ঘুমন্ত সালাহউদ্দিনকে গলা কেটে হত্যা করে দুই রুমমেট

মজুরি থেকে কমিশন কেটে রাখায় ক্ষোভ

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৫ মার্চ, ২০২৩ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

কাজের মজুরি থেকে কমিশন কেটে রাখার অভিযোগে দুই বন্ধু খুন করেছে তাদের আরেক বন্ধু সালাহউদ্দিনকে। নগরীর টাইগারপাস আমবাগান এলাকায় তালাবদ্ধ ঘর থেকে মুখ ও হাত পা বাঁধা অবস্থায় অর্ধগলিত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধারের ঘটনার তদন্তে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব

 

ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সূত্রবিহীন এই ঘটনার আংশিক রহস্য উদঘাটনের দাবি করে পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কাজের মজুরি থেকে কমিশন কেটে রাখা এবং গোসলে পানি বেশি ব্যবহার নিয়ে বিরোধের জেরে একই ঘরে বসবাসরত দু’জন মিলে সালাহউদ্দিনকে

নৃশংসভাবে খুন করে। গত শুক্রবার বিকেলে ঢাকার ধানমন্ডি থেকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আব্দুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা। গ্রেপ্তার আব্দুর রহমানের (৩২) বাড়ি সন্দ্বীপ উপজেলার হরিষপুর ইউনিয়নে। নগরীর আমবাগান এলাকায় দুলাল সওদাগরের দোকানে তিনি কাজ করতেন।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে নগরীর খুলশী থানার টাইগারপাস এলাকায় রেলওয়ে কলোনির পরিত্যক্ত ১১ নম্বর ভবনের সামনে ছেনোয়ারা বেগমের টিনশেড ঘর থেকে ৪৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তবে সেসময় পুলিশ নিহতের কোনো পরিচয় পায়নি। ছেনোয়ারা বেগম শুধুমাত্র তার

নাম ‘সালাহউদ্দিন’ এবং পেশায় টাইলস শ্রমিক বলে জানিয়েছিলেন। এ ঘটনায় খুলশী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছিলেন।

পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত একজনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। ঘটনাটা একেবারে ক্লুলেস ছিল। আমরা এর আংশিক রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। আরও একজন এ ঘটনায় জড়িত বলে আমরা জানতে পেরেছি। তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে রহস্য পুরোপুরি উদঘাটন হবে।

পিবিআই মেট্রোর পরিদর্শক ইলিয়াস খান আজাদীকে জানান, ঘটনাস্থলে গিয়ে পিবিআই টিম নিহতের আঙ্গুলের ছাপ নিয়েছিল। সেই ছাপ ব্যবহার করে প্রযুক্তির সহায়তায় বিস্তারিত পরিচয় মেলে। নিহতের নাম মো. সালাহউদ্দিন শেখ, বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায়। বাড়িতে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকে। পেশায়

বিদ্যুৎ মিস্ত্রি সালাহউদ্দিন দেশের বিভিন্নস্থানে ঘুরে ঘুরে মেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিদ্যুতের কাজ করতেন। এছাড়া মেলায় স্টল তৈরি, আসবাবপত্র আনানেওয়াসহ দিনমজুর হিসেবে ঠিকাদারের অধীনেও কাজ করতেন। সিলেটে একটি মেলায় কাজ করতে গিয়ে সালাহউদ্দিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় স্বপন নামে আরেক শ্রমিকের।

নগরীর আবাহনী মাঠে একটি মেলা এবং পলোগ্রাউন্ডে বাণিজ্য মেলার কাজ পাওয়ার পর মাসখানেক আগে স্বপনকে নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন সালাহউদ্দিন। টাইগারপাসে রেলওয়ে কলোনি এলাকায় ছেনোয়ারা বেগমের ঘরটি মাসিক দুই হাজার টাকা ভাড়ায় নিয়ে তারা বসবাস শুরু করেন। পিবিআই পরিদর্শক

(মেট্রো) মনোজ কুমার দে বলেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি তারা বাসা ভাড়া নেয়। প্রতিদিন সকালে দু’জন নাস্তা খেতে আমবাগানে দুলাল সওদাগরের চা দোকানে যেত। সেখানে পরিচয় হয় কর্মচারী আব্দুর রহমানের সঙ্গে। দোকানে আসাযাওয়ার সুবিধার জন্য আব্দুর রহমানও ১৫ ফেব্রুয়ারির দিকে তাদের সঙ্গে ওই বাসায় ওঠে। দুই মেলায় সালাহউদ্দিন ঠিকাদারের অধীনে কাজ করছিল। স্বপন ও আব্দুর রহমানকেও তার সঙ্গে কাজ পাইয়ে দেয়।

আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই কর্মকর্তা মনোজ বলেন, মেলায় সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ডিউটি করলে একজনকে ৭০০৮০০ টাকা এবং রাত ১২টা পর্যন্ত করলে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা করে দিতেন ঠিকাদার (শ্রমিক সরবরাহকারী)। তবে ঠিকাদারের সঙ্গে শুধুমাত্র

সালাহউদ্দিনের যোগাযোগ ছিল। তিনজনের টাকা একা সালাহউদ্দিন নিত এবং পরে ভাগ করে দিত। অন্য শ্রমিকদের কাছ থেকে স্বপন ও আব্দুর রহমান জানতে পারে, তাদের প্রতিদিনের মজুরি থেকে সালাহউদ্দিন ৪০০ টাকা করে কেটে নিজে রেখে দিত। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়। এরপর বাসায়ও গোসলের পানি

বেশি ব্যবহার করতেন সালাহউদ্দিন। তিনজনের কিনে আনা পানি বেশি ব্যবহার নিয়ে তাদের মধ্যে একদিন ঝগড়া হয়। সালাহউদ্দিন দু’জনের মাবাবা ধরে গালিগালাজ করেন। সেই ক্ষোভ থেকে দু’জন মিলে তাকে খুন করে। পিবিআই পরিদর্শক মনোজ কুমার দে বলেন, গ্রেপ্তারের সময় আব্দুর রহমানের হাতের ওপর জখমের চিহ্ন দেখে আমরা তাকে শনাক্ত করি। তার কাছ থেকে সালাহউদ্দিনের মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক কামরুল ইসলাম জানান, ঘটনার এক সপ্তাহ আগে স্বপন ও আব্দুর রহমান মিলে সালাহউদ্দিনকে ‘উচিৎ শিক্ষা’ দেওয়ার পরিকল্পনা করে। তারা একটি ধারালো ছোরা কিনেন। লাশ উদ্ধারের তিনদিন আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সালাহউদ্দিন বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়েন। আব্দুর রহমান ও স্বপন কিছুক্ষণ লুডু খেলে শুয়ে পড়েন। রাত একটার দিকে দু’জন ঘুম থেকে উঠে। স্বপন প্রথমে ঘুমন্ত সালাহউদ্দিনের গলায় ছুরি দিয়ে আঘাত করে। আব্দুর রহমান সালাহউদ্দিনের দুই হাত চেপে ধরে। স্বপনের হাত থেকে ছুরি নিয়ে আবার গলায় আঘাত করে আব্দুর রহমান। সালাহউদ্দিন তখন সর্বশক্তি দিয়ে ছুরি কেড়ে নিতে চাইলে ধ্বস্তাধ্বস্তি হয় এবং আব্দুর রহমানের হাতের কবজির ওপরে জখম হয়। তবে সালাহউদ্দিন দ্রুত নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং তার মৃত্যু হয়। তখন আব্দুর রহমান রুমে থাকা গামছা দিয়ে সালাহউদ্দিনের দুই হাত এবং স্বপন দুই পা ওড়না দিয়ে বেঁধে গামছা ও কম্বল দিয়ে লাশের মুখ ঢেকে দেয়। হত্যাকাণ্ডের পর নিহত সালাহউদ্দিনের পকেট থেকে ৩৫০ টাকা নিয়ে নিজেরা ভাগ করে নেয়। তার মোবাইল আব্দুর রহমান নিয়ে নেয়। এরপর তারা দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে যায়।

২৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে দু’জন বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে অলঙ্কার মোড়ে যায়। সেখান থেকে বাসে ফেনী যায়। ফেনী থেকে কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে ওইদিনই নরসিংদী চলে যায়। নরসিংদীর মালদ্বীপ বাজারে গিয়ে দু’জন কুলির কাজ পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কারণ, তাদের হাতে তখন টাকা ছিল না। নরসিংদী থেকে দু’জন ভাগ হয়ে যায়। স্বপন সেখানে থেকে যায়। আব্দুর রহমান নারায়ণগঞ্জে তার মামার বাড়িতে চলে যায়। সেখান থেকে পরদিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় নিজের শ্বশুরবাড়িতে যায়। মূল শ্বশুরবাড়ি থেকে আনুমানিক ৫৬ কিলোমিটার দূরে তাদের পুরনো বাড়িতে আব্দুর রহমানকে রাখা হয়। সেখানে সে বালি টানার কাজ নেয়। খবর পেয়ে আমরা সেখানে অভিযান চালালে তিনি পালিয়ে ঢাকার ধানমন্ডিতে স্ত্রীর কাছে চলে যায়। স্ত্রী সেখানে বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। পিবিআই টিম কৌশলে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে আব্দুর রহমানকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইংল্যান্ড ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল চট্টগ্রামে
পরবর্তী নিবন্ধনতুন ধান উদ্ভাবন, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সুখবর