করোনা মহামারীতে ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়া চট্টগ্রামের বেসামরিক বিমান চলাচল খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। মাস কয়েক পুরোপুরি বন্ধ থাকা চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চালু হলেও যাত্রী সংখ্যা কম থাকায় প্রাণচাঞ্চল্য এখনো ফিরেনি। যাত্রী ও ফ্লাইটের সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কমে যাওয়ায় অনেকটা ঢিমেতালে চলছে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ খাতটি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে উল্লেখ করে যাত্রী সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছে। তারা বলছে, বিশেষ অভ্যন্তরীণ রুটের প্রতিটি ফ্লাইট পূর্ণ যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ায় বিমানই বর্তমানে সবচেয়ে নিরাপদ বাহন বলে দাবি তাদের।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। প্রতিদিন কয়েক হাজার যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে চলাচল করেন। কিন্তু করোনা সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। যেই বিমানবন্দরে একসময় হাজার হাজার যাত্রী ও তাদের স্বজনদের ভিড় সামলাতে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হত, এখন সেখানে সুনসান নিরবতা। চট্টগ্রামের সার্বিক জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হলেও বিমান চলাচল এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
গতকাল সরজমিনে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে কর্তব্যরত লোকজন থাকলেও যাত্রী সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম। পার্কিং এলাকাতেও স্বাভাবিক ভিড় নেই। গেট ও ভেতরের বিভিন্ন পয়েন্টে কর্মকর্তা কর্মচারীরা ডিউটি করলেও ব্যস্ততা নেই তাদের। বিমানবন্দরে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি কড়াকড়ি করা হয়েছে। যাত্রীদের মাস্ক দেয়া, পা স্যানিটাইজ করাসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে কিছু যাত্রী থাকলেও আন্তর্জাতিক রুটে গতকাল তেমন কোনো যাত্রী চোখে পড়েনি। যাত্রী ও ফ্লাইট সংখ্যা কম থাকায় বিমানবন্দরের স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্যও ছিল না।
বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার সারওয়ার ই জামান দৈনিক আজাদীকে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। যাত্রী ও ফ্লাইটের সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়ছে। খাতটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। যাত্রীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কঠোর মনিটরিং এবং হেলথ ডেস্ক স্থাপনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিমানবন্দরে সবকিছুই স্যানিটাইজ করা। কোভিড সংক্রমণ রোধে আমরা খুবই সচেতন। আমাদের নেয়া বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে করোনা সংক্রমণের কোনো ঝুঁকি নেই। এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে যাত্রীরা যাতে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন সেদিকে আমরা সর্বোচ্চ নজর দিচ্ছি। বর্তমানে বিমানযাত্রাই সবচেয়ে নিরাপদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বহু মানুষ এখন বিমানে চলাচল করছেন। যাত্রীও বাড়ছে। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট কম তবে প্রচুর যাত্রী চলাচল করছেন। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী যে কোনো ফ্লাইটের সামনের দুটি রো খালি রাখতে হচ্ছে। এতে আমাদের ৬৮ সিটের এয়ারক্রাফটের চারটি সিট খালি থাকছে। বাকি ৬৪ সিটেই যাত্রী যাতায়ত করছেন। আন্তর্জাতিক রুটেও ফ্লাইট কম। তবে যেসব ফ্লাইট চলাচল করছে সেগুলোতে যাত্রী সংখ্যা কম নয়।
