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই বেসামাল হয়ে যায়। কিন্তু নাটক, গল্প, উপন্যাসের চরিত্রগুলো কিন্তু মানুষ সহজে মনে রাখে। এই উপন্যাসটাও পলাশীর যুদ্ধের ইতিহাসকে মনে রাখার মতো করেই উপস্থাপন করা হয়েছে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতন তো হলো, পরবর্তীতে নির্মমভাবে মোহাম্মদী বেগ তাকে হত্যাও করে, কিন্তু ইতিহাসের ঘৃণ্য, ষড়যন্ত্রকার মীর জাফরদের পরিণতিটা কি হলো? কাসিদ থেকেই তুলে দিচ্ছি, “পলাশীর যুদ্ধের আট বছরের মাথায় মীর জাফর মারা গেলেন কুষ্ঠ রোগে। কুষ্ঠ যেহেতু ছোঁয়াছুঁয়ি রোগ, তাই তার শেষ কয়টা দিন কাটলো অস্পৃশ্যের মতো। তাঁর কর্মঠ পুত্র মীরন মরলো বজ্রঘাতে। রায় দুর্লভ এক সময় মীর জাফরের শত্রু হয়ে ওঠে। …ওয়াটস দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হন। বিচারের হাত থেকে বাঁচতে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। সেখানে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে থাকেন। একসময় মৃত্যুবরণ করেন। স্ক্রাফটন মারা যায় জাহাজ ডুবিতে। ক্লাইভ নিজের গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন বাংলায় জল হাওয়ায় দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রাণ বাঁচাতে ইংল্যান্ড চলে যান। সেখানে মাত্র দু’মাস বেঁচে ছিলেন।’
ঔপন্যাসিক জয়দীপ দে’র কাসিদ উপন্যাস পাঠে ইতিহাসের দীর্ঘ একটা পাড়ি দিলাম। ইতিহাসের অনেক তথ্য উপাত্তকে সাহিত্যিক উপাদানে সমৃদ্ধ করেছেন লেখক। তবে কখনো কখনো তথ্য উপাত্তের ভারে কিছুটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তাড়াহুড়ো করে কাসিদ পড়ার সুযোগ নেই। ধীরে সুস্থে, কিছুটা সময় নিয়ে কাসিদ পাঠে বেশ সুখকর একটি ভ্রমণ হয়ে যায়। এত এত তথ্য, এত এত ব্যক্তি, স্থান,কাল এসব এক সূত্রে গাঁথা চারটিখানি কাজ নয়। বোঝাই যায় লেখকের বেশ পরিশ্রমলব্ধ কাজ ‘কাসিদ’। বইয়ের শেষে তথ্যসূত্রটা সংযোজন করায় সুবিধা হয়েছে পাঠকের।
লেখকের ঝরঝরে গদ্য ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাসকেও টানটান ভাবেই আকৃষ্ট করেছে সহজে। উপন্যাসে ব্যবহৃত পুঁথি, শ্লোকগুলোও বেশ মজার। ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি। জুনিয়র লুমিংটন আর সিনিয়র লুমিংটনের কথোপকথনের মধ্যে একটা চরম সত্যি কথা উঠে এসেছে যা এত দীর্ঘ সময় পেরিয়েও এখনো বাংলার মানুষদের জন্য প্রযোজ্য।
“সামান্য হাতাহাতি করে ৫০হাজার সৈন্য ৩ হাজার সৈন্যের কাছে হার মেনে গেলে! মানুষের তো আত্মসম্মানও থাকে।
-এখানে এভাবেই যুদ্ধ হয় ব্রাদার। এরা তো যোদ্ধা জাতি নয়, তাই এদের যুদ্ধের হাতিয়ার অস্ত্র নয়, ষড়যন্ত্র।”
ঔপন্যাসিক জয়দীপ দে’র জন্য শুভকামনা। আগামীতে তিনি আমাদের ইতিহাস নির্ভর আরও অনেক চমৎকার উপন্যাস উপহার দিবেন সেই প্রত্যাশা করি। বইটি প্রকাশ করেছে দেশ পাবলিকেশন্স, প্রচ্ছদ করেছেন তৌফিকুর রহমান।