নগরী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘গ্রাম’ সিরিয়ালের সিএনজি টেক্সি। আর নগরীর প্রতিটি প্রবেশ দ্বার হয়ে পড়েছে অঘোষিত সিএনজি টার্মিনাল। অভিযোগ রয়েছে– নগরীতে অবৈধভাবে গ্রাম সিএনজি টেক্সির দাপিয়ে বেড়ানোর নেপথ্যে রয়েছে কয়েকটি সিন্ডিকেটের হাত। এদের মধ্যে রয়েছে পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং কয়েকজন পরিবহন শ্রমিক নেতা। তারা মাসোয়ারার বিনিময়ে গ্রামের সিএনজি টেক্সিকে নগরীতে চলাচলের জন্য টোকেনের নামে কথিত রুট পারমিট দিয়ে থাকেন। নগরীর প্রবেশ মুখগুলোতে যানজট হ্রাস করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার মাহবুবুর রহমান এক বিশেষ উদ্যোগ নিলেও তাঁর বদলির পর ট্রাফিক পুলিশ ও সিএনজি নেতাদের যোগসাজসের কারণে এ নৈরাজ্য বন্ধ করার চেষ্টা করেও পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে।
তবে ‘গ্রাম’ সিএনজি টেক্সিকে চলাচলের জন্য ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃক দেওয়া টোকেনের কথা অস্বীকার করেছেন সিএমপির ট্রাফিক (পশ্চিম) জোনের উপ–পুলিশ কমিশনার তারেক আহমেদ। তিনি আজাদীকে বলেন, কখনও কখনও ট্রাফিক এবং থানা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনুমোদনহীন সিএনজি টেক্সি নগরীতে চলাচলের চেষ্টা করে। তবে ট্রাফিক এবং থানা পুলিশের নজরে এলে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, কোনো পুলিশ সদস্য এ ধরনের কাজ করে থাকলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গ্রাম সিএনজিগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। প্রায়ই এ ধরনের সিএনজি জব্দ করা হয়।
মহানগর অটোরিকশা–অটোটেম্পো মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী বলেন, নগরীতে ১০ হাজারের বেশি সিএনজি অবৈধভাবে চলছে। অথচ নগরীতে এসব টেক্সি চলাচলের অনুমোদন নেই। এমনকি অনেক গাড়ির নম্বর পর্যন্ত নেই। এরপরও প্রশাসনের চোখের সামনে কীভাবে এগুলো চলছে তা আমার জানা নেই। এসব অটোরিকশা বন্ধের জন্য একাধিকবার প্রশাসনকে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানিয়েছি। কোনও কাজ হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মোটরযান আইন অনুযায়ী বিআরটিএর রুট পারমিট ছাড়া কোনো গাড়ি নগরীতে চলাচলের সুযোগ নেই। টোকেন নিয়ে নগরীর অর্ধশতাধিক এলাকায় চলছে ‘চট্টগ্রাম’ ‘প্রাইভেট’ এবং ‘নিলাম’ লেখা রুট পারমিটবিহীন সিএনজি টেক্সি। নগরীর প্রায় ৪০টির বেশি অনুমোদনহীন রুটে অবৈধভাবে চলছে এসব ত্রুটিপূর্ণ ও নিবন্ধনহীন কয়েক হাজার গাড়ি। নগরীতে গ্রাম সিএনজি টেক্সি চলাচল করে এমন স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে– টাইগারপাস থেকে ওয়্যারলেস, পাহাড়তলী পুলিশ বিট, ঝাউতলা, শাহ আমানত সেতু এলাকা, মুরাদপুর, বায়েজিদ, হিলভিউ আবাসিক, অক্সিজেন, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, বহদ্দারহাট হক মার্কেট পয়েন্ট থেকে হাজীপাড়া, বহদ্দারহাট হক মার্কেট পয়েন্ট থেকে চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল, বহদ্দারহাট থেকে মৌলভী পুকুর পাড়–বাহির সিগন্যাল, সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে ১৪ নম্বর গ্যারেজ–পাঠাইন্নাগোদা, সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে হামিদচর–বিসিক শিল্প এলাকা, সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে দেশ গার্মেন্টস, খাজা রোডের মুখ থেকে রাহাত্তারপুল, খাজা রোডের মুখ থেকে বলিরহাট, ফ্রিপোর্ট, বন্দর, পতেঙ্গা, হালিশহর, পাহাড়তলী এবং আকবর শাহর বেশ কিছু এলাকা।
চট্টগ্রামের কাপ্তাই রাস্তার মাথায় সিএনজি টেক্সি থেকে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা চাঁদা তুলে ভাগ বাটোয়ারা করছে শ্রমিক নেতারা। শ্রমিক কল্যাণের নামে এসব টাকা উত্তোলন করলেও নাম মাত্র শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করে অবশিষ্ট অর্থ নেতাদের পকেটে চলে যায়। পরিবহন শ্রমিক নেতা আজাদ ও হারুনের নেতৃত্বে কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় গ্রাম সিএনজি থেকে প্রতিদিন আদায় হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ টাকার চাঁদা। কিছুদিন পরপর চাঁদার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে এখানে রক্তারক্তি হয়। উত্তর এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রায় দেড় হাজার বৈধ–অবৈধ সিএনজি টেক্সি জমায়েত হয় এই এলাকায়। এখান থেকে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে ছাড়ে। অথচ নগরীতে গ্রাম সিএনজি টেক্সি প্রবেশ করার কথা নয়।
