শান্তিতে নোবেলজয়ী ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা কাঠামো ও কর্তৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এই ব্যাংকে সরকারের অংশীদারত্ব ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাব চূড়ান্ত হলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকটির কর্তৃত্ব চলে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। খবর বিডিনিউজের।
২০১৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারির জন্য এই খসড়া তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই খসড়ায় তুলে ধরা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক সংস্কারের রূপরেখা। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দীর্ঘ ২৮ বছর গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
১৯৮৩ সালের গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের ২৫ শতাংশ মালিকানা এখন আছে সরকারে হাতে; বাকি ৭৫ শতাংশ ঋণগ্রহীতাদের। আইন সংশোধনের খসড়ায় ঋণগ্রহীতাদের কাছে ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ৩০০ কোটি টাকা। ঋণগ্রহীতারা ধীরে ধীরে মূলধনে অবদান বাড়িয়ে ৯৫ শতাংশ মালিকানা অর্জন করবেন। বোর্ড ঘোষিত যে কোনো লভ্যাংশ মূলধনের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে বিতরণ করা হবে।
ব্যাংক পর্ষদে সরকার–নিযুক্ত পরিচালকের সংখ্যা তিনজন থেকে কমিয়ে একজন করা এবং চেয়ারম্যান নিয়োগে সরকারের ভূমিকা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়।
বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান নিয়োগ হবে পর্ষদের সদস্যদের ভোটে। ১২ সদস্যর পর্ষদের ১১ জনই ব্যাংকের গ্রাহকদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। চেয়ারম্যানের ক্ষমতা কমবে, সেই ক্ষমতা যাবে পর্ষদের হাতে। পর্ষদ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেবে বাছাই কমিটির মাধ্যমে। আইন সংশোধন হলে গ্রামীণ ব্যাংকে পরিচালকদের মেয়াদ হবে তিন বছর। টানা দুই বারের বেশি কেউ পরিচালক থাকতে পারবেন না।
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বয়স হবে সর্বোচ্চ ৬৫ বছর। কোনো কারণে তিন মাসের বেশি সময় ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ শূন্য থাকলে পরিচালনা পর্ষদ যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান অক্ষম হলে, বোর্ডের সদস্যরা অন্য কোনো পরিচালককে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমোদন দিতে পারবেন।
অধ্যাদেশের বিধি তৈরিসহ উদ্ভূত কোনো সমস্যায় সরকারের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে গ্রামীণ ব্যাংকের পর্ষদকে।
গ্রামীণ ব্যাংক পল্লী এলাকার পাশাপাশি সারা দেশে শহর এলাকাতেও যাতে শাখা খুলতে পারে সেই সুযোগ রাখা হয়েছে আইন সংশোধনের প্রস্তাবে। এখন ব্যাংকের শাখা খুলতে সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। আইন সংশোধন হলে সেই অনুমোদন দেব বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংক নির্দিষ্ট আইনে পরিচালিত হওয়ায় জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। ব্যাংকের নিরিক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন জাতীয় সংসদে উত্থাপন ও সরকারের গেজেট আকারে প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা থাকে। আইন সংশোধনের খসড়ায় গেজেট প্রকাশের বিধানটি তুলে দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যমান আইনে বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংকের অবসানের বেলায় সরকারের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হবে। খসড়ায় সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে দেওয়া হয়েছে।
আইনের ১৯ নম্বর ধারার দফা ‘ছ’ এর ‘পল্লী এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ শব্দগুলো তুলে দিয়ে ‘দারিদ্র্য বিমোচনের’ শব্দবন্ধটি বসাতে বলা হয়েছে।
আর পল্লী এলাকার সংজ্ঞা দেওয়া গ্রামীণ ব্যাংক আইনের ২ নম্বর ধারার ৫ উপধারা বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমান আইনে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জোবরা গ্রামে মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার কোনো উল্লেখ নেই। খসড়া অধ্যাদেশে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা যুক্ত করতে বলা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প বলতে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধীনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে বোঝায়। এ প্রকল্প পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পায় এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক এতে অংশগ্রহণ করে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অধ্যাপক ইউনূসকে অবসরের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে আদালতে গিয়েও তিনি আর সেই পদে ফিরতে পারেননি।
গত ১৫ বছরে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মসূচি এবং ইউনূসকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে তিনি দেশত্যাগ করলে সেই ইউনূসের নেতৃত্বেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল হান্নান চৌধুরী বলেন, ‘নতুন সংশোধনীতে গ্রামীণ ব্যাংকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তথা গ্রাহকদের নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার বাড়বে। পরিচালনা পর্ষদে তাদের ভোটে সরাসরি নিয়োগ পাওয়া পরিচালকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি থাকবে, তবে তাদের ওপর নির্ভর করে ব্যাংক চলবে না।’