গ্যাটে : জার্মান ও বিশ্ব সাহিত্যের অতুলনীয় প্রতিভা

কানাই দাশ | সোমবার , ২৮ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজি সাহিত্যে যেমন শেকসপীয়র, ইতালিয় সাহিত্যে দান্তে, রুশ সাহিত্যে তলস্তয়, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ তেমনি জার্মান সাহিত্যে গ্যাটে তাঁর বিপুল সৃষ্টিশীল অবদানের জন্য বিশ্বখ্যাত। রবীন্দ্রনাথ যেমন বাংলা সাহিত্যের প্রত্যেক শাখাকে তাঁর প্রায় অলৌকিক প্রজ্ঞা ও সৃষ্টিশীলতায় এককভাবে ঋদ্ধ করেছেন তেমনি গ্যাটে জার্মান সাহিত্যকে গীতিকবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা, আত্মজীবনী, ইত্যাদি নানা সৃজনশীল আঙ্গিক এবং নব নব সৃষ্টির সম্ভারে সমৃদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতই তিনি অসংখ্য ছবি এঁকেছেন। বেঁচেছিলেন তিরাশি বছর। এই দীর্ঘ জীবনে বিরামহীন অনুসন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা ও সৃষ্টির মাধ্যমে পুরো জার্মান সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে প্রায় বদলে দিয়েছেন। রাষ্ট্র চিন্তা ও সমাজ ভাবনায় তিনি রবীন্দ্রনাথের মতই ছিলেন সমান উৎসাহী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পূর্ব বঙ্গের জমিদার উত্তরাধিকার সূত্রে আর গ্যাটে নিজ খ্যাতি ও ক্ষমতা বলে ভাইমারের শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন গ্যাটের গুণমুগ্ধ পাঠক। তাঁর জীবন ও কর্মের গভীর অনুরাগী। অধিকন্তু গ্যাটে ছিলেন একজন বিজ্ঞান সাধক ও গবেষক। বিশেষ করে জীব বিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞানের উপর তিনি তাত্ত্বিক গবেষণা করেছেন যা সমসাময়িক বিজ্ঞান ভাবনাকে ঋদ্ধ করেছে। জীবন ও জগতের রূপান্তরের ধারা নিয়ে তিনি ছিলেন সতত উৎসাহী একজন কবি ও সৃষ্টিশীল ভাবুক। তাঁর জগদ্বিখ্যাত ফাউস্ট নাটক হল জগতের এক ‘মহাতীর্থ যাত্রীর সংগীত’। শিল্পের কাছে সত্যের কাছে চিরসর্মপিত গ্যাটে ছিলেন সত্যিকারের বিশ্ব মনীষা। সারা জীবন তিনি আনন্দ লোকের সন্ধান করেছেন। শুভঅশুভে, নিয়ত দ্বন্দ্বে পরিব্যাপ্ত প্রকৃতি ও মানব জীবনের রহস্য ছিল তাঁর চির অন্বিষ্ট।

তাঁর সৃষ্টির উৎস শুধু নান্দনিক সৌন্দর্য বোধই ছিল না হৃদয়ের প্রণয়াকাংখা ছিল অন্যতম উৎস। বস্তুত জ্ঞানান্বেষণ ও প্রেম বিধূরতা এই দুই ছিল গ্যাটের অন্তর সম্পদ। এই হৃদয়াবেগ ও ঐশ্বর্যে জার্মান ও বিশ্ব সাহিত্যকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