বহদ্দারহাট এলাকায় গত বুধবার সকালে গ্রিল লাগানো একাধিক টেক্সি চোখে পড়ে। একটি টেক্সির গায়ে কথিত এক সাংবাদিকের নাম ও মোবাইল নম্বর লেখা রয়েছে।
নতুন ব্রিজ এলাকার পরিবহন শ্রমিক ও চালকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতি গাড়ি থেকে দৈনিক ২০০ টাকা ও মাসে ৫০০০ টাকা মাসোয়ারা নিয়ে নেন কথিত দালাল হারুন।
সরেজমিনে নগরীর টাইগারপাস এলাকায় দেখা গেছে, তিনটি রুটে অবৈধভাবে গ্রাম সিরিয়ালের সিএনজি টেক্সি চলাচল করে। এসব রুটগুলো হল– টাইগারপাস থেকে ওয়ার্লেস, পাহাড়তলী পুলিশ বিট, ঝাউতলা। এসব সিএনজি আমবাগান এলাকায়ও স্টেশন তৈরি করে; তবে সেটার নির্দিষ্ট কোনও রুট নেই। অন্যান্য রুটের গাড়ি সেখানে অবস্থান করতে পারে। টাইগারপাস মোড়ে একাধিক সিএনজি চালকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, টাইগারপাস থেকে ওয়ার্লেস মোড় পর্যন্ত ৫৪টি, টাইগারপাস থেকে পাহাড়তলী পুলিশ বিট পর্যন্ত ৫২টি এবং টাইগারপাস থেকে ঝাউতলা পর্যন্ত ৫৩টি অবৈধ গ্রাম সিএনজি টেক্সি চলাচল করে।
নগরীর অক্সিজেন মোড়ে আক্ষেপ করে বলছিলেন সিএনজি টেক্সি চালক সেলিম উদ্দিন। জানালেন রংপুর থেকে চাকরির জন্য চট্টগ্রাম এসেছিলেন তিন বছর আগে। এখন তিনি সিএনজি টেক্সি চালান। গাড়ির মালিকের পরিচয় প্রকাশ না করে চালক সেলিম গত বৃহস্পতিবার সকালে আজাদীকে বলেন, আমার গাড়ি চট্টগ্রাম জেলার। রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) নাই। গাড়ি চালাই অক্সিজেন থেকে হাটহাজারী এলাকায়। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন না থাকায় থানার ক্যাশিয়ারকে মাসে এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এসময় অক্সিজেন এলাকায় নিবন্ধন থাকা সিএনজি টেক্সির বেশ কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, এমন কোনো সিএনজি টেক্সি (চট্টগ্রাম জেলায় চলাচলকারী) নেই যে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হচ্ছে না। গ্রামের গাড়িকে গ্রামেও চাঁদা দিতে হয়। শহরে যাত্রী নিয়ে ঢুকলে আবার চাঁদা দিতে হয়। আর গ্রাম থেকে শহরের কয়েকটি রুটে চললে আবার টাকা দিতে হয়। তাদের ভাষ্য, অক্সিজেন থেকে হাটহাজারী–নাজিরহাট–খাগড়াছড়ি সড়কে আড়াই থেকে তিন হাজার সিএনজি টেক্সি চলাচল করে। প্রতিটি গাড়ির জন্য মাসে গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।
নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় দেখা গেছে, নম্বরবিহীন ১৫–২০টি সিএনজি টেক্সি দাঁড়িয়ে আছে। বিভিন্ন আবাসিক এলাকা ও মূল সড়কে যাত্রী পরিবহন করছে সেগুলো। এসব গ্রাম সিএনজির স্ট্যান্ড হল আলমগীর সড়ক থেকে টেক্সটাইল মোড়, শেরশাহ থেকে আলিনগর, বায়েজিদ থানা রোড (চত্বর) এর পর থেকে আমিন জুট মিলস কাঁচা বাজারের সামনে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সড়ক থেকে কুয়াইশ ও নয়ারহাট রোড।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিটি সিএনজি স্ট্যান্ডে একজন করে লাইনম্যান থাকে। অবৈধ যানবাহনকে বৈধ করতে লাইনম্যান, টোকেন দেয়। টোকেনের বিপরীতে পরিবহন খাত থেকে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কীভাবে নগরীর অলিতে–গলিতে চলে এ বিষয়ে জানতে কথা হয় সিএনজি চালক মোহাম্মদ সেলিমের সাথে। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা আছে ঠিকই! কিন্তু যাতে এখানে গাড়ি চালাতে সমস্যা না হয়। সেজন্য প্রতিমাসে থানা পুলিশ থেকে দেড় হাজার টাকার টোকেন নিতে হয়। তিনি আরো বলেন, এ টাকা প্রথমে এ লাইনের নেতারা নেন। তারপর তাদের হিসাব থেকে থানায় ভাগবণ্টন করা হয়। এছাড়া প্রতিবার ভাড়া নিয়ে যেতে লাইনম্যানকে ৫/১০ টাকা দিতে হয়। চালকরা বলেন, টোকেন থাকলে আমাদেরকে পুলিশ সমস্যা করে না। এরপরও যদি কোনো সমস্যা হয়; তাহলে এ সমস্যাগুলো লাইনের নেতারা দেখেন।