গ্রাফিতির ইতিহাস বহু পুরনো। প্রাচীন রোম থেকে পম্পেই নগরীর বিভিন্ন সমাধিক্ষেত্রের দেয়ালে গ্রাফিতির চিহ্ন পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে গ্রাফিতি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ‘করষৎড়ু ধিং যবৎব’ নামক গ্রাফিতি আমেরিকার দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে। টাকমাথার লম্বা নাকওয়ালা এক লোক দেয়াল ধরে বসে আছে– এটাই ছিল কিলরয়ের উপজীব্য। সাদামাটা এই গ্রাফিতিটি আমেরিকান সেনাদের ব্যবহারে জার্মানদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা মনে করে, এটা আমেরিকান সেনাবাহিনীর গোপন কোনো কোড। যদিও আজ পর্যন্ত এর সুপ্ত অর্থ জানা যায়নি। কিলরয় দেয়ালচিত্রে ব্যবহৃত মি. চ্যাড নামক চরিত্রের অবয়ব গ্রিক অক্ষর ওমেগা থেকে অনুপ্রাণিত বলে ধারণা করা হয়। কিলরয়ের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুসন্ধান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্ত্রের ঝনঝনানির মাঝেও হয়ে উঠেছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
গ্রাফিতি হল জনসাধারণের অভিমতকে শৈল্পিক উপায়ে দেয়ালের উপরে লেখা বা আঁকা। স্প্রে পেইন্ট বা মার্কার পেন বা কয়লা দিয়েও গ্রাফিতি তৈরি হতে পারে। গ্রাফিতি একটি বিতর্কিত বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রাফিতি বিনা অনুমতিতে আঁকা হয়।
কলকাতার ব্যতিক্রমধর্মী প্রকাশনা সংস্থা– মনফকিরা থেকে প্রকাশিত বীরেন দাশ শর্মার “গ্রাফিতি এক অবৈধ শিল্প” গ্রন্থে লেখক গ্রাফিতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন “এক অর্থে গ্রাফিতি সাহিত্য না হয়েও লেখার শিল্প, চিত্রকলা না হয়েও অঙ্কনশিল্প।”
ইটালিয়ান শব্দ “Grafitiato” থেকে এসেছে “গ্রাফিতি” যার অর্থ “খচিত”। গ্রাফিতিকে বলা হয় কাউন্টার কালচার, অর্থাৎ যা গতানুগতিক সংস্কৃতির বিপরীত। যে শিল্পকর্মটি প্রচলিত রীতি–নীতি–সিদ্ধান্তের বিপরীতে গিয়ে একধরনের শিল্প বিপ্লব গড়ে তোলে, তাকে গ্রাফিতি বলে। এর উপাদান মূলত সমাজের অবক্ষয়, উৎপীড়ন, নিপীড়ন, রাজনৈতিক অরাজকতা বা স্বেচ্ছাচারতন্ত্র ইত্যাদি।
গ্রাফিতিতে উঠে আসে সমাজের সমসাময়িক বিশৃঙ্খলার এক ব্যাঙ্গাত্মক রূপ, যা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কোন অবস্থায় বাস করছো তুমি, কী তোমার পরিণতি, কীসে তোমার পরিত্রাণ। স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাভাবনা প্রকাশের মাধ্যম গ্রাফিতি। তাই এই স্বভাবজাত ভাবনা প্রকাশের স্থান দেয়াল। বিশ্বের সকল দেয়াল একজন গ্রাফিতি শিল্পীর জন্য উন্মুক্ত ক্যানভাস। তাই বিভিন্ন দেশের দেয়ালে আমরা দেখতে পাই প্রতিবাদ, মুক্তচিন্তা, দেখতে পাই সেই দেশের প্রকৃত দৃশ্য একজন গ্রাফিতি শিল্পী বা গেরিলা শিল্পীদের চিত্রকল্পের মাধ্যমে। ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ফ্রান্সে, আটষট্টির ছাত্র বিপ্লবে।
প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সারা পৃথিবীতেই গ্রাফিতি নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের কাছে সমাদৃত হচ্ছে। তাই দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকা বড় থেকে ছোট বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে সুস্থধারার আন্দোলনের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হিসাবেই মনে করেন প্রগতিশীল চিন্তা–চেতনার মানুষেরা। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলেরা গ্রাফিতিকে ভয় পায়। গ্রাফিতিতে শিল্পবোধ থাকে। চিন্তার খোরাক থাকে।
