জোছনা রাত মানে চারদিকে শুভ্র চাঁদের আলো গ্রামবাংলার পুকুর ঘাট কিংবা চিলেকোঠা বাড়ির ছাদ বা বাড়ির দাওয়াই বা আঙিনায় জোছনাস্নাত শুভ্র আলোতে ভেসে যায় পৃথিবী। অপরূপ শুভ্র দ্যুতিছড়ানো আলোতে পুকুর–নদী খালের জল জোছনা জলছবি সে এক অপরূপ দৃশ্য। চৈত্রমাসের শেষ–বৈশাখ মাসে প্রথম/ দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্ণিমার চাঁদকে চৈতি পুনম বলে থাকে। চাঁদটা গোলাপি ও হওয়াতে জোছনাপ্রেমীরা পিঙ্ক মুন লাইট নাইট বলে। ভরাপূর্ণিমায় রাতের বেলায় নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়, ছেলেবেলায় দাদি–নানিদের মুখে শোনা রূপকথার গল্প মনে পড়ে জোছনার দিকে তাকালে মনে হয় এই বুঝি চাঁদের বুড়ি চরকায় সুতা কাটছে। বাড়ির বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ করে ছাদবাগানে গিয়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গান গুনগুন করে গাইতে ইচ্ছে করে ‘রাতের গায়ে জোনাক যেমন জ্বলে তারার সাথে আকাশ কথা বলে। আমি তেমন করেই বলব কথা আমার প্রিয়ার সাথে ওগো রাত তুমি দিঘল হয়ে যাও ওগো চাঁদ তুমি জোছনা ছড়াও’ আগেকার দিনে জোছনা রাতে গ্রামবাংলায় মানুষ মেতে উঠত নির্মল আনন্দের পুথি পাঠ, কবিগান, পালাগানের আসর জমিয়ে রাখত। এজন্য বোধহয় জোছনা ও প্রকৃতিপ্রেমী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টি সেতার বাজবে সেই অলৌকিক সংগীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়’ গানও লিখেছিলেন ‘চাঁদনি পসরে কে আমায় স্মরণ করে, কে এসে দাঁড়ইছে গো আমার দুয়ারে, তাহারে চিনি না আমি সে আমারে চিনে’। কোনো এক লোককবি পাইন্য সাইর (সন্দ্বীপ এলাকা) রচনা করেছিলেন ‘আইস বন্ধু বইস কাছে খাওরে বাটার পান, ওরে আস্তে ধীরে কইমু কথা জুড়াইব পরান’ কত আবেগ দিয়ে রচনা!
সে সময় গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষের বিনোদনের উৎসহ ছিল, পুথি পাঠের আসর। পুথি হলো গাছের পাতা তুলট কাগজে হাতে লেখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। রাতের বেলায় যে বাড়িতে পুথির পাঠের আয়োজন হতো সে বাড়ির উঠোনে শীতল পাটি বা চাটা মাদুর বিছিয়ে গোল করে বসত। জোছনারাত না থাকলে কুপি বাতি, হারিকেন ম্যানথল লাইট জালিয়ে রাখত। আশেপাশের দু–চার গ্রাম কিংবা বাড়ির লোক এসে জড়ো হতো। বিশেষ করে কোনো বাড়ির মেজবান, জেয়াফত কিংবা কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের পান সল্লাতের পরে জমে উঠত পুথি পাঠের আসর। সে সময় পুথি পাঠ ছিল এক নির্দোষ ও অনাবিল বিনোদন অনুষ্ঠান, যে আসরে পিতা পুত্র, বয়োজ্যেষ্ঠ নারী পুরুষ সবাই বসে পুথির রস উপভোগ করে আনন্দে সুধা পান করত। পটিয়া উত্তর গোবিন্দাখীল গ্রামের পুথি সংগ্রাহক ও পাঠক বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূর কাশেম জানিয়েছিলেন, ‘রাতের বেলায় বাড়ির উঠোনে পুথি পাঠের আসর বসত। পাশের গ্রাম থেকে বন্ধু ইদ্রিছ, মঙ্গল, আবদুল মাবুদসহ আরো অনেকে আসতেন। একজনে পাঠ করতেন অন্যজন পুথি ব্যাখ্যা করে বলতেন। যিনি ব্যাখ্যা করতেন তাঁকে অনেকে পণ্ডিত বলত। পুথি পাঠ করার জন্য অত বেশি বিদ্যা জানা লাগত না। ছোটোবেলা থেকে পুথি সংগ্রহ করে পণ্ডিতদের মুখে মুখে শুনে তোতাপাখির মতো পুথি মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। অনেক সময় দুজন পণ্ডিত মিলে পুথি ব্যাখ্যার লড়াই করতাম। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করতেন। রাতভরে চলত পুথি পাঠের আসর। কখন যে রাত ফুরিয়ে যেত টের পেতাম না। কুরার আড়াইল (মুরগির খোপ) থেকে যখন মুরগি বাক দিত কিংবা মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসত। পুথির আসরের লোকজন বুঝতে পারত, যে সুবহ সাদেক হয়েছে। পুথি পাঠের আসর ভাঙত। এখন আর সেই দিন নেই। নিজের সংগ্রহে বেশ কিছু পুথি ছিল। কিছু পুথি পুথি সংগ্রাহক ও গবেষক ইসহাক চৌধুরীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। বয়স হয়ে গেছে অনেক দিন ধরে পুথি পাঠ করি না। যারা পুথির আসর জমাতেন তাঁদের মধ্যে অনেকে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আগেকার দিনের মতো ঘটা করে পুথি পাঠের আসর বসে না’। তিনি আরো জানান, পুথি পাঠের আসরে পাঠ করা হতো, কবি আলাওলের পদ্মাবতী, কবি সৈয়দ গাজী বিরচিত শাস্ত্র বার্তা, কবি জমসের আলী বিরচিত চারি মোকামভেদ, মহিলা কবি বিরচিত স্বামীর বিলাপ, কবি শরফুদ্দিন বিরচিত কোরআনের মাহাত্ম্য বয়ান, কবি আবদুল মজিদের বে–নজির বদরে মুনির, কবি শেরবাজ বিরচিত মহ্ববতনামা, কবি মোহাম্মদ হোসেন বিরচিত শরা শরীয়ত, কবি লাল খান শাহ বিরচিত মুসানামা ইত্যাদি। কালের বিবর্তনে এবং আকাশ সংস্কৃতির গ্রাসে ও আধুনিকতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পুথি পাঠের আসর অনেকটা বিলুপ্তির পথে। পুথি পাঠের আসর নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম লেখক ও গবেষক ইতিহাসের খসড়ার সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হকের কাছে তিনি জানান, ‘আমার মা নূর খাতুনের মুখে প্রথম পুথি পাঠ শুনেছি। পুথিগুলো শুনে আনন্দ উপভোগ করতাম। বিশেষ করে পুথির কাহিনিগুলো ছিল রূপকথার গল্পের মতো। আমাদের গ্রামে পুথি পাঠের আসর বসত বৈশাখী রাতে। আসরে বহু দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসত। রমজু পণ্ডিত নামে এক ভদ্রলোক বেশ সুন্দর পুথি পাঠ করে ব্যাখ্যা করে শুনাতো। আসরে মাঝে মাঝে রং চা, বেলা বিসু্কট, মাঝে মাঝে জিলাপিও পরিবেশন হতো। কোনো দুঃখের কাহিনি শুনলে ইস! আহ–হা আহারে, উঃ করে দুঃখ করত। কারও কারও চোখের কোণ বেয়ে জলও গড়িয়ে পড়ত। পুথি পাঠে রূপকথা বা রাজা রানি রাজপুত্র কন্যার কাহিনি আসলে আনন্দও উপভোগ করত। সত্যি এটা ছিল সে সময়ের গ্রামবাংলার মানুষের অনেকটা মনের খোরাক বলা যায়। আস্তে আস্তে ব্যাটারিচালিত রেডিও, টেলিভিশন, ভিসিআর, ইত্যাদি আসতে শুরু করে তখন গ্রামবাংলার মানুষ তাঁদের মনের খোরাক বিনোদনের উৎস পরিবর্তন করতে শুরু করে। পুথি পাঠের আসর হারিয়ে যেতে শুরু করে’। আজ ৪ মে, বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগার ও পটিয়া পৌরসভার যৌথ উদ্যেগে মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের স্মরণসভা উপলক্ষে পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পুথি পাঠের আসর ও পুথি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পরিবার ও পটিয়া পৌরসভার মেয়র আইয়ুব বাবুল ভাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই হারিয়ে যাওয়া পুথি পাঠের আসরের আয়োজন করার জন্য।
পুথির নাম শুনলে সমগ্র বাংলাদেশে নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় পটিয়া সুচক্রদণ্ডী গ্রামের কৃতী সন্তান প্রাচীন পুথি আবিষ্কার, সংগ্রহ, সংরক্ষণ গবেষণা ও সম্পাদনায় যে ব্যক্তিটি দক্ষতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন উপমহাদেশবরেণ্য পুথি সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যিবিশারদের নাম চলে আসে। পুথি পাঠের আসর গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া নির্মল আনন্দের উৎস কালের বিবর্তনে আকাশ–সংস্কৃতি এবং ডিজিটালের জাঁতাকলে পুথি পাঠের আসর যেন হারিয়ে না যায় পুথি গবেষকদের এগিয়ে আসা উচিত। বৈশাখী জোছনা রাতে পুথি পাঠের আসর অনন্তকাল বেঁচে থাকুক গ্রামবাংলায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও ব্যাঙ্কার