ড. হাছান মাহমুদ রক্তে রঞ্জিত। তার সারা শরীরে রক্ত ঝরছে। রক্তে লাল হয়ে গেছে পরনের শার্ট। কাঁদছেন হাছান মাহমুদ। খুলে গেছে শার্টের বোতাম। নারীনেত্রী বর্তমান সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট রুবিনা মিরা ও অপর এক নেত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী এবং বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের এমন দৃশ্য দেখা যায়।
জানা যায়, ওইদিন বিস্ফোরিত আর্জেস গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টার তার শরীরে ঢুকে যায়। চিকিৎসায় কিছু স্প্লিন্টার বের করা হয়। বাকি ৪০টি স্প্লিন্টার এখনো তার শরীরে রয়ে গেছে। যেগুলো বের করতে গেলে তার নার্ভ কেটে বের করতে হবে। ফলে তার মৃত্যুও হতে পারে। তাই তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাকি স্প্লিন্টার বের করেননি। গ্রেনেডের ক্ষত ও সেদিনের দুঃসহ কষ্টের দিনগুলো তিনি এখনো এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেন না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করাই একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরে ড. হাছান মাহমুদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তখন আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ছিলাম। তখন আমি একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়াতাম। ইউনিভার্সিটি থেকে এসে আমার স্ত্রীকে বললাম তাড়াতাড়ি ভাত দাও, বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে মিটিং আছে, মিটিংয়ে যেতে হবে। খুব দ্রুত খেয়ে আমি সুধা সদনে যাই, সেখান থেকে নেত্রীর গাড়ির পেছনের গাড়িতে করে আমরা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আসি। আমরা নেত্রীর আই কন্টাক্টে থাকার চেষ্টা করতাম। যাতে নেত্রী কোনো কিছু ইশারা করলে কিংবা বললে সেটি আমরা কেরিআউট করতে পারি। ভিড়ের মধ্যে নেত্রী যেই ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন তার ঠিক নিচে ছিলাম আমি এবং উনি আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন। পাশে কাদের (ওবায়দুল কাদের) ভাইও ছিলেন। খুব ভিড় ছিলো। নেত্রী বক্তৃতা দিতে উঠলেন, সাথে সাথেই ব্লাস্ট হলো। আমি মনে করেছিলাম টায়ার ব্লাস্ট হয়েছিল। ধারণাই করিনি যে এটি বোমা বা গ্রেনেড পড়েছে। দ্বিতীয়টা ব্লাস্ট হওয়ার পর দেখিযে ভিড়ের মধ্যে সবাই ছোটাছুটি করার চেষ্টা করছে। আমিও তখন ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আমাদের পার্টি অফিসের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু অনুভব করলাম যে, আমার পিছনে পিঁপড়ার মতো কিছু একটা লাগছে। পার্টি অফিসের দরজায় যখন দাঁড়িয়ে তখন কলাপসিবল গেটটা বন্ধই ছিল। আমাকে দেখে খোলা হলো। ওই সময় একঝাঁক পিঁপড়া পেছন থেকে কামড় দিচ্ছে–এ রকম মনে হয়েছে। তারপর যখন পার্টি অফিসে ঢুকলাম, তখন দেখলাম আমার শার্ট–প্যান্ট রক্তে ভিজে গেছে। এরপর আর কদম দিতে পারছিলাম না। এই অবস্থায় পার্টি অফিসে যারা ছিল তারা আমাকে ধরাধরি করে যুবলীগ অফিসে নিয়ে যায়। চারদিকে রক্ত। প্রথমত আমার স্ত্রীকে বলতে চাইনি, পরে ফোনে চেষ্টা করে না পেয়ে আমি চেষ্টা করলাম আমার এক আত্মীয়কে ফোন দেয়ার। তাকে বলছিলাম আমাদের মিটিংয়ে বোমা পড়েছে, একটি গাড়ি পাঠানোর চেষ্টা কর কিংবা আমার গাড়িটা পাঠাও। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল না আমি কী বলছি। এরপর কিছুক্ষণের জন্য বেহুশ হয়ে যাই। হুশ ফেরার পর যুবলীগ অফিসের মিটিং টেবিলের ওপর শোয়া অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম। তখন আমাদের মহিলাকর্মী মিরাসহ কয়েকজন আমাকে নামাচ্ছিলেন। সে সময় দেখলাম পার্টি অফিসের ভেতরেই একজন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। যখন আমাকে বাইরে বের করা হলো, দেখলাম চারদিকে রক্ত, বেশ কয়েকজন কাতরে কাতরে মারা যাচ্ছে। কেউ কেউ পড়ে আছে এবং গ্রেনেড আমি নিজের চোখে দেখলাম। দেখলাম শুধু স্যান্ডেল আর চারদিকে রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে। এরপর পার্টি অফিস থেকে দুজনের কাঁধে ভর করে মেইন রাস্তার দিকে যাচ্ছিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর একটি মিনি বাসের মধ্যে তোলা হলো। সেখানে আমাদের প্রয়াত শ্রদ্ধাভাজন নেতা সুরঞ্জিতদা রক্তাক্ত অবস্থায় ছিলেন। তাকে ধরেছেন সাবের হোসেন চৌধুরীসহ আরও একজন। একজন ক্যামেরাম্যান তখন ছবি তুলছিলেন সেটি আমার মনে আছে। গাড়িতে রাজ্জাক ভাইও ছিলেন। আমাদেরকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হলো। দেখি দুয়েকজন আসল একটু কি কি করে আবার চলে গেল।, এরপর কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে। রাজ্জাক ভাইয়ের গাড়ি আসার পর উনি আমাকে তার গাড়িতে তুলে সিকদার মেডিক্যালের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। উনাকে বললাম আমার খুব ব্যথা হচ্ছে, আমাকে যেকোনো একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। তারপর খুব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে আমাকে আর রাজ্জাক ভাইকে তাঁর চালক সিকদার হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। তখন আমার কয়েকজন বন্ধু–বান্ধবসহ অনেকেই জেনেছে যে, আমি মারা গেছি। কয়েকজন দ্রুত দৌড়ে এসে আমাকে দেখার পর স্বস্তি পেলেন। সেখানে ১০/১২ দিন ছিলাম। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশেও (বেলজিয়াম) পাঠিয়েছেন। কিছু স্প্লিন্টার সিকদার হাসপাতালে অপসারণ করেছিল, যেগুলো সারফেসের দিকে ছিল। বিদেশে যাওয়ার পর তাদেরকে বলছিলাম, আমার তো আরও অন্তত ৪০টি স্প্লিন্টার আছে, যেগুলো আবার সারফেসে না। এগুলো অপসারণ করতে যে পরিমাণ কাটাকাটি করতে হবে তাতে অনেকগুলো নার্ভ কাটা পড়ে ক্ষতি বেশি হবে। সেই ৪০টি স্প্লিন্টার এখনো কিন্তু আছে। শত শত মানুষ স্প্লিন্টার নিয়েই কিন্তু বেঁচে আছেন, অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছেন এই ঘটনায়।