বাংলাদেশে গ্রাফিতি:
বাংলাদেশে গ্রাফিতি আঁকার ইতিহাসতো– এই সেদিনের। নব্বইয়ের দশকে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় এলাকায় “কষ্টে আছি–আইজুদ্দিন” ও পরের দশকে ‘অপেক্ষায়…নাজির’ লেখাকে বাংলাদেশে গ্রাফিতি লেখার সূচনা ধরা হলেও প্রকৃত গ্রাফিতি হচ্ছে “সুবোধ”।
সেই সময় রাজধানীর আগারগাঁও এবং মিরপুরের কয়েকটি দেয়ালে ‘সুবোধ’–এর গ্রাফিতি বাংলাদেশের প্রথম উদ্দেশ্যমূলক গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র। যা দেখে মানুষ থমকে যায়। এই গ্রাফিতির একমাত্র চরিত্র ‘সুবোধ’। এসব গ্রাফিতিতে লেখা:
“সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না।”
“সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে।”
“সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই।”
“সুবোধ রে দাঁড়া”
এই গ্রাফিতি দেখে মানুষের চিন্তাজগত তাড়িত হয়। ভাবতে ভুলে যাওয়া মানুষ ভাবে, সুবোধ কে? সুবোধ কি সে নিজেই? তাঁকে কি পালিয়ে যেতে বলছে কেউ? তাঁকে কেউ ভালোবাসে না– সে কথাই মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে?
প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গ্রাফিতি বিপ্লবে দ্বিগুণ মাত্রা যোগ করে। এরকম দৃষ্টান্ত দেখা গেছে বহু সময়ে বহু দেশে। ভারতে দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের “হোক কলরব” আন্দোলন, ব্রাজিলের ক্ষুধার্ত শিশুর দেয়ালচিত্র, অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন, ইসরায়েল–সিরিয়ার যুদ্ধসহ আরও অনেক অস্থিরতার সময়গুলোতে ছিল গ্রাফিতির জয়জয়কার। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বিরোধী লড়াইয়ে “Black Lives Matter” ও “” শীর্ষক অসংখ্য গ্রাফিতি আমেরিকার দেয়ালে–দেয়ালে আঁকা হয় প্রতিবাদের অংশ হিসাবে।
১৯৬৮ সালের মে মাসে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে, তাদের সঙ্গে ফরাসি শ্রমিকরাও যোগ দিয়ে নতুন মাত্রা দেয় বিপ্লবের। পুঁজিবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তরুণরা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে উঠে পড়ে লাগে। তারা স্বপ্ন দেখতো রক্ষণশীল ভাবধারা ও কড়া নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার, স্বপ্ন দেখতো বৈষম্যহীন সমাজের, স্বপ্ন দেখতো সাম্যাবস্থা ফিরে পাওয়ার। অসংখ্য প্রাণ যায়, অসামান্য ক্ষতিগ্রস্ততা, গ্রেফতারকৃত ছাত্র–শ্রমিক রাত–দিন এক করে আন্দোলন করে যায়। শুধু মুখের ভাষাকে পুঁজি করে নয়, তারা হাতিয়ার করে দেয়ালচিত্র এবং দেয়াললিপিকে। লেখনী ও আঁকিয়েদের ধার মনে দাগ কাটে গোটা বিশ্ববাসীর। সর্বস্তরের মানুষের একতা পরিবর্তন আনে। ছোট ছোট বিষয়ে জয়ী হতে শুরু করে তারা। এরপর একসময় সরকারের পতন হয়। সেদিনের ছাত্র আন্দোলনের সফলতার ছায়া পড়েছিল দুনিয়া জুড়েই।
সমপ্রতি বাংলাদেশের দেয়ালে দেয়ালে আরও কয়েকটি গ্রাফিতি আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
তারুণ্যের বৈষম্যবিরোধি আন্দোলনে সোচ্চার হওয়ার প্রতিফলন।
এইসব দেয়ালচিত্রগুলো তরুণ আঁকিয়দের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, পাশাপাশি উৎসাহ যুগিয়েছে।
দুনিয়ার প্রতিবাদী মানুষের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে এই গ্রাফিতি। সমাজের অন্যায়, অবিচার আর রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি যেন এক সৃষ্টিশীল প্রতিবাদের ভাষা।