১৭৪৯ সালের ২৮ আগস্ট জোহান হ্বলফগাঙ গ্যাটে ফ্রাঙ্কর্ফুট শহরে এক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রুচিশীল শিক্ষানুরাগী পিতা কাসপান গ্যাটের তত্ত্বাবধানে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। সে সময়ে শিশু গ্যাটের কাছে গল্প ও উপদেশের ছলে বলা হত এই বিশ্বনিখিল পরম করুণাময়ের সৃষ্টি। তখন থেকে তাঁর মধ্যে জীবন ও জগতের বিপুল অজানা রহস্যের প্রতি এক সহজাত ও অদম্য কৌতুহল লক্ষ্য করা যায়। স্কুল জীবনেই তাঁর মেধার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। তাঁর আবাল্য বৈশিষ্ট্য ছিল সহজাত জিজ্ঞাসার মাধ্যমে সব কিছুকে গ্রহণ করা। ম্যাথু আর্নল্ড বলছেন যে গ্যাটে সব সময় বলতেন But is it so? Is it so for me? এই সহজাত কৌতুহল তাঁকে প্রকৃতি বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনায় উৎসাহিত করে। সাহিত্য তাঁর জীবনের প্রধান ভাবনা হলেও বিজ্ঞান ও দর্শন ভাবনা তাঁকে উজ্জীবিত করেছে। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক স্পিনোজা তাঁকে প্রাণিত করেন। স্পিনোজার “Ethics” গ্রন্থটি তিনি সব সময় সঙ্গে রাখতেন। এতে তাঁর স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তার সন্ধান মেলে কেননা স্পিনোজাকে ঐ গ্রন্থের জন্য কথিত নাস্তিকতার অভিযোগে অর্থোডক্স চার্চ বহিস্কার করে। স্পিনোজার ঈশ্বর কোন ব্যক্তি বা ঐশ্বরিক অনুভূতির বিষয় না, তাঁর ঈশ্বর অসীম ও প্রয়োজনীয় এক সত্তা যা প্রকৃতিরই এক বিকল্প ভাবকল্প। গ্যাটে গ্রীক কবি লুক্রেটিয়াসের বিখ্যাত “On the Nature of the Universe কবিতার দ্বারা প্রাণিত হয়েছিলেন। ঐ কবিতা বস্তুবাদী পার্থিব দর্শন চেতনায় অনুরনিত ছিল। তিনি ছিলেন প্রকৃতি পূজারী। প্রকৃতিকে তিনি কার্যকারণ ভিত্তিতে যৌক্তিক পদ্ধতিতে বুঝতে চেয়েছিলেন। তিনি উদ্ভিদ জগতের রূপান্তরের রহস্য নিয়ে গবেষণা করেছেন, অস্থিবিদ্যা বা osteology এবং এনাটমি নিয়ে মৌলিক কাজ করেছেন। ভূতত্ত্বেও তাঁর আগ্রহ ছিল। নিউটনের বর্ণ তত্ত্বের বিপরীতে ১৮১০ সালে doctrine of colours নামে বিজ্ঞানের গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্যাটের গভীর বিজ্ঞান সাধনা ছিল তত্ত্বের মাধ্যমে বিশ্ব প্রকৃতিতে নিগৃঢ় একটি সামঞ্জস্য ও বৃহত্তর ঐক্য সন্ধানের প্রবল এক আন্তরিক আগ্রহের প্রকাশ মাত্র। যার সাথে সাহিত্য ও মানবতাবাদের রয়েছে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও এক বাস্তবানুগ বিশ্বদৃষ্টি ভঙ্গী। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “পর্যবেক্ষণকারী মানুষ বিজ্ঞান রচনা করে, চিন্তাশীল মানুষ দর্শন রচনা করে এবং সমগ্র মানুষটি সাহিত্য রচনা করে।” কাজেই দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্য এই তিনের অত্যুন্নত সামষ্টিক বীক্ষা গ্যাটের জীবন ও বিশ্ব দৃষ্টিকে মৌলিকভাবে প্রভাবিত করেছে। গ্যাটে গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন একটি কবিতা লেখা ও একটি বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের পেছনে কাজ করে imaginative reason। সুতরাং জগদ্বিখ্যাত নাটক ‘ফাউস্ট’ লেখার শ্রম আর উদ্ভিদের মেটামরফসিস নিয়ে আলোচনা, doctrine of colours বা বর্ণের তত্ত্ব আবিস্কারের শ্রমের কোন বিরোধ নেই। কবিতা ও বিজ্ঞান উভয়েই imaginative reason দ্বারা প্রাণিত।