অপর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, করোনায় বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে বিমান চলাচলে। ট্যুরিজম খাতটি পুরোপুরি বন্ধ। কেউ কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন না। যাওয়ার অবস্থাও নেই। একেবারে বাধ্য না হলে কেউ বিদেশ যাচ্ছেন না। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রী কম বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে করোনার আগে প্রতিদিন ১১টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট আসা যাওয়া করতো। বিমানবন্দরে সেটিকে ২২টি ফ্লাইট হিসেব করা হতো। এই ২২টি ফ্লাইটে গড়ে ২৭১০ জন যাত্রী বিদেশে যাতায়াত করতেন। একইভাবে করোনার আগে প্রতিদিন ১৭টি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট অপারেট হতো। একটি এয়ারক্রাফটের আসা-যাওয়া দুইটি ফ্লাইট হিসেব করা হয়। এতে করে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে চলাচলকারী ৩৪ ফ্লাইটে গড়ে ২ হাজার ৪৮৭ জন যাত্রী চট্টগ্রামে আসা যাওয়া করতেন। করোনার আগে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৫৪টি ফ্লাইটে ১৮ হাজার ৯৭০ জন যাত্রী বিদেশ থেকে আসা যাওয়া করতেন। দেশে ২৩৮টি ফ্লাইটে চলাচল করতেন ১৭ হাজার ৪০৯ জন যাত্রী।
করোনার কারণে ২৬ মার্চ থেকে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর দীর্ঘদিন দেশে কোন ফ্লাইট চলাচল করেনি। সম্প্রতি দেশি বিদেশি ফ্লাইট চালু করা হলেও সব দেশের সাথে এখনো বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হয়নি। দেশিয় সব ফ্লাইটও অপারেশন শুরু করেনি।
বর্তমানে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রতিদিন গড়ে দুটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল করছে। অর্থাৎ একটি এয়ারক্রাফটই যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রামে আসছে এবং ওই এয়ারক্রাফটই যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করছে। দুটি ফ্লাইটে গড়ে ১৯৫ জন যাত্রী যাতায়াত করছেন। করোনার আগে যেই সংখ্যা ছিল ২৭১০ জন। একইভাবে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ রুটে প্রতিদিন ২২টি ফ্লাইট অপারেট হচ্ছে। এতে গড়ে ১১৫১ জন যাত্রী যাতায়াত করছেন। করোনার আগে যেই সংখ্যা ছিল ২৪৮৭ জন। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে আন্তর্জাতিক রুটে ১৬টি ফ্লাইট অপারেট হচ্ছে। এতে ২৬৭১ জন যাত্রী বিদেশে যাতায়াত করছেন। অভ্যন্তরীণ রুটে প্রতি সপ্তাহে ১৫২টি ফ্লাইটে ৮ হাজার ৫৭ জন যাত্রী যাতায়াত করছেন। করোনার আগের তুলনায় বর্তমানে যাত্রী সংখ্যা বহুগুণ কম বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন।
সূত্র বলেছে, বর্তমানে অভ্যন্তরীণ রুটে শুধু মাত্র বাংলাদেশ বিমান, নভো এয়ার এবং ইউএস বাংলা সীমিত সংখ্যক ফ্লাইটে যাত্রী পরিবহন করছে। রিজেন্ট এয়ার এখনো চালু হয়নি। কবে নাগাদ চালু হবে তাও কেউ বলতে পারেননি। অপরদিকে আন্তর্জাতিক রুটে শুধুমাত্র শারজাহ, দুবাই এবং আবুধাবীতে ফ্লাইট চলাচল করছে। শারজাহ শুধুমাত্র ফ্লাই দুবাই, বিমান দুবাই এবং আবুধাবীতে যাত্রী পরিবহন করছে। বিশ্বের অন্য কোনো গন্তব্যে চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইট চলাচল করছে না।
যাত্রী এবং ফ্লাইটের সংখ্যা কবে স্বাভাবিক হবে সেটি বলার কোনো সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি যতই স্বাভাবিক হোক না কেন, মানুষ যদি বেড়াতে বা কাজে না যান তাহলে ফ্লাইটের যাত্রী বাড়বে না। যাত্রী না বাড়লে ফ্লাইট সংখ্যাও বাড়বে না। বন্ধ হয়ে থাকা গন্তব্যগুলোতে ফ্লাইট চলাচল শুরু হলে যাত্রী এবং ফ্লাইট সংখ্যা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার সারওয়ার ই জামান বলেছেন, কয়েক মাস বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় পুরো খাতটিই বিপর্যস্ত। তবে সেই বিপর্যয় কেটে যেতে শুরু করেছে। আমাদের ফ্লাইট চলাচল বাড়ছে। যাত্রী সংখ্যাও বাড়ছে। দেশি বিদেশি ফ্লাইট অপারেটরগুলো ক্রমান্বয়ে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াবে। খাতটি ঘুরে দাঁড়ানোর এই প্রক্রিয়াটি বেশ আশাব্যঞ্জক বলে তিনি মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ট্যুর অপারেটর বি-ফ্রেশ এর একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, একেবারে বন্ধ হয়ে থাকার অবস্থা থেকে খাতটি ফিরতে শুরু করেছে। যাত্রী সংখ্যা বাড়ছে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ টিকেট বিক্রি হচ্ছে। বিদেশে কাজ-কর্মে যাতায়াতের পাশাপাশি ব্যবসা বাণিজ্য ও ট্যুরিজম খাত চালু হলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।