ঘরের সবাই দগ্ধ, রক্ষা পেল নবজাতক

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১০ নভেম্বর, ২০২০ at ৪:২২ পূর্বাহ্ণ

রিয়াজুল-সালমা জাহান বৃষ্টি দম্পতির বিয়ের বয়স এক বছরের একটু বেশি। ৪ নভেম্বর এ দম্পতির ঘর আলো করে আসে এক কন্যা সন্তান। নতুন অতিথি নিয়েই রাজ্যের ব্যস্ততা রিয়াজুলের পরিবারে। স্ত্রী আর নবজাতকের সাথেই কাটছিল আনন্দঘন মুহুর্ত। কিন্তু সে আনন্দ খুব বেশি সময় স্থায়ী হয়নি রিয়াজুলের। রোববার রাতে আচমকা এক অগ্নিদূর্ঘটনায় সব আনন্দ ভেসে গেছে তাঁর। আগুনে দগ্ধ হয়ে এ দম্পতির ঠাঁই এখন হাসপাতালের বিছানায়। শুধু এ দুজন নয়, আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রেহাই মেলেনি ঘরে থাকা আরেক পরিবারের ৭ জনের একজনেরও। কিন্তু অলৌকিকভাবে আগুন ছুঁতে পারেনি সে-ই নবজাতককে। অর্থাৎ ঘরের সবাই দগ্ধ, কেবল নবজাতকটি ছাড়া!
নবজাতক কন্যাকে বাঁচানোর কথা বলতে গিয়ে হাসপাতালের বিছানায় থাকা মা সালমা জাহান বলছিলেন- ‘রুমের দরজা বন্ধ ছিল। বিছানায় আমরা দুজন (স্বামী-স্ত্রী) দুপাশে, মাঝখানে বাচ্চা ছিল। হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই দরজা ব্লাস্ট হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বাচ্চাকে বাঁচাতে দুজনে দুপাশ থেকে আগলে রাখি। আমরা দুজন আগুনে পুড়লেও বাচ্চাকে বাঁচাতে পেরেছি। এটাই এখন একমাত্র সান্তনা। আল্লাহ, আমার মেয়েটিকে বাঁচিয়েছেন।’
গত রোববার রাতে নগরীর উত্তর কাট্টলী এলাকার মরিয়ম ভবনে সংঘটিত অগ্নিকান্ডে ৫ দিনের নবজাতকের অলৌকিকভাবে রক্ষা পাওয়ার ঘটনা এটি। নবজাতক রক্ষা পেলেও ঘরের আর কেউ রেহাই পায়নি আগুনের লেলিহান শিখা থেকে। নবজাতকটির মা-বাবা দুজনেই বর্তমানে চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। গতকাল দুপুরে বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়- পুরুষ ব্লকের ৫নং শয্যায় রিয়াজুলের এবং মহিলা ব্লকের ৩০ নং শয্যায় ঠাঁই হয়েছে সালমা জাহানের। রিয়াজুলের বিছানার পাশে নির্বাক হয়ে বসে আছেন মা দেলোয়ারা বেগম ও বোন লাভলী আকতার। আর সালমা জাহানের বিছানার পাশে আছেন তার মা। সালমার ৫ম শ্রেণি পড়ুয়া ভাই ইয়াছিন রায়হানকে দেখা গেল এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে। কিছুক্ষন দুলাভাইয়ের পাশে তো আর কিছুক্ষন বোন সালমার পাশে গিয়ে বসতে দেখা যায় তাকে।
রিয়াজুলের মুখমন্ডলসহ শরীরের ১৮ শতাংশ এবং সালমা জাহানের শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন।
রিয়াজুল ও সালমা জাহানের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২৫ বছরের যুবক রিয়াজুল উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির বিবিরহাট এলাকার আজিমপুরে। গ্রামে তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। রিয়াজুলের শ্বশুর আলী হোসেন পরিবার নিয়ে থাকতেন উত্তর কাট্টলী এলাকায়। সেখানে অর্গানেঙ নামে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন তিনি। ওই পোশাক কারখানায় মেয়ের জামাইয়ের জন্যও চাকরির ব্যবস্থা করেন আলী হোসেন। চাকরির ব্যবস্থা হলে তিন মাস আগে স্ত্রী সালমাকে নিয়ে ফটিকছড়ি থেকে শহরে চলে আসেন রিয়াজুল। উত্তর কাট্টলী এলাকায় শ্বশুরের বাসার পাশে বাসা নেন। তবে মরিয়ম ভবনের ৬ তলায় আরেক পরিবারের সাথে একই ফ্ল্যাটে সাবলেট হিসেবে উঠেন গত অক্টোবরে। সে-ই ফ্ল্যাটে উঠার এক মাস ৮দিনের মাথায় বিষাদময় এমন ঘটনার শিকার হতে হয়েছে এ দম্পতিকে।
ডাক্তার দেখাতে এসে দগ্ধ তাঁরা :
মরিয়ম ভবনের ৬ তলার ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মিজানুর রহমান। স্ত্রী বিবি সুলতানা এবং দুই সন্তান মাহির-মানহাকে নিয়েই থাকতেন তিনি। অক্টোবর থেকে বাসার একটি রুম রিয়াজুল ও সালমা জাহান দম্পতিকে সাবলেট হিসেবে ভাড়া দেন।
কয়েকদিন আগে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী থেকে মা পেয়ারী বেগম, ভাই সাইফুল ইসলাম ও বোন সুমাইয়া মিজানুরের বাসায় আসেন। ডাক্তার দেখাতে মাকে নিয়ে ভাই-বোনরা মিজানুরের বাসায় আসেন বলে জানান রিয়াজুলের স্ত্রী সালমা জাহান। ডাক্তার দেখাতে এসেই আগুনে দগ্ধ হলেন তারা। গ্যাসের চুলায় আগুন ধরাতে গেলেই হঠাৎ দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। বন্ধ থাকা দরজা ব্লাস্ট হয়ে রিয়াজুল-সালমা জাহানের রুমেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মিজানুরের পরিবারের একজনও আগুনের এই লেলিহান শিখা থেকে রেহাই পায়নি। এই আগুনই নিভিয়ে দিয়েছে মিজানুরের মা পেয়ারি বেগমের জীবন প্রদীপ।
হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন বলেন, ‘দগ্ধদের মধ্যে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা পেয়ারী বেগমের অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। তার শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। আইসিইউতে নিয়ে গেলেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মিজানুরের পরিবারের বাকি ৬ সদস্যকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ নাকি বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট
পরবর্তী নিবন্ধউত্তর কাট্টলীতে বহুতল ভবনে আগুন