গ্যাটের যখন ৪০ বছর বয়স তখন ইউরোপের ইতিহাসের সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনাফরাসী বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৭৮৯ সালে। সেই বিপ্লব মানুষের চিন্তা জগত, সাহিত্য ও দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ইংরেজি সাহিত্যে শেলী, বায়রন, কীটস যেমন এই বিপ্লবের সাম্যমৈত্রীর ভাবাদর্শে উদবোধিত হয়েছিলেন তেমনি গ্যাটেও এই বিপ্লবের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন চিন্তায়মননে। কিন্তু সে প্রভাব ছিল আবেগ মুক্ত। তিনি ফরাসী বিপ্লবের সাম্য মৈত্রীর বাণীকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করেন কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী নৈরাজ্য ও ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করেছেন। এজন্য তিনি নেপোলিয়নকে সমর্থন করেন। কেননা নেপোলিয়ন তাঁর সাহস ও দৃঢ়তায় সমস্ত অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সকে পূর্ণমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন।

গ্যাটের সাহিত্য সৃষ্টি ও জিগীষা শুধু জার্মানী ও জার্মান ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনেও তাঁর ছিল অবাধ পদচারণা। ফরাসী ও ইংরেজি সাহিত্য তো ইউরোপীয় দুই প্রধান সাহিত্য হিসাবে তাঁর চেনা জানার মধ্যে ছিলই, শেক্সপীয়র তো ছিলেন তাঁর নাট্য ভাবনার কেন্দ্রিবিন্দুতে। ইউরোপীয় সাহিত্যাঙ্গন ছাড়িয়ে সুদুর প্রাচ্যের চীন, ভারত, পারস্য ও আরবী সাহিত্যের পঠনপাঠন, চর্চা ও গবেষণায় সেই অষ্টাদশ শতাব্দীতেও তিনি এগিয়ে ছিলেন। ইতালিতে দুই বছরের প্রবাস জীবনে তিনি ইতালি, গ্রীক ও রোমান সাহিত্য নিয়ে কাজ করেছেন। স্যার উইলিয়াম জোনসের সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনুদিত মহাকবি কালিদাসের “অভিজ্ঞানম শকুন্তলম্‌” এর জার্মান অনুবাদ পড়ে তিনি এতই প্রভাবিত হন যে তার মুগ্ধতা এক অপরূপ কবিতায় তিনি প্রকাশ করেন। এই কবিতা সমগ্র ইউরোপকে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে। গ্যাটে চিনা সাহিত্যও ইংরেজি অনুবাদে পড়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য তথা আরবী ভাষা ও সাহিত্যও তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। পবিত্র কোরান ও ইসলাম পূর্ব সময়ের আরবী কবিতা, ওল্ড টেস্টামেন্টের সলোমনের কবিতা তিনি অনুবাদ করেন। পারস্যের সুফি কবি হাফিজ ছিল তাঁর The west eastern divan এর অন্যতম প্রাণিত স্বর। এই কাব্য সংগ্রহ বা divan হল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক মিলন সেতু। এই কাব্য সংগ্রহের কবিতাগুলো মূলত যুদ্ধ, উগ্র জাতীয়তাবাদে বিপর্যস্ত ইউরোপ থেকে প্রাচ্যের প্রাচীন শান্ত জীবন ও সভ্যতার দিকে গ্যাটের আকর্ষণের অভিব্যক্তি। এনলাইটেন্টমেন্টের মানস সন্তান গ্যাটে বিখ্যাত aeselige senhusucht বা “মৃত্যু ও পুনর্জন্ম নামক কবিতায় খৃষ্টান ও ইসলাম উভয় সেমেটিক ধর্মমতের বিপরীতে আগুনের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ আত্মার উচ্চতর সোপানে আরোহনের কথা বলছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন একাধারে প্যাগান ও অন্যদিকে একজন সংশয়বাদী। তিনি মনে করতেন প্রাকৃতিক ধর্ম কোন সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না। তা আমাদের হৃদয়ানুভূতির ব্যঞ্জনা মাত্র। গ্যাটের সৃষ্টি সম্ভারের বৈচিত্র্য, তাঁর উদার, মানবিক ও আলোকিত জীবন দৃষ্টি, বিজ্ঞান ভাবনা ও গভীর গবেষণা, দ্বন্দ্বমুখর বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী সব কিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন মূলত একজন গীতিকবি। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে কবি শ্রেষ্ঠ গ্যাটে বলে বিভূষিত করেছেন। এলিয়ট স্বয়ং তাঁকে দান্তে এবং শেকসপীয়রের পরে শ্রেষ্ঠ ইউরোপীয় কবি হিসাবে বিবেচনা করেছেন। গ্যাটে বলেছেন নিজের সত্তার দ্বান্দ্বিক অনুরণন, চারপাশের জীবন ও অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারি প্রকৃত সত্য আর কবিতা হল আমার বাঞ্চিত সত্যের অভিজ্ঞান। তাঁর বিশ্বমানবতা, সমগ্রতাবোধ, সৃষ্টির বৈচিত্র্যের প্রতি প্রবল ব্যগ্রতা, এনলাইটেন্টমেন্টের মানবিক প্রজ্ঞা তাঁকে নিয়ত অনুসন্ধানী করে তুলেছে। অগণিত লিরিক লিখেছেন গ্যাটে। তাঁর জীবনকার, বার্কার ফেয়ারলি লিখছেন “the most wide ranging body of lyrical poetry that ever come out of a single mind। পাশাপাশি তিনি এথেনীয় নাটক ও শেকসপীয়রকে মিশিয়েছেন আপন রূপদক্ষতায়, গ্র্যাকো রোমান থেকে পারসিক, ভারতীয়, আরব্য কাব্য জগতে অপ্রতিহত পদচারণা, তাঁকে করে তুলেছে অনন্য সৃষ্টিশীল এক মহৎ কবি ও ন্যাটাকার। তাঁর কবিতা বাংলার কবিকূলকে করেছে উদ্দীপ্ত। বুদ্ধদেব থেকে শঙ্খ ঘোষ হয়ে আহমদ ছফা অনেকেই তাঁর অসংখ্য কবিতা অনুবাদ করেছেন। ফলে বাংলাভাষাভাষী সাহিত্যানুরাগীদের তাঁর কাব্য জগতে পরিভ্রমণ সহজ হয়েছে।

