কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। করোনা মহামারিতে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের অর্থনীতি অনেকটা বিপর্যস্ত। তবে করোনা মহামারিতেও কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা বেশ ভালোভাবেই সচল ছিল। আর কৃষির বহুমুখীকরণের মাধ্যমেই অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখা সম্ভব হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাঁরা বলেন, প্রচলিত কৃষি কাজের বাইরে অর্থাৎ ধান–পাট এসব চাষের বাইরে কৃষির বিভিন্ন উপখাত যেমন, মৎস্য চাষ, হাঁস–মুরগীর খামার, পশু পালন, দুগ্ধ খামার, বছরব্যাপী সবজি ও ফলের চাষে ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এতে যেমন বহু বেকারের কর্ম সংস্থান হয়েছে তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিও বেশ চাঙ্গা হয়েছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৮ সালে প্রবাসে ৩ লাখ ১৭ হাজার দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি হলেও ২০১৯ সালের শেষে এসে এই সংখ্যা ৩ লাখ ৪ হাজারে এসেছে। সেই সঙ্গে স্বল্পদক্ষ জনশক্তি প্রেরণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৩ হাজার থেকে কমে ১ লাখ ৯৭ হাজারে নেমে এসেছে। ভবিষ্যতে প্রবাসে শ্রমবাজার তথা কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স ঠিক রাখতে আমাদের শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। কারণ, বৈশ্বিক এই সংকুচিত অর্থনীতিতে ভবিষ্যতের শ্রমবাজার হবে দক্ষ শ্রমনির্ভর বাজার। বৈদেশিক মুদ্রার বড় দুটি খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি ও অভিবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্স দুটিই পরনির্ভর, যে কোনো সময় এর ভালো–মন্দের হেরফের ঘটতে পারে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম পথ হলো বৈধ পথে প্রবাসী আয়। কিন্তু ডলারের দামের পার্থক্য বৈধ পথে ডলার আসায় গতি আনতে পারেনি। ডলার–সংকটের কারণে গত বছর ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা–বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনা, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়াতে অতিরিক্ত প্রণোদনা প্রদানসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপরও বৈধ পথে প্রবাসী আয় কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি। এমনকি এই ঈদের মৌসুমে প্রবাসী আয় বাড়েনি। সর্বশেষ গত মার্চ মাসে প্রবাসীরা ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ১৬ কোটি ডলার কম।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে। ডলার আসার অন্যতম প্রধান দুটি উৎস নিয়ে স্বস্তি আসেনি। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত নয়; তবে সংকট থেকে উত্তরণ হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন পত্রিকাটিকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে সংকট কেটে গেছে, তা বলা ভুল হবে। সংকট কাটার নির্ভরযোগ্য প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে না। কয়েক মাস আগেও নীতিনির্ধারকেরা সংকটকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু এখন তাঁদের মধ্যে যেন একধরনের তুষ্টি ফিরে এসেছে। সংকট থাকা অবস্থায় যদি তাঁরা বলেন, সংকট নেই–এটাই তো বড় সংকট। রপ্তানি আয় ছাড়া অন্য কোনো সূচকে সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।’ তবে গত ৯ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসে প্রচুর রেমিটেন্স এসেছে দেশে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে মার্চ মাসে রেমিটেন্স এসেছে ১.৯৯ কোটি ডলার বা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। যার সিংহভাগই যুক্ত হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এর বাইরে হুন্ডির মাধ্যমেও প্রচুর অর্থ দেশে এসেছে। এসব টাকায় কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঈদ শপিং করেছে মানুষ।
রমজানে মানুষ প্রচুর দান খয়রাত করেছেন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের হাতেও বেশ টাকা পয়সা গেছে। এসব অর্থও ব্যয় হয়েছে কেনাকাটায়। যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একাধিক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, দেশের পুরো অর্থনীতি আবর্তিত হয়েছে ঈদবাজারকে ঘিরে। গ্রাম কিংবা শহর সর্বত্রই কেনাকাটার ধুম পড়েছিল। বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে অর্থনীতি। যা দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য ও উৎপাদনের জোয়ার সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদেশ থেকে আসা বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স জাতীয় অর্থনীতি ও উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের পরেই এর অবস্থান। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের বার্ষিক রেমিট্যান্স এর পরিমাণ ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যা দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চাবিকাঠি। গ্রামীণ এলাকায় স্থানীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নকে সক্ষম করার পাশাপাশি, দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স ক্ষুদ্র শিল্প এবং অন্যান্য আয়বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম তৈরিতে সহায়তা করছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের রেমিট্যান্স আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং টেকসই উন্নয়নের সুযোগসৃষ্টিতে সহায়তা করছে।
তাই অর্থনীতির এই নড়বড়ে অবস্থা থেকে মুক্ত করতে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ ও দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা ও বৈষম্য দূর করে একটি টেকসই অর্থনীতি গঠনে ভূমিকা রাখবে।