আজ ১১ নভেম্বর। ১৯৭২ সালের এই দিনে রাজধানী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক যুব কনভেনশনের মাধ্যমে দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ যুব সংগঠন যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রতিথযশা সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আদলে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। গত প্রায় ৪ দশকের বেশি সময় ধরে দীর্ঘ লড়াই, সংগ্রাম ও হাজারো নেতা কর্মীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে যুবলীগ আজ সর্ববৃহ যুব সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এটির সর্বশেষ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মনি ভাইয়ের সাথে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এড. সৈয়দ আহমদ। দ্বিতীয় কংগ্রেসে চেয়ারম্যান ছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু এম.পি. সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফকির আবদুর রাজ্জাক, এরপর মোস্তফা মহসিন মন্টু (বহিষ্কৃত) সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ফুলু সরকার, চতুর্থ কংগ্রেসে চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল মনির ছোট ভাই সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম এম.পি সাধারণ সম্পাদক এড. কাজী ইকবাল হোসেন (প্রয়াত), এরপরের কমিটি এড. জাহাঙ্গীর কবির নানক এম.পি চেয়ারম্যান, মির্জা আজম এম.পি সাধারণ সম্পাদক। ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে যুব লীগের প্রতিষ্ঠতা শেখ ফজলুল হক মনির ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের কৃতীসন্তান ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যান, হারুনুর রশীদ সাধারণ সম্পাদক।
দেশের রাজনীতিতে যুবলীগের যেমন সুনাম রয়েছে তেমনি কতিপয় নেতাকর্মীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সে সুনাম কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারী বিভিন্ন হামলা, মামলা, টেন্ডারবাজি ও কমিটি বাণিজ্যের কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে সংগঠনটি আলোচনায় আসে। ফলে ভেঙে দেয়া হয় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। এখন যুবলীগের সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী। যার হাতে গড়ে ওঠেছিল যুবলীগ সংকটে পড়ে উদ্ধার হয় সেই ফজলুল হক মনির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশের মাধ্যমে। ২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর কাউন্সিলের মাধ্যমে সংগঠনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। একই সঙ্গে আরেকজন পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতা মাইমুল হোসেন খান নিখিলকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হওয়ার পর সারাদেশে যুবলীগের কর্মকাণ্ড অব্যাহতভাবে চলছে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার রাজপথে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত অবস্থায় জিরো পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন যুবলীগ নেতা শহীদ নুর হোসেন। সেই আন্দোলনে আরো শহীদ হয়েছিলেন যুবলীগ নেতা নুরুল হুদা বাবুল ও আমিনুল হুদা টিটুসহ অনেক নাম না জানা যুবলীগ নেতাকর্মী। ’৭৫-এর পরবর্তী সকল আন্দোলন সংগ্রাম ও ’৯৬ এর খালেদা বিরোধী আন্দোলনে যুবলীগের অনেক নেতা কর্মী শহীদ হন। সেই সময় আমি ছিলাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। তখন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সন্ত্রাসীদের গুলিতে আমার একটি চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। যুবলীগের প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রথম প্রতিবাদীকণ্ঠস্বর শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছলেম উদ্দিন আহমদ এম.পি। সেই কমিটির প্রথম প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন বাঁশখালীর কৃতিসন্তান সাবেক এম.পি বীর মুক্তিযোদ্ধা এড. সুলতানুল কবির চৌধুরী। এর কিছুদিন পর শেখ সেলিম দেশের বাইরে গেলে সুলতানুল কবির চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় বাঁশখালীর কৃতীসন্তান শফিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক, চন্দনাইশের ওয়াহিদুজ্জামান ও পশ্চিম পটিয়ার এম.এ মান্নানকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে দক্ষিণ জেলা যুবলীগের কমিটি গঠিত হয়। তখন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু আন্দোলনের মাঠে এই কমিটি নিষ্ক্রিয় ছিল বলে সেটি বিলুপ্ত করে অন্য একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে বর্তমান চট্টগ্রাম জেলা পরিষদে পটিয়া থেকে নির্বাচিত অন্যতম সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান দেবব্রত দাশকে আহ্বায়ক, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মরহুম আখতারুজ্জামান বাবু’র ভাগ্নে মোছলেম উদ্দিন মনছুর ও আমাকে যুগ্ম আহ্বায়ক মনোনীত করা হয়। তখন খালেদা বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। প্রতিটি উপজেলায় যুবলীগের ব্যানারে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছ্ে ’৯৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দক্ষিণ জেলা যুবলীগের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১২২, আন্দরকিল্লা দলীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে দেবব্রত দাশের সভাপতিত্বে শোক দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি- তৎকালীন বিরোধী দলীয় হুইপ এডভোকেট আবদুল হামিদ। আমি সেই সভাটি পরিচালনা করি। যুবলীগের ইতিহাস আন্দোলন-সংগ্রামও গৌরবের ইতিহাস। এই সংগঠনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা অনেকেই আজকে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। প্রতিষ্ঠালগ্নে মনি ভাই বৃহত্তর চট্টগ্রামে কমিটি গঠনের জন্য বিশেষভাবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পটিয়ার কৃতীসন্তান মরহুম এস.এম. ইউসুফকে। এর পরবর্তী উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগর আওয়ামী যুবলীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যাঁরা তখন নগর কমিটির সভাপতি ছিলেন বাঁশখালীর কৃতীসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এড. সুলতানুল কবির চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস। এরপর দক্ষিণে মোছলেম উদ্দিন আহমদ সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক। বর্তমান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কালাম চৌধুরী সভাপতি ও শফিকুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক। উত্তরের কমিটিতে এস.এম. কামাল উদ্দিন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এড. নাছির উদ্দিন। এর্ল্ল্ল্লপর রহমদ উল্লাহ সভাপতি, মো. মানিক সাধারণ সম্পাদক। মফিজুর রহমান সভাপতি, মো. শফি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ’৯০ দশকে নগর যুবীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন নোমান আল মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হাসান। এরপর সৈয়দ মাহমুদুল হক আহ্বায়ক, চন্দন ধর সভাপতি, মশিউর রহমান সাধারণ সম্পাদক, শফিক আদনান যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। পরবর্তীতে সৈয়দ মাহমুদুল হক কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। দক্ষিণে মাহফুজর রহমান মেরু আহ্বায়ক, ইউনুছ খান জসিম ও আমান উল্লাহ যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান মহিউদ্দিন বাচ্চু নগর যুবলীগের আহ্বায়ক, দেলোয়ার হোসেন খোকা, ফরিদ মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী এম.এ. মন্নানের ছেলে দিদারুল আলম ও মাহবুবুল হক সুমন যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বে আছেন। উত্তরে সাবেক এম.পি কাসেম মাস্টারের ছেলে দিদারুল আলম সভাপতি ও হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদুল আলম সাধারণ সম্পাদক। দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্বে সাবেক ছাত্রনেতা আ.ম.ম. টিপু সুলতান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক পার্থসারথি চৌধুরী। এ পর্যন্ত এই সংগঠনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় রাজনীতিতে তঁদের ভূমিকা ছিল প্রসংশনীয়। পরিশেষে, প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে যুবলীগের অতীত ও বর্তমান সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এদেশের যুব সমাজকে সুস্থ রাজনীতিতে, মেধা, মনন বিকাশে উজ্জীবিত কর ভবিষ্যতে এই সংগঠনের সুনাম, গৌরব ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখবে- এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক : শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