গ্যাটে ছিলেন বিশ্ব পথিক। তিনি ছিলেন শিল্পেসাহিত্যেদর্শনেবিজ্ঞান ভাবনায় পরিব্যাপ্ত অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান নব জাগরণের শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি। রাজনীতিতে রক্ষণশীল ও ঐতিহ্যপ্রিয়, ধর্ম বিশ্বাসে উদার মানবতাবাদী ও খৃষ্টীয় বিশ্বাসে সংশয়বাদী, জাগতিক রহস্যের যুক্তিবাদী চির অনুসন্ধিৎসু এবং বিশ্ব সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মনীষা ছিলেন গ্যাটে। তিনি কান্টের সৌন্দর্যতত্ত্ব ও হেগেলের দ্বান্দ্বিক বিকাশের ধারণার প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। প্রকৃতি পূজারী, আলোক পিয়াসী গ্যাটে মহাবিশ্বের অসীম আলোর ঝর্ণাধারায় স্নাত হতে চেয়েছিলেন আজীবন। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তেও বলে উঠেছিলেন Light Light! More Light বিদায় বেলায় রবীন্দ্রনাথের কথায় যেন বলতে চেয়েছেন

আলোকের এই ঝরণা ধারায় ধুইয়ে দাও

———————————

নিখিলের আনন্দ ধারায় ধুইয়ে দাও

মনের কোণে সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও।”

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মার্ট সিটি গড়তে প্রয়োজন গ্রাফিতি রিমোভাল ইউনিট
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়