‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’– এমন মহান গানটির গীতিকার গোবিন্দ হালদার আর মন ছোঁয়া সুর করেছেন বিশিষ্ট সুরকার ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রখ্যাত গায়ক আপেল মাহমুদ। যুদ্ধের ময়দানে বাংলার দামাল ছেলেদের অনুপ্রেরণা ও সংগ্রামী চেতনায় প্রাণবন্ত রাখার জন্য এই গানগুলো উদ্দীপক হিসাবে মানসিক শক্তি সঞ্চার করেছে। ত্রিশ লক্ষ বীর শহীদদের আত্মত্যাগ আর দুই লক্ষ মা–বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা। ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে কৃতজ্ঞচিত্তে সেই অকুতোভয় বীর সেনাদের আর আত্মত্যাগী মা–বোনদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপন করছি।
বাঙালি জাতি আবেগী, স্বাধীনচেতা ও অদম্য সাহসী। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্ব ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে বাঙালি জাতিকে শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার ও বৈষম্যমূলক আচরণ করতে শুরু করলেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। পূর্ব পাকিস্তানের জাতি ধর্ম বর্ণ সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছেন অসামপ্রদায়িক সমপ্রীতিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অধীনে স্বাধীনভাবে বাস করা কোনওভাবে সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠা করার কূটকৌশল সহজেই অনুমেয় হয়ে ওঠে। তাইতো বাঙালি জাতির সংগ্রামী ছাত্রজনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালির মুখের ভাষা ও মায়ের ভাষা বাংলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। মূলত তখন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়। কালক্রমে নানা আন্দোলন সংগ্রামে শোষন আর বঞ্চনায় সুদীর্ঘ ২৪ (১৯৫২–১৯৭১) বৎসর বাঙালিরা মানসিক স্বস্তি হারিয়ে প্রায় শূন্যের কোটায়। তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়েছিল। তখনি ছাত্র–জনতা সকল পেশাজীবী আবালবৃদ্ধরমণী ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিল। এমন অবস্থায় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর তেজোদীপ্ত কঠোর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেইদিনই ছিল সত্যিকারের স্বাধীনতার ডাক। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাক, আমি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা শত্রুকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করিও’। জনতা ক্ষুব্ধ, প্রতিবাদমুখর ও মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে সাত কোটি বাঙালি দলবদ্ধ হয়ে বিজয়ের স্বপ্নে ব্যাকুল হয়ে উঠলো।
২৫শে মার্চ গভীর রাতে কোন আগাম বার্তা ছাড়া নিরীহ অসহায় ঘুমন্ত মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন চার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। বাঙালিরা প্রাণপণ প্রতিরোধে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে কোনও রকম ট্রেনিং ছাড়া সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পার্শ্ববর্তী কল্যাণমিত্র রাষ্ট্রে ভারতে প্রায় এক কোটি লোককে সশস্ত্র ট্রেনিং, খাওয়া দাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এমন মানবিক ও সাহসী অবদান বাঙালি জাতি আজীবন কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। তারা চেয়েছিলো এদেশের সুধী সমাজ, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষকে টার্গেট করে গণহত্যা করে দেশকে অকার্যকর মেধা শূন্য করতে। বীর বাঙালি গেরিলা যুদ্ধে তাদের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে মাত্র নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পরাস্ত করলো। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এ এক অভূতপূর্ব বিজয় চিনিয়ে আনলো বাঙালি জাতি। লাল সবুজের পতাকা আর বিশ্বের মানচিত্রে যুক্ত হলো নতুন একটি রাষ্ট ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত ভিত্তি, বৈদেশিক সম্পর্ক তৈরী করা, সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণ করা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সর্বোপরি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংবিধান রচনা করা আরো নানামুখী সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নিয়ে মহামান্য রাষ্টপ্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দূরদর্শী চিন্তা চেতনায় দেশ গঠনে এগিয়ে যাচ্ছেন। আর তখনই স্বাধীনতার অপশক্তি ঘাতক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর কতিপয় বিপদগামী রাষ্ট্রদ্রোহী সেনাসদস্যের বর্বরোচিত জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীন সার্বভৌমত্বের আমজনতার দরদী বন্ধু, অবিসংবাদিত নেতা, মহান রাষ্ট্রনায়ক, জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের ও নিকটতম আত্মীয় স্বজন সর্বমোট ২৬জন সদস্যকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে ইতিহাসে কালো অধ্যায়ের সূচনা করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী ছিলেন কিন্তু তাদের হাত থেকে বেঁচে ফিরলেও ঘরের মানুষদের কাছে জীবন দিতে হলো। তিনি বাংলার মানুষদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসার মানুষরা তাঁর ও তাঁর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধু দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন জার্মানিতে অবস্থান করেছিল বলে প্রাণে বাঁচতে পেরেছিল। এরপরও বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সর্বমোট ১৯ বার হত্যা করার চেষ্টা করেছে। তারপরও মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায় তিনি প্রতিবারই কোনও না কোনওভাবে জীবন রক্ষা করেছেন। খুব মনোকষ্টে বলতে হয়, আমরা বড় অকৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি। আমরা লজ্জিত–আমাদের ক্ষমা করো পিতা।
স্বাধীনতার প্রায় ৫৪ বছর পর বাংলাদেশে সর্বস্তরে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। তাই জাতীয় দায়িত্ববোধ থেকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে অসামপ্রদায়িক চেতনায় সন্ত্রাস, মাদক, দুনীতিমুক্ত, নারী বান্ধব সুন্দর, সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমজনতার সার্বিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারলে স্বাধীনতা অর্জন সার্থক হবে। দেশ স্বাধীন করার মানসে মুক্তিকামী দৃঢ় প্রত্যয়ী বাঙালি জাতির ইতিহাসে আজকের দিনটি এক মহাগৌরবের। বিশ্বনেতা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, প্রাণপ্রিয় নেতা, মমতাময়ী মাতা, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদাত্ত আহবান, ‘আসুন দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি ঊন্নত, সুখী, সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’। পরিশেষে, চলুন আমরা সকলে দেশকে ভালোবাসি। দেশের স্বার্থে সকলে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন হই। পরিশ্রম, সততা ও নিষ্ঠার সাথে প্রতিটি মানুষ আগে নিজেকে বদলায় তারপর অন্যকে বদলাতে সাহায্য করি। তাহলেই আর সেদিন দূরে নয় ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়া’ সহজতর হবে। জয়তু স্বাধীনতা দিবস। জয়তু বাংলাদেশ।
লেখক: প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন এনজিও কর্মী।