দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সর্বসাধারণের জন্য অঘোষিতভাবে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকা কক্সবাজারের চকরিয়ার ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালের ইজারা অবশেষে বাতিল হয়ে গেছে। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের প্রতি এই জলমহাল ইজারার কার্যক্রম পুনরায় না চালাতে উচ্চ আদালত এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই খবর চকরিয়া উপজেলাজুড়ে মাইকিংও করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। এতে উপকূলীয় সাতটি ইউনিয়নের লাখো মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। উচ্চ আদালতের আদেশের পর থেকে ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালের সুযোগ–সুবিধা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় কৃষককুলেও বেশ উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাস্টার শোয়াইবুল ইসলাম সবুজ দৈনিক আজাদীকে বলেন, শতবছর ধরে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহাল। কিন্তু বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই বদ্ধ জলমহাল কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সামান্য রাজস্ব আহরণের নাম দিয়ে তিন বছর অন্তর ইজারা নিয়ে। এতে মিঠা পানির উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার কৃষক তাদের অন্তত ১০ হাজার একর জমিতে প্রতিবছর অর্ধশত কোটি টাকার ফসল ফলাতে পারেনি। বিষয়টি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের নজরে আসার পর সর্বসাধারণের কথা মাথায় রেখে এই বদ্ধ জলমহাল যাতে সর্বসাধারণের জন্য একেবারে উন্মুক্ত থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অবশেষে উচ্চ আদালতের আদেশে জেলা প্রশাসন কর্তৃক আর ইজারা দিতে পারবে না এই বদ্ধ জলমহাল। এতে উপকূলীয় ৭টি ইউনিয়ন তথা বদরখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর ও সাহারবিল ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার একর জমিতে তিনবার ফসল ফলাতে পারবেন কৃষক। এজন্য তারা খুব খুশি।
বিএনপি নেতা শোয়াইবুল ইসলাম সবুজ অভিযোগ করেন, ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালের পাঁচ স্থানে সমুদ্র উপকূলের সঙ্গে লাগোয়া পাঁচটি স্লুইচ গেট রয়েছে। এমনকি চকরিয়ার উপকূলীয় চিংড়ি জোনেও বড় বড় ৩০টি স্লুইচ গেট রয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা কঙবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কিন্তু চকরিয়ার উপকূলীয় এসব স্লুইচ গেট নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে সুদূর ফেনী থেকে। এই কারণে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা মোটা অংকের টাকার ঘুষ নিয়ে এসব স্লুইচ গেট স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য ইজারা দিয়ে থাকেন চিংড়ি জোনের চোর–ডাকাতদের। এতে তারা ইজারাপ্রাপ্ত হয়ে চিংড়ি চাষিদেরও হয়রানি করে থাকেন। এক কথায় এসব চোর–ডাকাত ইজারাদারের কাছে লক্ষাধিক চিংড়ি চাষি একেবারে জিম্মি হয়ে পড়েন। এই বিষয়টিও সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখা উচিত বলে আমি মনে করি।
সরেজমিন ও তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীর একটি শাখা খালের নাম হচ্ছে ‘ঢেমুশিয়া খাল’। সেই খালটি শতবছর আগে মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পর এটি রূপান্তরিত হয় ‘ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালে’। ২০০ একর বিশিষ্ট ও ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মিঠা পানির উৎস এই বদ্ধ জলমহালটি এলাকার মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। এই খালের পানির নিত্য ব্যবহার ছাড়াও উপকূলীয় সাতটি ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার একর জমিতে ধান, সবজিসহ রকমারি ফসল উৎপাদনের করে আসছিলেন হাজারো কৃষক পরিবার। কিন্তু ওয়ান–ইলেভেন পরবর্তী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে জেলার বৃহৎ এই ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালের ওপর। কারণ ৬ কিলোমিটারের এই বদ্ধ জলমহালের গভীরতা যেমন রয়েছে, তেমনি প্রশস্ততাও রয়েছে বেশ। এই বদ্ধ জলমহালটি আবার সমুদ্র উপকূলের সাথেও সংযুক্ত। এই কারণে বর্ষায় উজানের পানি যাতে ভাটির দিকে নেমে যেতে পারে সেজন্য নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচটি স্লুইচ গেটও। এসব সুবিধার কারণে প্রায় ১৫ বছর আগে থেকে জেলা প্রশাসনের তৎকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাত করে এই বদ্ধ জলমহালকে ইজারাযোগ্য জলমহাল দেখিয়ে তিন বছর মেয়াদে ইজারা নিয়ে যাচ্ছেতাই লবণ পানি ঢুকিয়ে মাছ চাষ শুরু করে। যার ধারাবাহিকতা চলে আসছিল চলতি বছরও।
যদিওবা ইজারার শর্ত ছিল, মিঠা পানির মৎস্য চাষ করতে হবে। সেই শর্ত ভঙ্গ করে প্রতিবছরই এই বদ্ধ জলমহালে স্লুইচ গেট খুলে সামুদ্রিক লবণ পানি ঢুকিয়ে চিংড়িসহ লবণাক্ত মাছ চাষ শুরু করে। এতে প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে ধান চাষসহ রকমারি সবজি উৎপাদনে মিঠা পানির সংস্থান না হওয়ায় হাজার হাজার কৃষক পরিবারে নেমে আসে চরম দুর্দশা।
দেশে খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় প্রতি ইঞ্চি জমি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা সরকারিভাবে থাকলেও চকরিয়ার উপকূলীয় সাতটি ইউনিয়নে প্রতিবছর দুই মৌসুমে অনাবাদী পড়ে থাকতো ১০ হাজার একর জমির চাষাবাদ। এই অবস্থায় আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আসছিলেন ভুক্তভোগী কৃষকেরা।
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এসব জমি কেন অনাবাদী এমন প্রশ্নে উপকূলীয় পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব পাড়ার কৃষক মো. ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, বাড়ির কাছে বড়দিয়া বিলটি হচ্ছে ১০ দ্রোনের বা ১৬০ কানির। বিপুল এই জমি বর্তমানে পড়ে রয়েছে একেবারেই অনাবাদী। কারণ এসব জমিতে ধান চাষসহ রকমারি ফসল ফলাতে মিঠাপানির একমাত্র উৎস হচ্ছে ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহাল। সেই জলমহালের চারিদিকে থাকা সমুদ্র উপকূলের স্লুইচগেটগুলোর মধ্যে পাঁচটি স্লুইচ গেট দিয়ে প্রতিনিয়ত ঢোকানো হয়ে আসছিল লবণ পানি। এতে প্রায় ২০০ একর বিশিষ্ট ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলমহালটির সব পানিই এখন লবণাক্ত হয়ে পড়ে। এতেই কপাল পুড়েছে প্রান্তিক কৃষকের।
উপকূলীয় সাত ইউনিয়ন সাহারবিল, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর ও বদরখালী ইউনিয়নের অন্তত ৩০ হাজার কৃষক পরিবার এসব ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে ধানের চারা রোপণ করার পর বেকায়দায় পড়ে যান। মিঠাপানির আঁধার ঢেমুশিয়া জলমহালটি লবণপানিতে টইটম্বুর হয়ে পড়ায় গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় রোপিত জমির ফসল। এতে প্রতিটি ইউনিয়নে দিগন্তজোড়া ধানের জমিতে রোপিত চারা মিঠা পানি না পেয়ে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে যায়। লবণ পানির কারণে গবাদি পশুসহ ১০টি গ্রামের লোকজন সুপেয় পানি থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। লবণাক্ত পানির কারণে খোদ জলমহালের পানিতে ভাসতে থাকা কচুরিপানাও পুড়ে লাল–কালচে হয়ে মরে যাচ্ছিল।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কার্যালয় সূত্র জানায়, ইজারা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে ঢেমুশিয়া জলমহালে লবণ পানি ঢোকানোর কারণে প্রতিবছর উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোর চাষাবাদে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে আসছিল। এখন থেকে ইজারা দেওয়া না হলে তার সুফল কৃষককূল ভোগ করবে।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রূপায়ন দেব দৈনিক আজাদীকে বলেন, ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালের ইজারা বাতিল হয়েছে মর্মে মাইকিং শুনেছি। তবে এখনো এই সংক্রান্ত কাগজপত্র আমাদের হস্তগত হয়নি। উচ্চ আদালতের কী আদেশ দেওয়া হয়েছে তা কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পর পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।












